somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষমতা

২৯ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজ অনেকদিন পর বেরোল হাশিম। আকাশের সূর্য আর কিছু সময় পেরিয়ে মধ্যভাগে উঠে যাবে। সেই রাস্তা, শপিংমল, বিবিধ দোকানপাট, নৈর্ঋত কোনের উঁচু পান-সিগারেটের টং প্রায় একইরকম আছে। একটু যা এদিক-ওদিক। বাহাদুরবাজার মোড়ের পুব-দক্ষিণ কোনায় মিষ্টির দোকান আর রেস্তোরাঁ। আজও জয়ন্ত ঘোষ বসে আছে। টাইটফিটিং সার্ট। বুকের উপরে বোতাম দুটি খোলা আগের মতোই। কুচকুচে কালো ভূঁড়ির অনেকখানি বেরিয়ে আছে। লুঙ্গির এখানে-ওখানে চিটচিটে ময়লা দাগ। চেহারায় নির্বিকার দৃষ্টি। হাশিম দূর থেকে সব দেখে নেয়। সেই আগে যেমন দু-চোখ চারিদিক ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তার পশ্চিমে দাঁড়ায়। পেছনে বিশাল কসমেটিক্সের দোকান থেকে মন-মাতাল সুবাস বাতাসে মিশে যায়। কোনোদিন বিহারি আযম পুবদিকের ফুটপাতে বসে। একটি কড়াইয়ে জ্বলে কয়লার আগুন। ভুট্টা পোড়ানো হয়। হাশিম সব দেখে রাখে। তখন তার আঙুলের ফাঁকে গোল্ডলিফ জ্বলত। আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি নেচে বেড়াত। তারপর ধীরপায়ে হেঁটে যাওয়া। কাজ আছে। এখন কোনো কাজ নেই। আজ অন্য দিন। পুরোনো অনেক অভ্যেস মুছে গেছে। এখন ঠোঁটে সিগারেট নেই। চোখের কোনায় নেই সেই দিনকাল। সবকিছু তবু মনে পড়ে। ছায়াছবির মতো কত দৃশ্য কত ঘটনা। সত্যি কি মুছে ফেলা যায়? মন শুধু কেমন কেমন করে।
অনেকদিন, দিন নয়...মাস, প্রায় ছয়-সাত মাস পর রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। অবশেষে বাধ্য হলো। অনেক তো দিন পেরিয়ে গেল, আর কেন বসে বসে ভাত গেলা? ভাতের অনেক দাম। মায়ের বুকের দুধের চাইতেও। আহা মা আজ তিন মাস হয় চলে গেছে! মা মরার শোক চোদ্দো বছর। বাবার যাওয়ার কত বছর হলো? হাশিমের যে জনম জনম চলে যায়। কয়েক বছরেই জীবন-অস্তিত্ব আর বেঁচে থাকার তেপান্তর সীমানা কাছে এসে গেল। আহা সেই সত্য হোক! সে একবার ডানে তারপর বাঁয়ে তাকিয়ে রাস্তার মধ্যখানে এসে দাঁড়ায়। কুরিয়ার সার্ভিসের বিশাল গাড়ি চারপাশ অন্ধকার করে দক্ষিণে এগিয়ে যায়। হাশিমের দু-চোখে আচমকা অদ্ভুত আঁধার। কয়েকটি চেহারা। মানুষের মুখছবি কত কথা বলে। সকল কথা? কথা নয় বাক্যবান। সে একটা সময় ছিল বটে। অনেক ক্ষমতা অনেক দাপট। কোথায় গেল? হাশিম ছোট এক শ্বাস নিয়ে সামনে এগোয়। সময় এগিয়ে যায়। মন পেছনের দিনকালে পড়ে থাকে। হায় মন...পোড়া মন!
‘কি রে হাশিম, কেমন আছিস?’
কোনো এক ছায়া পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে বসে। সেই স্বরধ্বনি আন্তরিক-অকৃত্রিম কিংবা কৌতূহল-শ্লেষ কিছু বুঝতে পারে না হাশিম। অথবা অনেককিছু জানিয়ে যায়। সে একপলক দৃষ্টি তুলে ধরে। মুন্না। তার দু-বছরের জুনিয়র। পার্টির মিটিং-এ, মিটিং-এর বাইরে কোনোদিন ‘বস’ অথবা ‘স্যার’ ছাড়া কথা বলেনি; আজ কত সহজে ‘তুই-তোকারি’ করে গেল।
বাজারে প্রবেশমুখের সবকয়টি গলির সামনে আবর্জনা জমে আছে। নর্দমার ময়লা, বাজারের ভেতরের বর্জ্য, হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলের রক্ত আর ব্রয়লারের বিষ্ঠা; দুর্গন্ধে বমি আসে। হাশিম আগের মতো এক ঝটকায় ডানহাত নাকের কাছে আনতে গিয়ে থমকে পড়ে। চোখদুটো কি অকারণ ঝাপসা হয়ে ওঠে? কে জানে...হয়তো অথবা তেমন নয়। সব তার দোষ...কপালের ফের।

উনিশ শ সাতাশি। বছরের শেষদিকে আকস্মিক বন্যা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, অথচ তেমন বৃষ্টি-বজ্রপাত নেই। কোনোদিন দিনভর ঝিরঝির ঝরছে এই যা। ওতেই শোনা গেল বন্যা। দেশের এখানে-ওখানে বানের পানিতে বাঁধ ভেঙে গেছে। মানুষজনের ঘরদোর ভেসে যায়। তারা আশ্রয় নেয় বাঁধে। সেই বাঁধ ভেসে যায়। জেলা প্রশাসন বিপন্ন মানুষের জন্য আশ্রয় শিবির খুলে ত্রাণ-পুনর্বাসন কাজ শুরু করে। সকল আলোচনার কেন্দ্র, কেউ এমন বন্যা দেখেনি। বৃষ্টি শুধু নয়, ভারত ফারাক্কার গেইট খুলে দিয়েছে; যোগ হয়েছে পাহাড়ি ঢল। হাশিম তখন কী করে? শহরের সবচেয়ে দুর্বল স্কুলের ফোর-ফাইভের ছাত্র। বড়ভাই ঢাকায় চাকরি করে। বাড়িতে বাবা-মা, ছোটবোন আর সে। মোট চারজন মানুষ। লিলিমোড়ের বেশ খানিকটা দূর দক্ষিণে ছোট একটি টেইলরিং দোকান। নিজেদের দোকান নয়, পপুলার ক্লথ স্টোরের মালিক দয়া করে বারান্দায় বসতে দিয়েছে। বাদশা মিয়া সেখানে পুরোনো একটি মেরিট মেশিন নিয়ে সারাদিন কাজ করে। খট-খটা-খট শব্দে সেলাই হয়। বেডশিট-মশারি-লুঙ্গি আর ছোটখাটো কাজ। হাশিম জানে, বাবা অনেক রাতে ঘরে ফেরে। কোনোদিন চোখে-মুখে ক্লান্তি অথবা হা-হুতাশের খেদ নেই। সকলের তিনবেলা ডালভাত একরকম জুটে যায়। কোনো মাসে বড়ভাই দুই-তিনশ টাকা মনিঅর্ডার করে। দিনকাল মন্দ ছিল না।
বন্যায় অনেক মহল্লা ডুবে গেল। কাঞ্চন কলোনির আশপাশ থেকে পানি চলে এলো হঠাৎপাড়া। সেই পানি আর নামে না। মানুষজন হাঁটু পানি মাড়িয়ে চলাচল করে। সেখানে রাস্তার দক্ষিণপ্রান্তে তিনখানা ঘর। একটি টিউবওয়েল সীমানা সংকেত। কামরাঙা গাছ। তিনহাত পর ডোবা। বিবিধ আবর্জনায় সবসময় বিদঘুটে গন্ধ। বাদশা মিয়া ভোর-সকালে দোরগোড়ার বারান্দায় ফযরের নামাজ শেষ করে। মা উনুনে ভাত চড়ায়। তারা চারজন গরমভাত, আলুভর্তা আর যদি রাতের কিছু বাসি তরকারি থাকে বসে খায়। ছন্দময় দিনযাপন। আকস্মিক বন্যায় সব বেসুরো হয়ে গেল। একরাতে পশ্চিমের ঘর ধ্বসে সব উদোম। আকাশে মেঘ-রোদের লুকোচুরি। বাহদুরবাজারের রাস্তা জলাবদ্ধ। অনেক ধীরে পানি নেমে যায়। প্রায় দোকানে কোনো ব্যবসা নেই। বাদশা মিয়া কয়েকদিন বারান্দায় আধভাঙা ইটের উপর টেবিলে মেশিন সাজিয়ে বসে থাকে। যদি কোনো কাজ জোটে। কোনো কাজ নেই। হাশিমের স্কুল ত্রানশিবির। লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। একদিন দেখে এলো। মানুষজনের কান্না বিষাদ চেহারা। চিৎকার হট্টগোল। এরমধ্যে চলে খিঁচুড়ি রান্না। অবশেষে যে যার মতো গামলা-থালা নিয়ে লাইন। সাহেব মানুষেরা বড় মগে করে তুলে দেয়। মানুষের ক্ষমতা-অক্ষমতা-লজ্জা ধরা দেয় চোখে।
বাদশা মিয়ার বাড়িতে রান্না হয়নি সেদিন। আয়-রোজগার নেই। বাজার বন্ধ। সন্ধে থেকে প্রায় উপোস। এমন কষ্ট-বিপদের উপর আরও বিপদ। একটু রাত হলে দু-জন মানুষের কাঁধে ভর করে ঘরে আসে বাদশা মিয়া। মাথাব্যথা-জ্বরে কাহিল। সেই রাতে কাঁপতে কাঁপতে জ্বর আরও বেশি। হাশিম দেখে। সারাদিন খাওয়া নেই। রাত কেটে গেল তেমন। পরদিন বাবা শুকনো মুখে কোনো অলীক ভরসায় ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কারও কোনো কথা শোনে না। হাশিম দ্বিতীয়বার শিবিরে উপস্থিত। দুপুরের রোদে হাতে ছোট এক গামলা। যদি কিছু খিঁচুড়ি পাওয়া যায়। সে লাইনে দাঁড়ায়। মানুষ একজন একজন করে সমানে এগোয়। হাশিমের ভাবনা পেছনে পড়ে থাকে। তারপর ঘরে এসে বাবার মুখে সামান্য খাবার তুলে দেয়। জীবনের প্রথম প্রাপ্তি প্রথম সুখ। বাবা পরদিন চলে গেল। আর আশ্চর্য সেদিন চমৎকার উজ্জ্বল সকাল। আকাশদিগন্ত জুড়ে সূর্য পাখা মেলে দিয়েছে। আঙিনার কোনায় কয়েকটি মালতি ঝাড়। সাদা-গোলাপি ফুল। সেখানে খাটিয়া শুয়ে থাকে। সাদা কাপড়ে ঢাকা একজন মানুষ। তার আধখোলা চোখ কি সেই সূর্য দেখতে পায়? হাশিম জানে না। পরিবারে একটি মানুষ চলে গেলে অনেক ভাঙচুর হয়, এতে কারও চোখে অন্ধকার-বিষাদ নামে; পৃথিবীর কারও কিছু যায় আসে না। দিন দিনের মতো চলতে থাকে। মানুষ সকল কাজে কাজের মতো যোগ দেয়। বড়ভাই এসে দাঁড়ায় আঙিনায়। ঢাকায় বিয়ে করেছে জানা গেল। বাবা কি জানত? ভাই কি কাউকে জানিয়েছিল? বাবাকে? বাবা খুব ভালবাসত তাকে। এবং ভরসাও। মানুষটি বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন হিসেবে বড় আস্থা রাখতে পারে। পরদিন চলে গেল বড়ভাই। তেমন কোনো কথা বলল না। কীভাবে চলবে এই কয়জনের আহার? হাশিমের পড়ালেখা? মুন্নির? কেউ কেউ এভাবেই আপনজনের সকল আশা-প্রত্যাশা-ভরসায় কোনো অর্থ খুঁজে নেয় না। সবকিছু এড়িয়ে সীমারেখা টেনে দেয়। জগৎ এমনই।

(পরবর্তী অংশে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:০০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×