শৈশব নিয়ে লেখা সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব-
কেয়া পাতায় নৌকা ভাসানোর দিনগুলো -১
কেয়া পাতায় নৌকা ভাসানোর দিনগুলো -২
আমার শৈশবে গল্পে পুরানো ঢাকা তার নিজস্ব গৌরবে উজ্জ্বল! সবুজে সারল্যে, কলাপাতা ঘ্রাণে, মোগলাই ঘি আর মিশ্র সংস্কৃতিতে। সেখানে যতটা ছিল রেডিও তে বাংলা গানে নাটকে ভরপুর আনন্দ তেমনি ছিল হিন্দি উর্দু গানের রেকর্ড প্লেয়ার আর ভি সি আর সিনেমা। আসে পাশের অনেক পরিবার ই নিজেদের মাঝে হিন্দিতে বা উর্দু তে কথা বলত। গায়ে তখন ও ছিল বিহার করাচী পাঞ্জাব দিল্লির শ্যাওলা।
শীতের এই হিম কুয়াশা লুকিয়ে রাখা সময়টা তে, ছাতিম ফুলের ছন্দ ছায়ায় দিন আনত; ঘোরলাগা সুবাস দুহাতে মাখতাম মালা গাঁথতাম কখনো বা রান্নাবান্না খেলার পোলাউ করে সাজাতাম থালায়। এখান ওখান থেকে মাটি এনে পুতুল বানাতাম সব ই সেই পিচ ঢালা রাস্তায়। এক্কা দোক্কা দাগ কাটা পথ অথবা প্রাইমারী স্কুলের এক চিলতে মাঠ, সব খানেই ছিল আমার দৌরাত্ম্য ! একেবারেই ডানপিটে দুরন্ত দিন সব। কতদিন যে টিফিন এ পালিয়েছি ডালপুরির খোঁজে। সবচাইতে ভয় পেতাম নিলু আর নাজনীন আপা কে। মেয়েদের স্কুল বলে হয়ত , মারধর করতেন না তবে নাজনীন আপা সবসময় হাতে বেত নিয়ে ঘুরতেন। আমার মনে আছে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করে ফিরে, দুই সেকশন মিলে হল্লা মাচাছিল্লাম; দুই ক্লাসের মাঝে ভাঙা দেয়াল লাফিয়ে পার হয়েছিলাম বলে টিচার আমার কান ধরে টিচার্স রুমে নিয়ে গেছিলেন বিচার করার জন্য হেড টিচার তনু আপা বলেন আরেয়ে একে তো মাত্রই ক্লাসে পাঠালাম রেজিস্ট্রেশন শেষ করিয়ে ছেড়ে দাও ওকে। এরপর আর কি কান ডলতে ডলতে পঁচিশ পয়সার আইসক্রিম কিনে স্বপ্নে ভেসে মেঘের ট্রেনে বাড়ি ফিরলাম স্কুল ছুটির পর।
আমার স্কুলের আর একটি স্মরণীয় ঘটনা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে হাত মেলানো ! আমাদের স্কুলে এসে উনি ভাষণ দিয়েছিলেন। মনে আছে সরকারের স্কুলে বিনামূল্যে বিতরণ করা বই আর টার্কিশ রঙের নোটবুক। সে সময়' টাতেই ই পি আই এর ৭ টা টিকা দেয়া শুরু হল স্কুলে স্কুলে। কমিউনিটি সেন্টারে সেন্টারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা, সচেতনতা মূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী।
আমাদের কলতা বাজারের বাসায় ন্যাশনাল কোম্পানির এন, ও সি টেলিভিশন ছিল একটা, সমস্ত পাড়া ঝুঁকে আসত টি ভি দেখতে। চালু হতে অনেক সময় নিত সেটা। খবর তো বুঝতাম না শুধু মাত্র শিক্ষামূলক কিছু হলেই ডাক পেতাম। কারন টি ভি রুম ছিল আমার নো গ্যাঞ্জাম মামার দখলে।একটা গল্প খুব মনে আছে, রোনাল্ড রিগ্যান নামের একজনের খবর সব সময় শিরোনাম থাকত; একদিন আমার বড় আপু আর ভাইয়া মিলে কথা বলছিলেন যে রিগ্যান নের বাংলাদেশ সফর একটা অসম্ভব ব্যাপার!! শুনে আমি ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, সে যদি নাই আসে তাহলে খবরে প্রতিদিন কিভাবে দেখায় ? সে প্রশ্নের পর তো বাসায় আমার নাম ই হয়ে গেল এমেরিকান। কারন আমার কাছে বাংলাদেশ আর আমেরিকার নাকি তফাত নেই।ছোটদের অনুষ্ঠান দেখা যেত শুক্রবার সকালে দু ঘণ্টা আবার বিকেলে। খুব মনে আছে কত আগ্রহে সময় কাটিয়েছি শুধু ঝিরঝির দেখে, সম্প্রচার শুরু হতে ঢের দেরী জেনেও। একটু বড় হবার পর "পেপার চেইজ (একদম বুঝতাম না ভালো ও লাগত না), ওন্ডার ওম্যান, সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান , এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দেখার কথা মনে আছে , ডবল ডেকার নামে এক ছোটদের সিরিজ ,আর শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা "থ্যান্ডার ক্যাটস "।
"আজাদ সিনেমা হল " এ জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র দেখার ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতি !!! সেও আমার পুরানো ঢাকাতেই- এক বিকেলে আব্বা মা এর সাথে গিয়েছিলাম। গানের একটা লাইন ছাড়া কিচ্ছু মনে নেই। একটু বড় হবার পর খুব কেঁদেছিলাম ছুটির ঘণ্টা সিনেমা দেখে। সিনেমা হলের পাশেই ন্যাশনাল হসপাতালের লাল ইটের বিল্ডিং ছিল, কেমন যে এক গন্ধ মাখা পুরনো মায়া। সেখানেই জন্ম হয়েছিল আমার ছোট বোনের সে আরেক সুখের মুহূর্ত! পুতুল নিয়ে পুতুল খেলা আমার।
বৃষ্টি হলেই এক ছুটে রাস্তায়! আসে পাশের মাঠ ছাদ দৌড়ে বেড়ানো দমকা হাওয়ায় শিহরণ, ভেজা নীল ঠোঁটে বাসায় ফিরে মায়ের বকুনি। সদর ঘাটের নৌকা বাইচ, ধুপখোলা মাঠের কোরবানির হাঁট, ঈদের মেলার মাটির বাসন, কাঁচের চুড়ি হলদে পিরান। এক ছুটে দৌড়ে চলে যায় শক্ত পায়ের ধুপধাপ।
এরপর তো আমার উড়াল অন্য ডাঙায় অন্য সবুজ কাঁদা মাটি জল। আব্বা ট্রান্সফার হয়ে মুনশিগঞ্জ চলে এলেন আমাদের নিয়ে। একদিন খুব ভোরে বাসার সামনে ট্রাক এলো, আমরা গোছগাছ করে বাসে চড়লাম। পরিবর্তনের দমকা হাওয়া সবকিছু তে, মফস্বলের শ্যামলিমা আর কৈশোরের অদেখা ভুবন। সদ্য ভোরের সূর্যের মত হাতছানি দেয়া অপার রহস্য। মল্লিকা যূথীর যূথ বদ্ধতা।
মুনশিগঞ্জের সেই ছোট্ট শহরের এক আকাশ গল্প বলার আছে আমার; স্কুল খেলার মাঠ, প্যারেড পিটি কবিতা আর অভিনয়। সব জমা রেখে শুধু বদলে যাওয়া টিনের চালের গল্প টুকু আজ -
আমার পড়ার টেবিল এর পাশের জানালায় ও'পারে একটা ঝুমকো জবার গাছ ছিল ; বছর ধরেই সে আর কলাবতীর গুচ্ছ গা উজার করে ফুল ফোটাতো। সাথে গায়ে ছোঁয়ানো প্রতিবেশী দাদুর পূজাঁর ঘরের বেলপাতা ফুল ধূপকাঠির ধোঁয়া; শরত এলেই তার সাথে শিউলি সুর মেলাতো। শিউলি গাছটা খনিক দূরের যদিও দাদুর বাড়ির শেষ মাথায়; পুরনো রান্নাঘর আর বেল চালতার কাছটিতে।তবুও ভোরের শিশির এর সাথে ঝরে পরার সময় আর সন্ধ্যার হিমকনায় প্রস্ফুটিত হতে যেয়ে তুমুল সুবাস দিত সবাইকে ।
কালী বাড়ির মন্দিরে দূর্গাপুজার এ ক'দিন ভোরের আলোর সাথে মাইকে চমৎকার সব গানবাজত। ভোররাতের মিষ্টি ওম না কাটতেই দূর থেকে ভেসে আসা কিশোর কুমারের কন্ঠের " সে যেন আমার পাশে আজো বসে আছে " গানের বিষন্ন মায়ার সাথে ছুটির দিনগুলোর শুরু হত। তার সাথে ঝুমকো জবার হাসি, পাশের জানালায় দাদুর ধূপকাঠি আর শিউলির সুবাস কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত ....
আহা কৈশোর !!! বুকে কেমন করা এক অনুভূতির নাম !
টিনের চালের সেই টুপটাপ ধুপধাপ শব্দের সাথে আর একবার মিশতে চাই, সদ্য নেমে আসা বানের টলটলে পানি গায়ে মাখতে চাই; সব চাইতে বেশি চাই সেই কেয়া পাতায় নৌকা ভাসানোর দিনগুলোর মত নির্ভার হয়ে ঘুমাতে।
ছবিঃ গুগুল
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৫৬