somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

আমিই সাইফুল
আমি একজন ইউরোপ প্রবাসী, জীবনের ঝড়-ঝাপটায় পাক খেয়ে গড়ে ওঠা আজকের এই আমি। ব্লগে তুলে ধরি মনের গভীরে লুকানো আবেগের রং, যা সোশ্যাল মিডিয়ার চটকদার আলোয় মেলে না। আমি অনুভূতির এক ফেরিওয়ালা, শব্দে বুনে যাই জীবনের অলিখিত গল্প…

শুকনো মাটির গান

২৭ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চারদিকে শুধু শুকনো মাটি আর ফাটা ধরা জমি। রাফি দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট্ট জমির মাঝখানে। বরিশালের কাউনিয়ার এই গ্রামে বর্ষা এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আকাশ নীল, কিন্তু মেঘের ছায়া নেই। জমিতে ধানের চারা শুকিয়ে খড় হয়ে গেছে। একটা কাকও উড়ছে না। শুধু ধুলো আর বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ। রাফি হাত দিয়ে একটা শুকনো গাছ ছুঁলো। মুখে বিড়বিড় করে বলল, “মাটিতে রস নেই, হায় জননী, তুমি কি শুকিয়ে গেলে?”

দূরে তার ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির পাশে আমগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তবে পাতা ঝরে গেছে। রাফির বউ তানিয়া সকালে বেরিয়েছে বরিশাল শহরে। কিছু কাজের সন্ধানে। ঘরে চাল-ডাল ফুরিয়ে এসেছে। তানিয়া বলে গেছে, “আমি না গেলে কী খাবে তুমি আর রিমি? পেটের জ্বালা ঢাকা যায় না।” রিমি, তাদের ছোট্ট মেয়ে। মাত্র ছয় বছর বয়স। রাফি ভাবে, রিমির জন্যই তো এই লড়াই।

জমির এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আজিজ মিয়া। গ্রামের বড়লোক। সে এসেছে রাফির জমির খড় কিনতে। হাতে একটা লাঠি, গায়ে ফতুয়া, আর মুখে হাসি। “রাফি ভাই, এই খড় আর কী কামে লাগবে? পাঁচ কেজি চাল দিচ্ছি, বেচে দাও। গরুতে খাবে না এই শুকনো খড়।” রাফি দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। আজিজ আবার বলল, “দেখো, আকাল আসছে। এখন বেচে দিলে হাতে কিছু থাকবে। পরে তো সব নষ্ট হয়ে যাবে।”
রাফির মনে ক্রোধ জ্বলে উঠল। “আমার জমি আমি বুঝি না? তুমি চোখ দিও না, আজিজ। তোমার চোখের নজরে সব ভাগাড় হয়ে যায়।” আজিজ হেসে উঠল, “আচ্ছা, আচ্ছা, ভেবে দেখো। আমি তো ভালোর জন্যই বলছি।” বলে সে লাঠি ঠুকে হাঁটা দিল।

রাফি জমির মাঝে বসে পড়ল। হাতে একটা শুকনো ধানগাছ। সে ভাবে, এই জমি তার বাপ-ঠাকুরদার আমানত। এখানে ধান ফলত, মুগ ডাল হতো, তিলের আবাদ হতো। এখন শুধু খড় আর ধুলো। দূরে রিমি ছুটে আসছে। খালি পায়ে, পরনে একটা ফ্রক। “বাবা, খিদে পেয়েছে। মা কখন আসবে?” রাফি মেয়েকে কোলে তুলে নিল। “আসবে, রিমি। মা তোর জন্য পড়তে-লেখতে পিঠা আনবে।”

রিমির চোখ বড় বড়। “বাবা, মাটি এমন শুকনো কেন?” রাফি হাসল, “জল হলে ঝাড় খেলবে। দেখিস, আবার সবুজ হয়ে যাবে।” কিন্তু তার বুকের ভেতর তরাস। আকাশে মেঘ নেই। নদীর জল শুকিয়ে গেছে। কাউনিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদী এখন শুধু বালি আর কাদা।
সন্ধ্যা নামল। তানিয়া ফিরল। হাতে একটা থলি। “দুই কেজি চাল আর একটা ডালের প্যাকেট পেয়েছি। কাল থেকে একটা দোকানে কাজ শুরু করব।” রাফি তাকাল তানিয়ার দিকে। “তুই এত দূর যাবি? রিমি কী করবে?” তানিয়া জবাব দিল, “তোমার জমি আর আমাকে খাওয়াতে পারছে না। আমি না গেলে কী খাবে? ইজ্জত দিয়ে পেট ভরে না।”

রাতে রাফি ঘুমাতে পারল না। বাইরে উত্তরের হাওয়া বইছে। শীত আসছে। সে উঠে জমিতে গেল। রিমি ঘুমিয়ে আছে। জমির মাঝে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। “জল দে মা, একটু জল দে।” হঠাৎ দূরে একটা শকুন উড়তে দেখা গেল। রাফির বুক কেঁপে উঠল। “আকাল আসছে।” সে বিড়বিড় করে বলল।
পরদিন সকালে আজিজ আবার এল। “রাফি ভাই, দশ কেজি চাল দিচ্ছি। খড়টা বেচে দাও।” রাফি চুপ। তানিয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “দিয়ে দাও। ঘরে কিছু নেই। রিমি কী খাবে?” রাফির মনে যুদ্ধ। শেষে সে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু জমি আমার থাকবে।” আজিজ হাসল, “ঠিক আছে, ভাই।”
রিমি এসে বলল, “বাবা, তুমি কাঁদছ?” রাফি মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। “না রে, আমি আছি না। তুই আছিস। জল হলে আবার আবাদ হবে।” কিন্তু তার চোখে জল। আজিজ চলে গেল। খড় নিয়ে গেল। রাফি ভাবল, “আমার জননী, তুই কি আমাকে ছেড়ে দিলি?”

দিন গেল। তানিয়া কাজে যায়। রাফি জমিতে বসে থাকে। রিমি খেলে। একদিন রিমি এসে বলল, “বাবা, ওই দেখ, শকুন!” রাফি তাকাল। আকাশে দুটো শকুন ঘুরছে। সে রিমিকে কাঁধে তুলে নিল। “ভয় পাস না। আমি আছি। তুই বড় হবি। এই মাটি আবার ফল দেবে।” কিন্তু তার গলা ভারী।
শেষে একদিন বৃষ্টি এল। ছিটেফোঁটা। রাফি জমিতে ছুটল। রিমি লাফাল। “বাবা, জল!” রাফি হাসল। “দেখলি, মা শুনেছে।” তানিয়া ফিরে এল। “আবাদ হবে। আমরা বাঁচব।” রাফি ভাবল, আকাল এলেও তার রিমি আছে। মাটি আছে। আশা আছে।
শকুন উড়ে গেল। জমিতে জলের গন্ধ। রাফি বলল, “এই মাটি আমার জননী।”
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করা অসম্ভব: ইসরায়েল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ১:২০




ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করা অসম্ভব। এটি করতে পারে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই এটি করা সম্ভব- এমনটা জানালেন ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লিটার।

সোমবার ( ১৬ জুন) মেরিট... ...বাকিটুকু পড়ুন

somewherein blog টিম এর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ২:৫৪


ব্লগ ব্যবহারের শর্তাবলী ২খ. যেকোন ধরণের মন্তব্য, যার মর্মার্থ আমাদের কাছে গঠনমূলক না হয়ে সংঘাতপ্রয়াসী / উস্কানীমূলক অথবা সমালোচনামূলক না হয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে হলে তা নীতিমালা অনুযায়ী সরিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ট্যাবলেট খেলেই নির্মূল হবে রক্তের ক্যানসার? নতুন ওষুধ আসছে দেশে, দাম কত?

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই জুন, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৬





ট্যাবলেট খেলেই আর ক্যানসার ছড়াবে না? রক্তের ক্যানসার নির্মূল করতে নতুন ওষুধ আসতে চলেছে দেশে। গ্লেনমার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধটি বানিয়েছে। আমেরিকার এই ওষুধ নির্মাতা সংস্থার ওয়ার্কশপ রয়েছে ভারতেও।... ...বাকিটুকু পড়ুন

খোমেনীর স্বৈরশাসনের সূচনা: ধর্মীয় বিপ্লব থেকে রক্তাক্ত দমন

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৭ ই জুন, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮

খোমেনীর স্বৈরসাশন ও ইরানের কালো ইতিহাস:
============================

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে যে 'ধর্মনির্ভর রাষ্ট্রশাসন' প্রতিষ্ঠিত হয়, তার মূল স্থপতি ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নামে তিনি দেশটিকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সংরক্ষিত নারী আসন: সংস্কারের নামে চাপিয়ে দেওয়া, না কি গোপন এজেন্ডার বাস্তবায়ন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৭ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৪৭


বাংলাদেশে সংস্কারের নামে আজ যে কাণ্ড চলছে, তা দেখে পুরনো প্রবাদটি মনে পড়ে—"অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।" একটি ইন্টেরিম সরকার, যাদের চেয়ারে বসা একটি জটিল ক্ষমতার সমীকরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×