somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম‍্য রচনা: পায়জামা

২৩ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাশভারী খগেনবাবু রবিবারের এক সকালে তাঁর বাড়ীর একতলার সামনের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ নাকের ভিতরটা কেমন যেন সুড়সুড় করে উঠল। অমনি__"হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁছোওওওও" করে একখানা পেল্লায় হাঁচি ঝাড়লেন। শব্দটা কত ডেসিবেলের ছিল বলা শক্ত, কিন্তু বারান্দার সিলিংএ শব্দটা ধাক্কা খেয়ে একটা ধাতব অনুরণন সৃষ্টি করল যেটা খগেনবাবুর নিজের কানেও অনেকক্ষণ ধরে বাজতে লাগল। এই বিস্ফোরণের একটা সুদুরপ্রসারী ফল হল।

ওঁর পায়ের কাছে মেয়ের পোষা বেড়াল ডিম্পি নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিল। পরমাণু বোমা ফেটেছে ভেবে সে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাল। খগেনবাবুর বৃদ্ধা মা তাঁর গোপাল ঠাকুরের নৈবেদ্যের জন্য পিতলের বাসনকোসন মেজে রোদ্দুরে রেখেছিলেন – ডিম্পি প্রাণ ভয়ে পালাতে গিয়ে সেগুলো ছত্রাকার করে দিল। বৃদ্ধা রেগে কাঁই- “অ্যাই দ্যাকো দ্যাকো, হতভাগাটা কি কল্লে গো!!! হারামজাদা বেড়ালটা মরে না ক্যানো......দিল আমার গোপালের সব্বোনাশ করে”!

ওদিকে গিন্নী ডালের বাটি সাঁড়াশি দিয়ে ধরে আনছিলেন- এমন সময় অমন বিদঘুটে আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়ে হাত ফসকে গেল। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ডালের বাটিটা কক্ষচ্যূত উপগ্রহের মতো মাটি ছুঁল ঝনঝন শব্দে।
“মা কি হয়েছে”___ বলে মেয়ে শ্যামলি দৌড়ে খাবার ঘরে আসতে গেল। ঘরের মেঝেটা ততক্ষণে ডাল হ্রদে পরিণত হয়েছে! শ্যামলি ডাল হ্রদে স্কি করবার স্টাইলে ‘সাঁইইইই’___করে হড়কে যেতে যেতে একহাতে ফ্রিজের হাতলটা ধরে ফেলল।

ফ্রিজে যেন একটা ভূকম্পনের মতো ভাইব্রেশন হল, দরজাটা অমনি ‘চিচিং ফাঁক’! গোটা আষ্টেক ডিম কম্পনের প্রভাবে মেঝেতে পড়ে পটাপট ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সেদ্ধ ডাল এবং কাঁচা ডিম মিলে একটা অদ্ভুত রান্নার সৃষ্টি হল।

আরও একটা ভয়ংকর ব্যাপার ওদিকে ঘটে গেছে ততক্ষণে। হাঁচি, বাসনের ঝনঝন, চিৎকার___একটা অদ্ভুত শব্দব্রহ্ম রচনা হয়েছিল। পাশেই সেনবাবুদের বাড়ী। বিগত বিশ বছরে এমন হাঁচির শব্দ তারা শোনেননি। তার ওপরে এখন আবার করোনাপক্ষ চলছে!
সেনবাবুরা ধপাধপ খগেনবাবুর বাড়ীর দিকের জানলাগুলো বন্ধ করে দিলেন – বলা তো যায় না জীবাণু কোনদিক থেকে কীভাবে আক্রমণ করবে!

ডানদিকের মুখুজ্জেদের বাড়ীর ছোট ছেলেটা ভারী খচ্চর। আওয়াজ শুনেই তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেছে। তৎক্ষণাৎ করোনা হেল্পলাইনে ফোন করে বসেছে।

খগেনবাবু নির্বিকার। খবরের কাগজের চারের পাতার সম্পাদকীয় পড়ছেন মন দিয়ে। বাড়ির ভিতরে তখন মেয়ে আর গিন্নীতে মিলে খাবার ঘরের মেঝে পরিষ্কার করছে, বৃদ্ধা মা গোপালের বাসন নতুন করে গঙ্গাজলে শুদ্ধ করছেন। আর পাশের সেনবাবু আর মুখুজ্জে বাবুরা উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছেন খগেনবাবু কাশছেন কিনা।

খানিকক্ষন বাদে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে সামনের রাস্তায় দাঁড়াল। সঙ্গে পুলিশ। সাদা মহাকাশচারীর পোশাক পরা দুজন এসে জিজ্ঞেস করে খগেনবাবুকে___‘এই বাড়িতে কার সর্দিজ্বর হয়েছে?’

আকাশ থেকে পড়েন খগেনবাবু___‘অ্যাঁ সেকী! কই, সেরকম তো কারও কিছু হয় নি। আপনারা?’

‘আমরা স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে আসছি। এটা পনের নম্বর বাড়ি তো?'
- লোকটা যাচাই করে।

‘নম্বর ঠিকই বটে, কিন্তু সেরকম কিছু তো হয় নি কারো’-খগেনবাবু ঘাড় নাড়েন।

লোকটা বলে- ‘আপনার বাড়ীর নম্বর দিয়ে ফোন গেছে আমাদের কাছে। কই উঠে আসুন তো, দেখি আপনার টেম্পারেচারটা কত আছে।’___মহাকাশচারী লোকটা একটা সাদা প্লাস্টিকের পিস্তলের মতো জিনিস বাগিয়ে ধরে খগেনবাবুর দিকে।

ওদিকে মুখুজ্জে বাবুর চ্যাংড়া ছোট ছেলেটা ওদের বারান্দা থেকে উঁকি মেরে মজা দেখছে।
খগেনবাবু ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে অনুভব করলেন পায়জামাটা কেমন যেন আলগা হয়ে খ’সে পড়ছে। কি সর্বনাশ!___সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে প্রাণপনে সেটা জাপটে ধরে লজ্জা নিবারণ করলেন। মনে পড়ল হাঁচির সময় কোমরের কাছ থেকে একটা ‘খ্যাচ’ করে মৃদু শব্দ হয়েছিল বটে। অর্থাৎ পায়জামার ফিতেটা তখনই ভিতরে ভিতরে রিটায়ার করেছিল- হায় হায়, বুঝতে পারেননি তিনি।

মহাকাশচারী লোকটা হাতে যন্ত্রের ছোট্ট ইলেকট্রনিক স্ক্রিনটা দেখে বলে____‘না, আপনার দেখছি নর্ম্যালই আছে- সাড়ে পঁচানব্বই। বাড়ীতে আর কারও কিছু হয়নি তো?’

আমাদের কারও কিছুই হয়নি এখনও। কিন্তু আপনাদের তো আমি ডাকিনি’-

অমনি মুখুজ্জেদের ছোট ছেলেটা চেঁচিয়ে লোকটাকে বলে__ ‘আরে দাদা, উনি অসুস্থ। ওঁর শরীর খারাপ আছে। একটু আগেই এমন জোরে হাঁচলেন যে গোটা পাড়ায় সবাই চমকে গেছি’!

‘অ্যাঁ, সেকী? ওভাবে হাঁচবেন না। আর হ্যাঁ, আপনার মাস্ক কোথায়? মাস্ক পরাটা এখন আইন হয়ে গেছে জানেন না?’
___মহাকাশচারী একটু যেন গরম দেখায়।

খগেনবাবু দুহাতে পায়জামা সামলাতে সামলাতে রেগে যান____‘হ্যাঁ মানছি যে হাঁচিটা একটু না হয় জোরেই হয়ে গেছে। তা আপনি কি হাঁচবার নিয়ম শেখাচ্ছেন আমায়? আর বাড়ীর মধ্যে মাস্ক কেন পরব শুনি? ওটা তো বাইরে গেলে লাগে। আর আমি বাড়ির মধ্যে হেঁচেছি, বারান্দাটা বাড়ির সীমানার মধ্যেই। এবং বেশ করেছি। আমায় আইন শেখাতে আসবেন না। নেমপ্লেটটা পড়ে নিন দরকার হলে’।

পুলিশ এবং মহাকাশচারীর দল নেমপ্লেটের দিকে নজর দেয় – “খগেন্দ্রনাথ খাসনবিশ, এল-এল-এম, বার-অ্যাট-ল’, রিটায়ার্ড জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’। কথা না বাড়িয়ে পুলিশটা হেসে বলে____ ‘আচ্ছা স্যার, ঠিক আছে ঠিক আছে। যাই হোক সাবধানে থাকুন। বয়েস হচ্ছে তো!”

দলবল ফিরে গেল। এতক্ষণ বারান্দার দরজার পর্দার আড়ালে খগেনবাবুর গোটা পরিবার নাটক দেখছিল। মেয়ে, গিন্নী, বৃদ্ধা মা সকলেই হাজির।
পায়জামা সামলে ভিতরে আসেন খগেনবাবু। এমন হম্বিতম্বি শুরু করলেন যেন আকবর রাজপুতানা জয় করে ফিরলেন।
বাজখাঁই গলায় গিন্নীকে বলেন____‘ছি ছি, এতোগুলো বাইরের লোকের সামনে অপদস্থ হতে হল আজ। এই পায়জামার ছিরি আমার! একটা ফিতেও ঠিকঠাক পরাতে পারোনি এতে?”
বাবার অবস্থা দেখে মেয়ে আর তার বুড়ি ঠাকুমা হাসতে থাকে।
গিন্নীও গরম হয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন____‘তা, ছিঁড়ল কীভাবে শুনি? কতবার বলেছি আস্তে হাঁচো। তা নয়। বাবু পাড়াশুদ্ধু লোককে চমকে দিয়ে হাঁচবেন। বেশ হয়েছে পায়জামার দড়ি ছিঁড়েছে! আর পায়জামারই বা দোষ কি? ওটা তো আর তোমার বউ নয় যে আজন্ম সার্ভিস দেবে- বিশ বছরের পুরনো পায়জামা। মনে নেই? নব্বই সালে যেবার আমরা রাজস্থান গেলাম তখন কিনেছিলে। তার পরে তো আর কোনদিন পায়জামা কেনোনি। বরাবর জামাইষষ্ঠীতে আমার বাবা একটা করে তোমায় পায়জামা আর পাঞ্জাবি দিয়ে গেছেন। কিপটেমি করেই তো জীবনটা কাটালে। বলি টাকাগুলো নিয়ে করবেটা কি? এবার এই পায়জামাটা দাও, ঘর মোছার কাজে লাগবে আমার’।

পয়সার অভাব খগেনবাবুর কোনকালেই ছিল না। কিন্তু তিনি কৃপন নন এমন অপবাদ তাঁর শত্রুও দেবে না। মনটা ওঁর খারাপ হয়ে যায়- এতোদিনের সঙ্গী পায়জামাটা আজ চলে গেল। গেঞ্জীটার দিকে তাকান – আহা রে। ওটারও বয়স নেহাত কম হল না। অনেকগুলি জানালা হয়েছে গেঞ্জীটায়। সাবধানে গেঞ্জী সামলে খগেনবাবু ফের কাগজ নিয়ে বসেন।
হঠাৎ পায়ে সুড়সুড়ি লাগে। তাকিয়ে দেখেন ডিম্পি আদর করে পায়ে তার মুখটা ঘষছে। ওঁর দিকে চেয়ে বলে – মিয়াঁও।
মনে একটু ভরসা পেলেন খগেনবাবু।



বিঃদ্রঃ স্ব-রচিত নয়। মূল খেলাটা সুদীপ্ত গঙ্গোপাধ্যায় খেলেছেন; অধম এখানে ক‍্যামেরাম‍্যান। ক'দিন আগে সাহিত্য বিষয়ক একটা গ্রুপে পড়েছিলাম। পায়জামার ভেন্টিলেশনের মতো অসম্ভব আরাম অনুভূত হল। "মিঠা জিনিস শেয়ার করলে নাকি আরো মিঠা হয়ে যায়"___রসনার সেই বাসনা থেকেই সামুর প্লেটে বেড়েছি।

ছবিতে বাংলা ছিনেমায় কমেডির প্রবাদ পুরুষ তুলসী চক্রবর্তী। কমেডি নিয়ে কথা হবে আর "সাড়ে চুয়াত্তর" আসবে না__তা হয় কী করে!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৪৪
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×