বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংস্কারের প্রস্তাবনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যখন দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবনা
১. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা: বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রস্তাবনা আসে বিএনপির পক্ষ থেকে। ২০১৬ সালে প্রণীত “ভিশন ২০৩০”-এর ষষ্ঠ দফায় এই ধারণাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে তারেক রহমানের ঘোষিত ২৭ দফা এবং ২০২৩ সালের ৩১ দফায় এটি আরও গুরুত্ব পায়। এই প্রস্তাবনার মূল লক্ষ্য ছিল সংসদে একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পেশাজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত করা।
২. প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বকালের সীমা: বিএনপি তাদের ৩১ দফার পঞ্চম দফায় প্রস্তাব করে যে, কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এই প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে আসে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগ উঠছিল। বিএনপির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ছিল গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার একটি উদার প্রচেষ্টা।
৩. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস: ২০১৬ সালের ভিশন ২০৩০ থেকে শুরু করে ৩১ দফা পর্যন্ত, বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতার বিরোধিতা করে এসেছে। তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে সংসদীয় কমিটির ভূমিকা এবং বিষয়ভিত্তিক সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা “চেক্স অ্যান্ড ব্যালেন্সেস” প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় প্রশ্ন ও বিশ্লেষণ
১. বিএনপির বিরুদ্ধে সংস্কারবিরোধী অপপ্রচার: যদিও বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছে, তবুও একটি ধারণা প্রচার করা হচ্ছে যে তারা সংস্কার চায় না। এর পেছনে সম্ভাব্য কারণ হতে পারে জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, যা জনগণের ভোটাধিকারকে বিলম্বিত করছে। বিএনপি যখন ২০২৩ সালে ৩১ দফার মতো বিস্তৃত সংস্কার পরিকল্পনা দেয়, তখন এই অপপ্রচার কি অজ্ঞতা, না অপরাজনীতির ফসল—তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন।
২. দ্বিকক্ষে আসন অনুপাতের যৌক্তিকতা: বিএনপি উচ্চকক্ষে নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছে। এর পেছনে যুক্তি হলো, জনগণের কাছে বোধগম্য ও প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থা পরিপক্ক হলে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন প্রক্রিয়া বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩. আওয়ামী লীগের বিচারে বিএনপির অবস্থান: ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ও গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল হিসেবে বিএনপি বারবার বলে আসছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হতে হবে। তবে গত সাত মাসে এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাব রহস্যজনক। বিএনপি মনে করে, এই বিচার প্রক্রিয়া টেকসই ও মানদণ্ড মেনে হওয়া উচিত।
৪. সংস্কারে বিএনপির অবস্থান: বিএনপি বাস্তবসম্মত ও টেকসই সংস্কারের পক্ষে। তারা বিশ্বাস করে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের বিজয় অনিবার্য এবং সংস্কার বাস্তবায়নে তাদের দায়বদ্ধতা অটুট থাকবে। এই ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের সৌন্দর্যেরই অংশ
৫. সংস্কার ও নির্বাচনের সম্পর্ক: গণতন্ত্রে সংস্কার ও নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন সংস্কার গ্রহণযোগ্য। বিএনপি মনে করে, সংস্কারকে নির্বাচনের বিরোধী হিসেবে না দেখে, নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পথ খোলা উচিত।