
পর্ব -০৯
সলিসিটরের ফোন ! আইনজীবীর ফোন পেলে প্রথমেই আমার চোখের সামনে তার কালো রঙ্গের পোশাকটি ভেসে ওঠে। কালো রং আমার কাছে কি তবে আতংক আর আশংকার বহিঃপ্রকাশ ঠিক জানিনা ! তবে আষাঢ়ে মেঘে যখন আকাশ জমকালো রং ধারণ করতো তখন অজানা ভয়ে আমার শরীরে যেভাবে শিরশিরে কাঁপুনি দিতো ঠিক তেমনি সলিসিটরদের কালো পোশাক দেখলে আজও অশীতিপর বৃদ্ধের মতো শরীর অবশ হয়ে যায়। আইনজীবীদের পোশাক কালো কেন সেই চিন্তা মাথায় অনেকদিন থেকে ঘুরপাক খাচ্ছিলো ! দেশে থাকতে উকিলদের পোশাক দেখলে যেভাবে ভয় পেতাম আজও তেমনি সলিসিটরদের পোশাকের প্রতি অজানা ভয় আর আতংক মনে সক্রিয় হয়ে আছে। যে জিনিসে যতটা আতংক না চাইলেও সেই জিনিস ততটাই বাস্তবিকভাবেই জীবনের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। এই জীবনে নিজের ও বাঁধনের জন্য কতবার যে সলিসিটর অফিসে দৌড়ঝাঁপ দিয়েছি তার হিসাব ভাগ্যবিধাতা ছাড়া কেউ জানেনা । আজ-ও ধীরে ধীরে সলিসিটর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। এই প্রথম আমাকে দেখে সলিসিটর কোমল গান্ধারের মতো হাসির সুর দিলেন। আমি তার সামনে বসার কিছুক্ষণ পরই আমার হাতে খয়েরী রঙের একটি এনভেলপ দিয়ে বললেন,
- গুড নিউজ !
-তোমার হিউম্যান রাইটসের অ্যাপ্লিকেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
- এই নাও তোমার ইনডিফিনিট লিভ টু রিমেইন ইন দ্য ইউ কে'র এর কার্ড।
- বেস্ট অফ লাক ।
আমি খামটি হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই খামের উপর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো। একটি সুসংবাদ যে আত্মাকে কতটা প্রশান্তি দেয় স্বাদগ্রহণকারী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না । ঠিক তেমনি দুঃসংবাদও ভুক্তভোগী ছাড়া কারো সাধ্য নেই বুঝার।
- কান্নার কিছু নেই। এবার দেশে গিয়ে বিয়ে করো।
সলিসিটরের রুমে বসে নিজের অবচেতন মনেই আমি বাচ্চা শিশুর মতো কাঁদলাম, সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমাকে সুসময় দান করলেন। আমারও বুঝি সময় এলো সুখ-সম্ভোগের । মায়ের কথামতো আমিও তাহলে লাল পাসপোর্টের মালিক হয়ে গেছি।
একটু স্থিরতা আসার পর মন মোহনায় সুখের ধাক্কা খেলাম এই ভেবে....
- হায় ! "বিধির কত রহস্যময় বিধান"...
যে বাঁধন আমাকে এসে লিগ্যাল করার কথা আজ তাকে আমি দেশ থেকে নিয়ে এসে লিগ্যাল করবো এরচেয়ে ভাগ্য আর কি হতে পারে !
এটাই বুঝি ধৈর্যের অদ্ভুত মিষ্টি সুখ। জীবনের জটিল ধাঁধার সমাধান বুঝুন কোন মহা অদৃশ্য শক্তির ইশারায় হয় ! বাঁধনের মুখটা চোখর পাতায় ভেসে উঠলো আর এক স্বর্গীয় আনন্দ আর খুশিতে দু'গাল বেয়ে আনন্দের অশ্রুনালা বইতেই লাগলো।
হেঁটে হেঁটে বাসায় পৌঁছার পূর্বেই মনস্তাপ জুড়িয়ে দিতে দিতে ভাবলাম আর দেরী করা চলবে না !
একমুহূর্তে আমিই হলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান পুরুষ যে কিনা মা,মাটি, মমতাময়ী স্ত্রী এই এয়ীকে জয়ী। একমাসের মধ্যেই টিকিট কেটে দেশের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। দেশে যাবার পথে সৌদি আরব গিয়ে উমরাহ করে আল্লাহর কাছে নতুন জীবনের জন্য দোয়া করলাম।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মা,বাবা, ভাই ও বাঁধন সহ অনেকই আমাকে রিসিভ করতে আসলেন। বাঁধনকে দেখে সত্যি বিমোহিত হলাম। তাকে দেখে মনেই হয়নি এই প্রথম দুজন একে অপরকে দেখছি ! মনে হলো কতদিনের চেনাজানা, আর কতটা আপন। তার নীলাভ দু'চোখ জুড়ে বিস্তৃত মাদকতা আর মুখের অবয়বে মিশে থাকা মোহনীয় সরলতায় মনে হলো সে যেন কোন এক মহামতি নীলাম্বরী বিশ্ব শান্তির মেঘদূত হয়ে পৃথিবীর বুকে এসেছে।
একযুগ পর দেশে পৌঁছে দেখলাম চেনা অনেক কিছুর কোন চিহ্ন নেই কিন্তু চিরচেনা আকাশ, কোমল বাতাস, বড্ড আপন 'মা' আর মাঠির নরম কোমল পরশ এগুলোর কোন পরিবর্তন নেই। এসব যেন আমাকে আপন করে নিজের কোলেই টানছে।
দেশে পৌঁছে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিলো কিন্তু দুদিন পর-ই হঠাৎ করেই মহাবিপত্তি হয়ে গেলো ৷ বাবা আমার সাথে বাঁধনের বিয়েতে বেঁকে বসলেন।
বাবার কথা হলো,
- এই মেয়ে গত বারোটা বছরে কি দিলো ! না পেলে সংসারে স্বাদ না হলো লন্ডনের স্বাদ শুধু ঘোলাপানিতে সাঁতার ছাড়া কিছু নয়।
এ বিয়ে হবে না। তুই ভিন্ন চিন্তা কর।
বাবা ' এটা কেমন করে হয়?
মা বাবার মত মুখে কিছু না বললেও চোখে-মুখের ভাষাতে বাবার কথার প্রতিধ্বনি যেন স্পষ্ট হয়েছিল, কিন্তু 'সবার আগে সন্তান' জগতের তাবৎ মাতৃকুলের মধ্যে যে মিল আমার অবচেতন মনে গেঁথে আছে তার প্রমান পেলাম। মা' আমার মনের অবস্থা পরখ করতে পেরে আমাকে অভয় দিতে লাগলেন। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-এটা কেমন করে হয়? এতদিন পরে ছেলেটা বাড়িতে এসেছে, কোথায় ওর মানসিক শান্তির কাজ করবে। তা না করে কড়া কড়া কথা বলা! আমার সরল সাদাসিধে ছেলেটার মন ভাঙ্গা আর দিন দুপুরে খুন করা সমান অপরাধ বলে রাখলাম।
-আমি লজ্জা শরম ছেড়ে বাবাকে বলতে লাগলামে
বাবা আমি বাঁধনকে সেই একযুগ থেকে স্ত্রী হিসাবেই জানি।
বাবা বেশ কর্কশ স্বরে বলতে লাগলেন,
- তুই আমাকে জন্ম দিয়েছিস, নাকি আমি তোকে জন্ম দিয়েছি? গত বারো বছরে পরিবারের জন্য কি করেছে ও? শুধু দুআনার প্রেম করা ছাড়া... অবশ্য খেলবে নাই বা কেন, তুমি যে মজনু হয়েছ।
এতক্ষণ বাবার কথা নিরবে হজম করলেও আর যেন মনোজগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারলাম না। অবচেতন মনেই বলেই ফেললাম,
-বাবা! কি এসব বলছেন?
-হ্যাঁ ঠিকই বলছি।যদি সরকার থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা না পেতাম তাহলে না খেয়ে মরতাম।তুমি সন্তান হয়ে পিতা-মাতার চিন্তা না করলেও জন্মদাতা হিসেবে আমাদের তোমার কথা ভাবতে হয়। তোমার বিয়ের জন্য আমার কাছে ভালো একটা সম্বন্ধ আছে।
আমি বাবার কথা শুনে নিরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উনি আবার বলতে লাগলেন।
-আমার বন্ধুর সুন্দরী মেয়েকে যদি বিয়ে করো তবে আমাদের সামাজিক বলয় বাড়বে।আর মেয়ের বাবা সিলেট শহরে তোমার নামে একটা দুতলা বাসা লিখে দেবে।
-বাবা! আমি আপনাকে আদর্শ করে বড় হয়েছি, সেই আপনি কিনা যৌতুকের প্রসঙ্গ....
-হ্যাঁ যা বলছি তোমার ভালোর জন্য বলছি। কাজেই আমার কথার উপর শতভাগ নির্ভর করতে পারো।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



