কয়েকদিনের মাঝেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি আবারো উত্ত্বপ্ত হয়ে উঠছে এবং তা হতে বাধ্য। গনতন্ত্রহীনতা সাংবিধানিক সংকট আর দুর্নীতির ডামাডোলে অতিষ্ট জনগন বারুদ সদৃশ। কখন কোন ইস্যুতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে তা বলা কঠিন। তবে পরিকল্পনার বাইরে বা পরিকল্পনা মাফিক দুধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান। ভারসাম্য নির্ধারিত হবার সিদ্ধান্ত জনগনের অভিপ্রায়ের উপরই ন্যস্ত। একক ব্যক্তির হাতে সবকিছু নির্ধারিত হয় না, হলেও তা ক্ষনস্থায়ী।
ইসলাম ও জঙ্গীবাদ সমার্থক আকারে পাশ্চাত্যের ডিসকোর্সে আবারো নতুন যুদ্ধের ডামাডোল বাজাচ্ছে। একধরনের পারমানেন্ট স্টেট অব ওয়ারের মধ্যে পাশ্চাত্যের দেশগুলো আগে থেকে যেমন ছিল এখনও আবার নতুন করেই পুরোনো নাটকের শেষ দৃশ্যকেই যথাসম্ভব লম্বা করতে চাইছে। এই অবস্থা থেকে পাশ্চাত্যের ক্ষমতাসীন দেশগুলোর এলিট শ্রেনীর প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্টী বা সরকারগুলো আর বের হতে চায় না। এর অনেক আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারনও আছে।
কিন্তু এর ফলাফল বাংলাদেশের মত প্রান্তিক দেশে কি রকম প্রভাব ফেলবে তা একটা স্কেচ করার চেষ্টা করব। সম্প্রতি মিশরের তাহরীর স্কয়ারের ফলাফল কি দাঁড়িয়েছে তা আমরা সবাই জানি। গনতন্ত্রের, মুক্তির স্বপক্ষের মানুষকে কিভাবে ধোঁকা দিয়ে আবারো সামরিক শাসকের উত্থান ঘটানো হল তা এখনও নিকট অতীত। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মন্তব্য দিকে যারা খেয়াল করেছেন তারা মোটামুটি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন বিশ্ব পরিস্থিতির সাম্প্রতিক ঝোঁক আর গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে সময় নষ্ট করতে চায় না। এরদোগান জাতিসংঘের সম্মেলনে ফাত্তাহ আল সিসিকে স্বীকৃতি দেবার জন্য জাতিসংঘকে এবং এর নেতৃত্বকে সমালোচনা করেছেন। ফাত্তাহ আল সিসি তেলআবিবের গেম চেঞ্জারদের হাত ধরে আজ মিশরের ক্ষমতায়। এই সিসি সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে মিশরের গনতন্ত্রকামী জনগনের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালিয়ে নিজেকে স্বঘোষিত যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে দাবী করেছে। সেখানের নির্বাচনেও বিরোধীদল শুন্যতার কথা সকলেই জানি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ৫ই জানুয়ারীর হঠকারী এবং শঠতাপূর্ন নির্বাচন আর মিশরের সিসির ক্ষমতায় আসার যে নির্বাচন তা আলাদা করা যায় না। বাংলাদেশে যে ধরনের রাজনৈতিক বিভাজন আছে মিশরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। তবে সাম্রাজ্যবাদের কাছে মিশরের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের গুরুত্বের মাঝে তারতম্য আছে এটা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের দূতের মিশন ব্যর্থ হয়েছে, আমি তারানকোর কথা বলছি। কিন্তু জাতিসংঘের এই দুতওয়ালী কাজের পেছনে সত্যিকার উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন এটুকু করবার অভিপ্রায় তারা দেখিয়েছে আমাদের দলগুলোর ব্যাপারে তাতে এই দুদলই যে তাদের আস্থায় আছে তার বহিঃপ্রকাশ বলতে হবে। কিন্তু মিশরের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। সামরিক ক্যু’র পথেই হেটেছে সাম্রাজ্যবাদের দোশররা।
বাংলাদেশের তথাকথিত ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের পরে স্বীকৃতি আদায়ের সংকটে পড়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু তৎকালীন ভারত সরকারের পূর্ন সমর্থন এবং তাদের লবিস্ট পাওয়ারের কল্যানে আরো কিছু দেশের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশগুলোর বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ন হিসেবে বিবেচনা করে। এখনও তাদের অফিসিয়াল অবস্থান তাই রয়েছে। বৃটেনও এই নির্বাচনের পক্ষে কোন অফিসিয়াল স্বীকৃতি দেয় নি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রোপাগান্ডা ম্যাশিনগুলো একধরনের কাল্পনিক স্বীকৃতির কথা তাদের প্রচারমাধ্যমগুলোতে প্রচার করে। কিন্তু এই নৌকার এই পালে বেশীদিন হাওয়া স্থায়ী হয়নি। পরে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে স্বীকৃতি ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হয়।
যাই হোক নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি এবং সর্বদা ক্রিয়াশীল হীনমন্যতার কারনের কারো পাশে বসে ছবি অথবা রাষ্ট্রের ব্যাপারে কোন স্বীকৃতি ফলাও করে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহিরের মাঝে মানসিক দুর্বলতা আর নৈতিক ক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার থেকে বড় বিষয় হল রাজনীতিতে জনগনের সম্পৃক্ত হবার সু্যোগ সংকুচিত হওয়া, শুধু ভোটাধিকারের কথা নয়। যেকোন গুরুত্বপুর্ন ইস্যুতে গনজমায়েতই সরকারী স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে গন্য হওয়া। এর ফলে ডিসি অফিসে অথবা পুলিশ কমিশনারের স্বীকৃতি ব্যতীত জমায়েতের অধিকার হরন।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কোন দল নেই, বাংলাদেশে সে ধরনের রাজনীতিও যেমন গড়ে উঠেনি এবং রাজনৈতিক দলও গড়ে উঠেনি। তাই মেইন স্ট্রীম পার্টিগুলোর পক্ষে এখনও ব্যাপক জনগনকে সম্পৃক্ত করে কাজ করবার সামর্থ্য নেই। কিন্তু তাই বলে জনগন নিশ্চুপ কোন ভ্যারিয়েবল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দন্ডায়মান থাকে এটা ভাবার কোন কারন নেই। তাদের অভিপ্রায় নির্বাচন কেন্দ্রিক করেই তোলার চেষ্টা হয়েছে সংবিধানে। এর বাইরে কিছু অবাস্তব নিশ্চয়তা দান করা ছাড়া রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে জনগনকে সত্যিকার ক্ষমতা কেন্দ্রে স্থাপন করে নি। নির্বাচিত করার সুযোগ আছে কিন্তু সেই নির্বাচিতদের কাজের মাঝে দখলবাজি চালানোর অধিকার জনগনের নেই। প্রতিনিধিত্বমূলক গনতন্ত্রের অনেকগুলো ত্রুটির মাঝে এটা একটা অন্যতম ত্রুটি।
যার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ, রাষ্ট্র নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেনী রাজনীতিতে রাষ্ট্র সম্পর্কে এটা লেনিনের থিসিস। যা অবজেকটিভ বাস্তবতাও বটে। যদি দল না থাকে, ক্ষমতা না থাকে তাহলে জনগন শব্দটার বিমূর্ত ব্যবহারও বেড়ে যাবে। স্বৈরাচারও নিজেকে গনমানুষের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবী করবে। সেক্ষেত্রে জনগনের দিক থেকে রাজনৈতিক কৌশলই হবে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারনে জনগনের অবস্থান গৌন হচ্ছে, সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক অনাচার এবং অনাচারের আইনীভিত্তিমুলকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা। কোনদলকে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী করে আনা নয়। বরং ক্ষমতাসীন শ্রেনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন এবং তাদেরকে জনগনের ক্ষমতার অধীনস্থ করার প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়া। সাম্প্রতিক সময়ে হংকং এর ঘটনা দিকে তাই নজর ফেরাতে বলব। সেখানে কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে মানুষ জমায়েত হয় নি বরং সকল রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রতিষ্টিত ক্ষমতা কাঠামোর বিপরীতে জনগনের অবস্থান গ্রহন করতে হয়েছে। এতে হংকং এর ভবিষ্যৎ ইতিহাস নির্ধারিত হবে। জনগনের অধিকার প্রতিষ্টাও সুরক্ষিত হবে। তবে এটাও যে শেষ তা নয়। ইতিহাসের শেষ বলে কিছু নেই। ফুকয়ামার মতে ইতিহাস শেষ গনতন্ত্র বা পুঁজিবাদে কিন্তু জনগনের দিক থেকে ইতিহাস এক চলমান প্রক্রিয়া।
ইতিহাসের যে পর্বে আমরা বসবাস করছি সেখানে তাৎক্ষনিক সমস্যা সমাধানের টনিক কেউ দিতে পারবে না। তবে বিচ্ছিন্নতা বাড়াতে পারবে যা পরিশেষে ক্ষমতার অনাচারের অধীনস্থতার প্রক্রিয়াতে শেষ হবে। জনগনকে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা আবারো অর্জন করতে হবে। এটা শুধু ছোট বিষয়কে ঘিরে হতে হবে তা নয়। পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোকে বদলাতে চেষ্ঠা করতে হবে। কোন একক ব্যক্তির দায়িত্ব যেমন এটা নয়, তেমনি একক ব্যক্তিকে এই পাহাড়সম কর্তব্য পালনে বাধ্যও করা যাবে না। সেখানে জনগনের দিক থেকে প্রথম শত্রু তারাই যারা এই উপস্থিত ক্ষমতা কাঠামোর সুবিধাভোগী।
এই সুবিধাভোগীদের মাঝেও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল সংবিধান পরিবর্তনের অভিপ্রায় আছে, কিন্তু তা নিজেদের স্বার্থবিরোধী বা যে সংবিধানে তারা নিজেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে পারবে না সে ধরনের সংবিধান প্রবর্তনের আকাঙ্খা নেই। তাই বর্তমান সংবিধানের অগনতান্ত্রিকতার দিকগুলোকে যেমন ছুড়ে ফেলতে হবে তেমনি জনগনের ক্ষমতার সত্যিকার দলিল হিসেবে গনতান্ত্রিক সংবিধানের প্রবর্তন নিশ্চিত করাও জনগনের দায়িত্ব, শুধুমাত্র কোন দলকে ক্ষমতা আনাই এখনকার জরুরী কর্তব্য নয়।
এই প্রক্রিয়ার দীর্ঘসুত্রিতাকে কমাতে হলে হংকং বা মিশরের তাহরীর স্কোয়ার থেকে আমাদের শিখবার এবং পালন করবার অনেক কিছুই আছে, অন্যথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তাই হবে যা আমরা নিজেদের জন্যও নির্ধারন করতে চাইব না। ( প্রথম কিস্তি)