হাইস্কুলে পড়ার সময় হুমায়ূন আহমেদের বই গোগ্রাসে গিলেছি। হিমু থেকে শুরু করে শুভ্র, মিসির আলী, প্রেমের উপন্যাস সবকিছু আমি পাগলের মতো পড়তাম। হার্ডকপি ছাড়াও সফট কপি পড়েছি প্রচুর। মিসির আলী সিরিজের বেশিরভাগ বই-ই আমার সফট কপিতে পড়া। এসএসসি পরীক্ষার পরে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম "বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল"। জুন মাস এলেই এখনো সেই চার বছর আগের সেইসব দিন অনুভব করি। বৃষ্টির মধ্যে পড়া সেই নবনী, তিথির নীল তোয়ালে, তোমাকে, আয়নাঘর, পাখি আমার একলা পাখি-র সব চরিত্ররা যেন এখনো আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
তখন থেকেই হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য পাঠকদের মতো আমিও একটি কথা শুনে অভ্যস্ত। তা হচ্ছে- হুমায়ূন আহমেদের লেখা হচ্ছে অল্প বয়সের পোলাপানের মাথা নষ্ট করার যন্ত্র। অনেক ভেবেও তখন এই কথা বলার পেছনের যুক্তি খুঁজে পাইনি। তবে এরপরে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য লেখা পড়তে গিয়ে হুমায়ূন সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা কিছুটা ধরতে পেরেছি বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু পোলাপানের মাথা নষ্ট করার মতো কী করলো এটা বুঝতে পারিনি। এতোদিন ভেবেছি, লেখায় চটুল ভাষার যে ব্যবহার তা-ই কি এই মন্তব্যের কারণ? কী জানি কেন অন্যরা এ কথা বলেন!
তবে সম্প্রতি বহুদিন পরে হুমায়ূন আহমেদের লেখা চারটে উপন্যাস টানা পড়ার পরে আমি সম্মত হতে বাধ্য হলাম যে, তার লেখা আসলেও অল্প বয়স্কদের বিগড়ে (!) দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বিসাকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে দুটি বই 'এই বসন্তে' আর 'অন্যদিন' এনেছিলাম। আর পয়সা দিয়ে কিনেছিলাম 'সমুদ্র বিলাস' আর 'গৌরীপুর জংশন'। এই চারটি বই পড়তে পড়তে লক্ষ্য করলাম, হুমায়ূন আহমেদের লেখায় একটি বৈশিষ্ট্য আছে- যা আমি আগে কখনো লক্ষ্য করিনি। তাঁর লেখা এতোটাই সরলতা মাখা যে পড়লে মনে হয় জীবনটা বুঝি এমনই সহজ-সুন্দর। কত কঠিন কঠিন পরিস্থিতিকেও তিনি এমনভাবে দেখিয়েছেন যেন এই কঠিনতাই জীবনের সৌন্দর্য। এই কঠিন পরিস্থিতি না থাকলে জীবনটা আসলে জীবনই হতো না! হতো বুঝি মড়ার মতো পড়ে থাকা এক টুকরো শব্দ কেবল।
'অন্যদিন' উপন্যাস একটি মেস বাড়িকে কেন্দ্র করে লেখা। সেখানে চরিত্রগুলোর জীবনে কত দুঃখ, কতই না কঠিন শেষাংশ। অথচ কি সুন্দর মায়াময় ছন্দে লেখা। 'সমুদ্র বিলাস' পড়লে মনে হয় তৌহিদের মতো একজন মানুষ পেলে জীবনটা বেশ রোমাঞ্চকর হতো! কিন্তু আসলেই কি তৌহিদেরা সত্যিকারের জীবনে গ্রহণযোগ্য? রিমির সিদ্ধান্তই কি রূঢ় বাস্তবতা না, যে বাস্তবতাকেও উপন্যাসে তুলে আনা হয়েছে একটি শান্ত, সুন্দর 'সেটিং' এর মধ্য দিয়ে?
তো একটা সময় হয়তো বুঝতে পারা যায় যে, জীবনটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের মতো না। এখানে মায়ার চেয়ে যন্ত্রণার বাস্তবতা ঢের বেশি। কিন্তু কৈশোরের অনভিজ্ঞ সময়ে এটা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। তখন জীবনকে হুমায়ূন-উপন্যাস ভেবে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে বাকি জীবন তার প্রায়শ্চিত্য করতে হয়। উপন্যাস তো যেকোনো ঘটনা দিয়েই শেষ হতে পারে! কিন্তু বাস্তবের জীবনগুলোর অবসানের জন্য তো অনিয়ন্ত্রিত মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই এসব বই রূঢ় বাস্তবতাকে দেখার আগে না পড়াই ভালো।
চারটে বইয়ের মধ্যে আমার 'সমুদ্র বিলাস' আর 'অন্যদিন' বেশ ভালো লেগেছে। 'এই বসন্তে' উপন্যাসকে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে; পড়ে তৃপ্তি পাইনি। প্লটকে বাইরে রেখে বিবেচনা করলে 'গৌরীপুর জংশন'ও মোটামুটি ভালো।
হুমায়ূন আহমেদের গানগুলোও আমার খুব পছন্দের। সেগুলোর মধ্যে এই গানটা শুনুন। এই গানের বিশেষ চারটি লাইন, আমার অনেক প্রিয়। বলতে পারেন কোন চারটি লাইন?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৪ ভোর ৪:২৫