somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুভূতির বর্ণবিন্যাস

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম পর্ব ফেসবুক প্রেম

সবকিছুই খুব হালকা ভাবে নেওয়ার স্বভাবের সাথে আমি ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়ে পড়েছি।
তাই, আজাদকে কিছু বলতে সাহস পাইনি। যতবার ভেবেছি, তাকে সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করব, ততবার মনে হয়েছে, যদি সে আমাকে ফিরিয়ে দেয় ! প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা সহ্য করার মত শক্তি আমার আর অবশিষ্ট নেই।

আমাদের নিয়মিত দেখা হওয়ার সুযোগ ক্রমাগত কমতে কমতে, বছর তিনেকের মধ্যেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। যোগাযোগ মূলত সোশ্যাল মিডিয়া আর ফোনালাপে সীমাবদ্ধ এখন । বেসরকারী এক চাকরী পেয়ে, আজাদ দেশের এক প্রান্তে চলে গেছে। এখনো তার সাথে কথা বলার সময় তার চারিত্রিক মাধুর্য আমি অনুভব করতে পারি। তার কন্ঠস্বর আমার পেটের ভিতর নানান রঙয়ের প্রজাপতি উড়িয়ে দেয়, আমার হার্টবিট মিস হয়ে যায়। কিভাবে কিভাবে যেন আমার সমস্ত অনুভূতি তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করেছে। যখনই তার কথা ভাবি, মধুর স্মৃতিগুলো ফিরে আসে। কিন্তু মুখ ফুটে ভালোলাগার কথাটি বলার সাহস এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি।

আমিও চাকরীতে জয়েন করেছি, ইতোমধ্যে।
প্রতিদিন অফিসের মাইক্রোতে উত্তরা যাতায়াত করতে হয়।
অবধারিতভাবেই অন্য যাত্রীদের সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই পরিচিত হতে হল।
হাজার হলেও একই গাড়ীতে প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছি – অন্তত দিনে দুইবার দেখা হয়। তন্মধ্যে একজনকে একটু বেশী বন্ধুবৎসল মনে হল। তিনি বাংলামোটর থেকে উঠেন, আমার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়ার, আরেকটা ডিপার্টমেন্টে বসেন।

কর্পোরেট কালচারের কথা মাথায় রেখে, ওমর ভাইয়ের সাথে আলাপচারিতা কলিগসুলভ কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হলেও একেবারে নিখাদ বন্ধুত্ব নয়। কথার ঢংয়ে আন্তরিকতা যথেষ্ট থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবধানের একটা সুক্ষ রেখা দৃষ্টির আড়ালে তার উপস্থিতি বজায় রাখে সদর্পে। আমিও নিজেকে কখনোই পুরো উজাড় করে দেওয়ার ঝুঁকি নেই না। বরং কিছুটা রিজার্ভ থাকার চেষ্টা করি।

ফেরার পথে প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম।
অন্যান্য দিন এইরকম জ্যামের ভিতরেই ধীরে ধীরে গাড়ি এগুতে থাকে। কিন্তু আজ গাড়ী একদমই এগুচ্ছে না। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, ঝড়ের সাথে হালকা বৃস্টিও শুরু হয়েছে। বাতাস সামলানোর পাশাপাশি, ফুটপাতের দোকানদারেরা বড় বড় পলিথিন দিয়ে তাদের পসড়া ঢেকে দেয়ায় ব্যস্ত। চরম বিরক্তি আর দিনশেষের ক্লান্তি নিয়ে মাইক্রোতে বেশীরভাগই ঝিমুচ্ছে। শুধু ফোন বাজলে, কথা বলছে। না হয়, কেউ কোন কথাও বলছে না।

উদ্দেশ্য কি ছিল ?
এখন আর মনে করতে পারছি না। মাইক্রোর ভিতরের বিরক্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়া, নাকি বাইরের খোলা বাতাসের স্বাদ আস্বাদন করার আকাংখা - তবে কি মনে করে, ওমর ভাইয়ের কফি খাওয়ার প্রস্তাবে রাজী হয়ে, গাড়ী থেকে নেমে বুনো বাতাস আর হালকা বৃস্টির মধ্যেই প্রায় দৌড়ে এক কফিশপে ঢুকে পড়ি।

কাঁচের ভিতর বসে বাইরের বৃস্টি দেখতে ভালো লাগছিল।
অফিস ডেতে এই সময়ে কফি শপে সময় কাটানোর মত বিলাসিতা করার মত লোক কমই আছে।
তাই কফি শপটা প্রায় ফাঁকা বলা যেতে পারে। দুজনে যতটা না কথা বলছি, তার চেয়ে বেশী নিঃশব্দে বাইরের বৃষ্টিবিঘ্নিত দৃশ্য উপভোগ করছি। কফি খাওয়াটা যেন এখানে বসে থাকার একটা অজুহাত মাত্র, নিঃশব্দে সময় কাটানোটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

নিয়মিত বিরতিতে আমরা বিভিন্ন কফি শপে ঢু মারতে শুরু করলাম। এর পিছনে ঢাকা শহরের জ্যামকে বাহ্যিকভাবে দায়ী করলেও, আসলে আমাদের আড্ডা উপভোগ্য হওয়ার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের সাথে আরো দু-একজন জয়েন করত। এমনকি বিশেষ কোন কফি শপে যাওয়ার পূর্ব পরিকল্পনা থাকলে, ঐ এলাকার কাছাকাছি কেউ কেউ আমাদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরত। আড্ডায় বাকী সবাই বদল হলেও আমি আর ওমর ভাই ছিলাম কমন ফিগার।

সমস্যার শুরুটা হলো অন্য জায়গায় – যা আমার মাথায় কখনই আসেনি।
যেসব কলিগ আমাদের দুজনকেই চিনে, তারা আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সন্দেহ করতে শুরু করল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কানাঘুষা এমনকি দু’একটা গুজব পর্যন্ত চাঊড় হয়ে গেল। তবে, সবই ছিল আড়ালে- আবডালে।

আমি আর ওমর ভাই এগুলো পাত্তা না দিয়ে , আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছি। বলা যায়, আমার সম্পর্ক আরো শক্ত হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই অফিস থেকে ফেরার পথে একত্রে সময় কাটাই। গল্পের মধ্যে বই, সিনেমা থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক বিষয়ই চলে আসে। আমাদের দুজনের মধ্যেই প্রচুর মিল খুঁজে পাই – দুজনই কিছুটা অন্তর্মুখী, ভিড় আর হৈ-হুল্লোড় অপছন্দ করি। যে কোন আড্ডায়, সবাই যখন কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, শুধু আমরা দুজন তখন চুপ করে শুনতে থাকি। দুজনেই বই পড়তে পছন্দ করি আর গানের পছন্দ প্রায় কাছাকাছি ধরণের। ছোট ছোট কিছু ঘটনার পরে, তার প্রতি আমার বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা আরো বেড়েছে।

কয়েক মাস পরে, আবার সেই প্রথম কফি শপে এসেছি, শুধু আমরা দু’জন।
কারণ, অন্য কেউ গাড়ি থেকে নামেনি, আমাদের সাথে। এবারও ভিড় নেই, বরং প্রায় খালি বলা যেতে পারে।

- তুমি খুব ভালো একজন মেয়ে। তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া নিশ্চয়ই যে কারো সৌভাগ্যের ব্যাপার।

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সশব্দে হেঁসে উঠি। এমন কিছুর জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার ফ্রেন্ডলি আচরনের কারণে অনেকের সাথেই আমার এক ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। দু-একজন এমন কথা এর আগেও বলেছে। তবে, কখনই তাদের কথা সিরিয়াসলি নেইনি। সত্যি বলতে কি, তাদের অন্তরের মুগ্ধতার চেয়ে চোখের জৈবিকতার শিখা বেশী জাজ্বল্যমান ছিল – যা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু আজ, আমি ওমর ভাইয়ের অন্তরের মুগ্ধতা অনুভব করতে পারছি।

- তুমি কারো সাথে প্রেম করছো না কেন ?
- আপনি কিভাবে শিওর হলেন, আমার সাথে কারো প্রেমের সম্পর্ক নেই ?
- আমি জানি।

আমি জানি, আমি অতীব সুন্দরী নই। তারপরেও তার আত্নবিশ্বাসী কন্ঠ আমার কাছে ব্যঙ্গাত্নক মনে হল।
চেহারায় ফুটে উঠা হালকা অপমানিতবোধের অভিব্যক্তি আড়াল করতে ব্যর্থ হলাম।

আমাকে সম্পূর্ণ রূপে অপ্রস্তুত করে দিয়ে, ওমর ভাই আমাকে প্রপোজ করলেন।
তার কথায় চমকে গিয়ে কখন যে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমি নিজেও জানি না। আমার এমন প্রতিক্রিয়া যে কল্পনাও করেনি, তার চোখে চোখ পড়তেই বুঝে ফেললাম। ক্ষণিকের মধ্যেই আমারও সংবিৎ ফিরে এল।

কাঁচের বাইরের দুনিয়ায় প্রস্থানোদ্যত বর্ষার হালকা বৃষ্টির মুগ্ধতার মধ্যে এক কফিশপে আমার ভিতরে বর্ণনাতীত ভালোলাগার এক স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করতে বিলম্ব হল না। কারণ, এর আগে আমাকে কেউ কখনো প্রপোজ করেনি। কিন্তু আমার হৃদয়তো অনেক আগেই আজাদের কাছে হারিয়ে ফেলেছি। তাই, খুব বিনয়ের সাথে তাকে বললাম,

- আমি আরেকজনকে ভালোবাসি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, যদি অসচেতনভাবে কোন আচরনে আপনাকে কোন ধরণের ইন্ডিকেশন দিয়ে থাকি যে, আপনার প্রতি আমার বিশেষ ফিলিংস আছে।

ওমর ভাইয়ের চোখে পানি দেখে আমার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা কেমন – তা আমি জানি। দু’বার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে, আমি এখন পর্যন্ত সাহস করে আজাদকে কিছু বলতে পারিনি। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললাম,

- আমাকে মাফ করবেন, প্লীজ। আশা করছি, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে না, আজকের পর থেকে।

ওমর ভাইয়ের অনুরোধে, আরো কিছুক্ষণ বসে, তারপর আমরা উঠে পড়লাম।

একদিকে আমার জীবনের কৈশোর থেকে লালিত একটা স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।
অবশ্যই এটি ছিল জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ঘটেছে ভুল মানুষের সাথে, অসময়ে।
আমি তাকে যতটা না ফ্রেন্ড তার চেয়ে বেশী কলিগ হিসেবেই বিবেচনা করি। অথচ, তিনিই আমার স্বপ্নপূরণে এগিয়ে এসেছিলেন।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল - কেন যেন আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল। নিজেকে অসম্ভব সুখী ভাবছিলাম , দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী মনে হচ্ছিল - ঐ মুহূর্তে। পরক্ষনেই এক অসহনীয় বেদনা আমাকে ঘিরে ধরেছিল, আষ্টেপৃষ্ঠে। এই অনুভুতি আমি বলে বোঝাতে পারব না। লিখে ব্যক্ত করার তো প্রশ্নই উঠে না। মানুষের অনুভূতিগুলো আদতে বর্ণহীন হয়। আর বলাই বাহুল্য যে, কিছু বর্ণ সুন্দরভাবে বিন্যাস করে সব অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য অন্তত আমার নেই।

ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×