কিছুদিন আগে অর্থনৈতিক সমিতি উদ্দোগ্যে আওয়ামী লীগ পন্থী সুশীল সমাজের একাংশ বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে জনগনের সামনে তুলে ধরবার চেষ্ঠা করেছেন। তাদের চিন্তার প্রশ্নবিদ্ধ অংশগুলোকে নিয়ে ভাববার প্রয়োজন থেকেই এই লেখাটি লিখছি।
বাংলাদেশের বিগত পাঁচ বছরের সার্বিক আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারন হিসেবে শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রনালয়ের আমলা বা মন্ত্রীদেরকেই দায়ী করা খুব সহজ হলেও, এর পেছনে যাদের ব্রেইন স্ট্রর্মকে বাদ দিয়ে আগানো যায় না তাদের আরেকটি অংশের প্রতিনিধি এই অর্থনৈতিক সমিতির কর্তাব্যক্তিগন। যাদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ড আবুল বারাকাত, ড কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ প্রমুখরা। এই সমিতির প্রায়ই সবাই রাষ্ট্রায়াত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড এবং পলিসি নির্ধারনের পিছনে জড়িত। পাশাপাশি দলীয় আনুগত্যকে মাথায় রেখেই এই পলিসি নির্ধারন করে থাকেন তারা। শুধু তাই নয় আপন শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন বলে তাদের চিন্তা মননের মূল্য অনেক, কারন তার ভিত্তিতেই সমাজে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনে সরকারও বাধ্য হন।
তবে এখানে সেই চিন্তা বা মননের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে কথা বলবার অভিরুচি আমার ব্যক্তিগতভাবে নেই। কিন্তু সেই চিন্তা বা মননের সাথে অব্যবস্থাপনার সম্পর্ককে যদি বিশ্লেষন করি তাহলে সত্যিকার অর্থে সাধারন জনগনই উপকৃত হবেন। কি ঘটেছে বিগত বছরগুলোতে আমাদের রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোতে। কর্তাব্যক্তি হিসেবে আসীন এই সব সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধায়নে কেন এই ঘটনাগুলো ঘটল? এর দায় কি সাধারন জনগনের নাকি এই অসাধারন ব্যক্তি বিশেষের?
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, তারল্য সংকট, অর্থ কেলেংকারী, বিনিয়োগ করতে অনিচ্ছুক হওয়ার মত ঘটনা ঘটার পরেও কোন ব্যবস্থাপনার পেছনে চিন্তার মানকে আন্তর্জাতিক বলবার দুঃসাহস আমার নেই। সেই দুঃসাহস দেখাবার ধৃষ্ঠতা শুধুমাত্র বিবেকহীন কুপমুন্ডুকের পক্ষেই সম্ভব বলেই মনে করি। সমাজের যারা খুব ছোট ব্যবসা করে জীবিকা নির্ধারন করেন, তাদের ব্যবসায়িক চিন্তা এবং সততার সাথে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমাদের সকলের এক ধরনের যোগাযোগ ঘটে। তাদের যোগ্যতাকে অনেক সময়ই আমরা মূল্য দিতে পারি সেটা বলব না। তবে তাদের সাথে সমাজের ওপরে ব্যবসায়িক শ্রেনীর এক ধরনের তুলনামুলক বিশ্লেষন আমাদের সবারই থাকা উচিত। কারন তাহলেই আমরা বুঝতে পারব যে, সততা আর মূল্যবোধের মত নীতি যাদের মাঝে কাজ করে না তারা কোন চিন্তার আর্শীবাদে হতে পারেন কোটি টাকার মালিক, কাদের চিন্তার আর কাজের কল্যানে এরা অধিপতির আসন নেন সমাজে।
অর্থনীতি আর রাজনীতি সম্পর্ক সরলরৈখিক না হলেও অর্থনীতিতে গুমট পরিস্থিতি রাজনীতিকেও গুমট করে। এর ব্যতিক্রম কোথাও পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি বিবাদমান পক্ষের অর্থনীতির আকাঙ্খার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। তাই গুমোট রাজনীতির এই পরিস্থিতিকে বারবার মঞ্চায়িত হতে দেখব এবং দেখছি আমরা। কে কিভাবে কোন মতাদর্শের ফেনা তুলে একে মোকাবেলা করবার প্রয়াস চালাবেন তা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। তবে একটি পদ্ধতিগত মিলের দিক হল বিদ্যমান রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট চরিত্র দানের ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের একাধিপত্য তৈরীর আইনী এবং রাজনৈতিক দিক দুই আছে। রাষ্ট্র যেহেতু শ্রেনী আধিপত্য এবং সেই শ্রেনীর শোষনের হাতিয়ার, তাই শ্রেনীর রাজনীতি আর তাকে পুর্নমাত্রায় আইনী রুপ দেবার সব প্রচেষ্ঠাই বিদ্যামান থাকে শ্রেনী কর্তাদের।
এখানে যেহেতু আর্থিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার চেষ্ঠা করব সেক্ষেত্রে রাজনীতি কিছু বিষয়ও উঠে আসবে। বিগত পাঁচ বছরকে নমুনা হিসেবে নিতে চাই, তবে সাধারনভাবে শ্রেনী আলোচনার সুবিধার কারনে পূর্ববর্তী সময়ের অনেক ঘটনার সাথে বা তার পুনরাবৃত্তির সাথে এই বিষয়গুলোকে একসাথে পাঠের সুবিধা বজায় থাকবে বোধ করি।
পুঁজিবাজারে এক ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে গেছে বাংলাদেশে। ত্রিশ লক্ষেরও বেশী মানুষ তাদের আর্থিক ক্ষতি এখনও পুষিয়ে নিতে পারেন নি। রাস্তায় আন্দোলন করেছেন, সরকারী কর্তাব্যক্তিদের অপমানের স্বীকার হয়েছেন। অনেকে সহায় সম্বলহীন হয়ে আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছে। শেয়ারবাজার কেন্দ্রিক আন্দোলন! পৃথিবীর নজর কেড়েছ। অর্থমন্ত্রী এবং তার অধীন মন্ত্রনালয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদেরকে ফাটকাবাজ বলেছেন, সত্যিই তো বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা ফাটকাবাজদেরই জায়গা। নাহলে লক্ষাধিক মানুষের বিনিয়োগকে লোপাট করা যায় কিভাবে? অতি মুনাফা লোভ তাড়িত মানুষদের ভিড় থেকে শুধুমাত্র চোজেন ফিউ কিভাবে বিপুল অংকের পাহাড় গড়ে। এই রহস্যের কিছুটা হলেও ইব্রাহীম খালেদের রিপোর্টে এসেছিল। যার কারনে আলোর মুখ দেখেনি এই রিপোর্ট। ইব্রাহীম খালেদও সরকারের উপরের মহলের বিরাগভাজন হয়েছেন কিছুটা। কিন্তু প্রশ্ন হল এর কারনে কি কোন মামলা হয়ে বা এই কেলেংকারীর সাথে জড়িতদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে? না কারও কেশ স্পর্শ করবার মত কাজ করেনি বর্তমান সরকার। এই বিষয়কে আড়াল করবার শত চেষ্ঠা করা হয়েছে। উপরন্তু ভিকটিমদেরকেই অপরাধী বলবার চেষ্ঠা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের কাছে থেকে। এরপক্ষে লুটপাটের যে চিন্তা চেতনাধারীরা আছেন তারা দাড়িয়েছেন। এটাকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার এক অদ্ভুদ নজীর বলা যেতে পারে, যার পক্ষে না দাড়ালে নিশ্চয়ই বিরাগভাজন হতে হবে।
রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের নাম বিশেষভাবে সাধারন মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। কারন এখানে সরকারী দলীয় লোকজনের যোগসাজশে ব্যাপক আর্থিক কেলেংকারী ঘটেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পেয়েছেন সরকারের বিশেষ মহলের সাথে যাদের ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়ীক নানাবিধ সম্পর্ক আছে তারা। আর এই ব্যবস্থাপনাকে সফলভাবে প্রয়োগের জন্য ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিষদে সরকারের স্নেহধন্য অনেক ব্যক্তিত্ব। এটাকে স্বত্বসিদ্ধ করতে আরো অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে এসেছেন। দুদকের ভুমিকার কথাই বলতে হচ্ছে। তাদের প্রমান করতে খুব বেশী দেরী হয়নি যে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিশেষ রাজনৈতিক দলের এই লোকগুলো এই ঘটনা ঘটবার সময় শুধু নিশ্চুপই ছিলেন না,তাদের ব্যবস্থাপনারও কোন দায় নেই।
জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এর বাইরে কিছু ঘটেছে বলে জানা নেই। আবুল বারাকাতের পারফর্মেন্স দিয়ে এই ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি যদি বিচার করি তাহলে অকপটে কিছু তথ্যের ক্ষেত্রে আমাদের নজর দিতে হবে। শত কোটি টাকা লোপাটের ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের ভোল্ট যেন খুলে রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ী নামক কিছু লোক শতকোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের কর্মকর্তারা খুঁজে পাচ্ছেন না তাদেরকে। রাজনৈতিক সুবিধার কারনে বেড়েছে নন পারফর্মিং লোনের পরিমান। খেলাপী ঋন গ্রহিতার সংখ্যা বেড়েছে সমানুপাতিক হারে। এছাড়াও বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও রানকা সোহেল কম্পোজিট মিলের জনতা ব্যাংক লুটের কথা সবার জানা বিষয়। শুধু তাই নয় অতিমাত্রায় আলোচিত হলমার্ক কেলেংকারীর পাশে জনতা ব্যাংক নিজের নাম লিখিয়েছে ভিকটিম হিসেবে। ব্যাংক হিসেবে মুনাফা করা তো দুরের কথা লোকসানে চলছে রাষ্ট্রায়াত্ত এই ব্যাংকটি। সর্বশেষ রিপোর্টে যেটা দেখা যায় যে, জনতা ব্যাংকের খেলাপী ঋন বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা এবং যা ব্যাংকটির মোট ঋন বিতরনের ১৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মুলধন ঘাটতির পরিমান ১হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
এ ধরনের অব্যবস্থাপনাকে উন্নয়ন বলে নাচতে বলছেন আমাদের অর্থনীতির এই বিশেষজ্ঞ সুশীলেরা। তা তা ধেই ধেই করে আওয়ামী পান্ডাদের নাচনে পুলকিত নই সচেতন জনগন হিসেবে আমরা কেউই। এই অর্থনীতিবিদেরা বছর শেষে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে গল্প শুনাতে শুনাতে কান ঝালাপালা করে দেন, সেখানেও রয়ে যায় এই আর্থিক অব্যবস্থাপনার কীর্তিগুলোকে যথাসম্ভব ঢেকে রাখার প্রয়াস। পুঁজি আর শ্রমের দ্বন্দ্বের প্রশ্ন তো আনাই হয় না। এছাড়াও ব্যাংক লোনের পরিমান বাড়তে দিয়ে তাকে শোধাবার প্রশ্নটাকে রেখে দেয়া হয় সবার অগোচরে। ব্যাংক লোন নিয়ে পরিশোধের বালাই নাই কিন্তু তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটুকু হল তা নিয়ে লাফালাফি!
এই সুবিধাভোগী অর্থনীতিবিদেরা নিজেদেরকে কখনই নিজেদের সমালোচনার দর্পনে দেখতে অভ্যস্ত নন। শুধু তাই নয় গলাবাজী করে অন্যের মনে কি আছে। হাস্যকরই বটে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে নিজেদেরকে জাতির সামনে সাচ্চা দেশপ্রেমিক প্রমান করতে গিয়ে বিষেদাগার করলেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। সাথে ছিল আরো কিছু অধ্যাপকেরা। যাদেরকে সিলমারা দলকানা হিসেবেই চিনি আমরা। নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যত বানী করতে গিয়ে ৬০% লোকের উপস্থিতির কথাই ব্যক্ত করলেন এক সাবেক গভর্নর। নিজের চোখের সাথে বেঈমানী করা যায় কিন্তু জনগনের চোখে সাথে নয়। এধরনের সুবিধাভোগী আমলাদের ইন্দ্রীয়গুলো কাজ না করলেও সাধারন জনগনের ক্ষেত্রে তা হয় না।