প্রথম পর্ব -
সাহারার মরীচিকা
দুজনের দৃষ্টি এখন গাড়ীর পিছনের রাস্তার উপরে। রাস্তায় আমাদের গাড়ির চাকার দাগ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মুখে না বললেও, নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে দুইজনেই একই বিষয় নিয়ে ভাবছি - এই চাকার দাগ ধরে সহজেই ফিরে যাওয়া যাবে। আরেকটা বিষয় হলো, রাস্তায় কোনো বড় বালিয়াড়ি ছিল না, তাই গাড়ী চালাতে ঝামেলা কম হবে। আমরা যে রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে এসেছি, সেটা স্থানীয় লোকজনের ব্যবহৃত রাস্তা, কিছুটা শক্ত মাটির মত বলা চলে, যেখানে কিছু কিছু অংশে বালির তুলনায় ছোট ছোট পাথড় বেশি ছিল। তবে, গত চার ঘন্টায় কোনো গাড়ি আমাদের চোখে পড়েনি।
মাথা থেকে পিরামিড দেখার চিন্তা ঝেড়ে ফেলছি, ততক্ষণে। ঠিক মাথার উপরে উঠে আসা সূর্যের চাঁদি ফাটানো রোদের নিচে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু এখন একটাই – আমাদের গাড়িটা। ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে, নিদেনপক্ষে এখন ৩০ মিনিট সময় দিতে হবে।
তাই, আমরা গাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। উত্তাপ যেন ক্রমেই বাড়ছে। প্রাডো জীপটা খুব ছোট একটা ছায়া দিতে পারছে, কারণ সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে। বস্তুত, মরুভূমিতে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচার মতো ছায়া শুধুমাত্র সকালে আর বিকালে পাওয়া যায়।
আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি যে, কোথায় আমাদের ভুল হতে পারে? সেনেগালের এই ক্যাপ্টেন সাব কোন ক্লু বের করতে পারলো না। কারণ আসলে হিন্টস বের করার মত ভুমিচিহ্ন বা সুত্রের উপস্থিতি পুরো রাস্তাতেই অনুপস্থিত ছিল। তাই, ক্লু বের করার চেষ্টাও নিস্ফল হওয়াই স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে সে প্রস্তাব করলো,
- আমরা কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নেই, ততক্ষণে গাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে যাক। এর পরেই আমরা ফিরতে শুরু করবো।
আমার নিজেরও কথা বলতে তেমন ইচ্ছে করছিল না। পুরো ব্যাপারটা নিয়েই আমি এখন যারপরনাই হতাশ এবং বিরক্ত। তাই, আর কথা না বাড়িয়ে, একের পর এক সিগারেট ধরাতে লাগলাম। একটা শেষ হলেই, প্যাকেট থেকে আরেকটা বের করে ঠোঁটে তুলে নিচ্ছি।
জীপের ছোট্ট ছায়ার নিচে উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছিল। তাই, দুজনেই শার্ট খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। একে তো এসি’র বাইরে, তার উপরে মরুভূমির মধ্যে দুপুরের রোদ – সব মিলিয়ে পুরো গরমটাই এক পর্যায়ে সহ্য ক্ষমতার বাইরে মনে হচ্ছিল। প্রচুর পানি খেয়ে ফেলছি, এর মধ্যেই। থাকতে না পেরে গরম রাস্তার উপরে বসে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম, চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, যে কোন মুহূর্তে পুড়তে শুরু করতে পারে – তারপরেও প্রায় নির্বিকার বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আমাদের এখন এই জীপ আর শার্টের ছায়া ছাড়া চলবে না; আর, দাঁড়িয়ে থাকলে, এর কোনোটাই পাওয়া যাবে না।
প্রায় ২০ মিনিট মতো বসে থাকার পরে, আবদুল বললো,
- আমার মনে হয়, আর দেরী করা ঠিক হবে না। ফিরতে ফিরতে গাড়ির ভেতরেই এসিতে বিশ্রামের আরো ফুরসত পাওয়া যাবে।
সে নিজেই জানালো যে, এবার গাড়ি সেই চালাবে।
ঠিক ঐ মুহূর্তে, গাড়ির শব্দ পেলাম। পুরো যাত্রায়, প্রথমবারের মতো, এই মরুভূমিতে কোনো গাড়ির শব্দ কানে এলো! কিছুক্ষনের মধ্যেই চোখে পড়ল, একটা মিনি ট্রাককে যাত্রী পরিবহনের উপযোগী করে পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেকটা আমাদের দেশের হিল ট্র্যাক্টস-এর চাঁদের গাড়ীর মতো। আসলে, চাঁদের গাড়ির মতো না বলে, বাংলাদেশের চাঁদের গাড়ির সুদানী ভার্সন বলাই যুক্তিযুক্ত। গাড়ীর ভিতরে অল্প কয়েকজন স্থানীয় মানুষ বসে আছে। ছাদের উপরে কেউ নেই। আমাদের জীপটি পার হয়ে, হঠাৎ গাড়িটি থেমে গেল।
একজন গাড়ি থেকে নেমে আমাদের জিপের কাছে এগিয়ে আসছে, বাকীরা গাড়িতে বসে তাকে লক্ষ্য করছে।
জীপের কাছে এসে, সে ভিতরে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো। এরপর চারপাশে হেটে হেটে গাড়ির বাইরেও মনোযোগের সাথে কি যেন পরীক্ষা করল।
আমাদের দুজনের দিকে তার কোন নজর নেই। যেন, আমরা ভুত, আর তাই সে আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের কাছে কিছু জানতে না চেয়ে, সে গাড়িতে কি খুঁজছে?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, গাড়িতে যেভাবে বড় করে ‘ইউ এন’ লেখা রয়েছে, তাতে তাবৎ দুনিয়ার যে কোনো ভাষাভাষীর মানুষের পক্ষেও এটা বুঝতে এক মুহূর্ত দেরী হবে না যে, এই গাড়িটা জাতিসংঘের।
তার বয়স খুব বেশি হলে ২৫ এর কোটায় হতে পারে। আর, ভাবসাব মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না। সে যখন আমাদের গাড়ী খুটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল, আমার মাথায় তখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করছিল। তন্মধ্যে গাড়ি ছিনতাই এর সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে।
অবশ্য, এমন দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণও আছে। আমাদের দিকে একেবারেই নজর না দিয়ে, পুরো মনোযোগ গাড়িতে দেয়ার অন্য আর কি অর্থ হতে পারে!! এছাড়া, দারফুরের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, আর গাড়ি চুরি এমনকি ছিনতাই করা ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। সংঘাতে লিপ্ত বিভিন্ন দল-উপদলগুলো প্রায়শই জোরপূর্বক বিদেশি সংস্থাদের গাড়ি ছিনতাই করে থাকে; মুলত নিজেরাই ব্যবহারের জন্যে। অনেক সময় আবার এগুলো বিক্রি করে দেয়, টাকা দিয়ে অন্য কিছু কেনার প্রয়োজনে।
এই চিন্তা মাথায় আসার পরে, আমার ভয়ের পারদ উপরে উঠতে এক মুহূর্তও দেরী হলো না। সঙ্গীর মানসিক অবস্থা, আমার চেয়ে খুব একটা ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। উপরন্তু, আমাদের মতো বিদেশিরা এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে বেড়াতে আসিনি। তাদের দৃষ্টিতে, আমরা শুধু তাদের নিজের দেশের মাটিতে অনাহূতই নই, বরং অনেকেই আমাদের সাম্রাজ্যবাদী দখলদার হিসেবে বিবেচনা করে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, গাড়ির চাবি নেয়া হয়নি। অবশ্য আমরা যখন গাড়ি থেকে নামছিলাম, তখন চাবি হাতে নেয়ার কোনো কারণ ছিল না। তার মানে, এই তরুণ এখন আমাদেরকে এই মরুভূমিতে ফেলে রেখে গাড়িটা নিয়ে চলে যেতে পারে। আর, এখানে ফেলে যাওয়া মানেই হলো নিশ্চিত মৃত্যু; কারণ ফেরত যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
গাড়ি পরীক্ষা নিরীক্ষা বাদ দিয়ে সে এবার আমাদের দিকে ঘুরলো। আমাদের দিকে তাকাতে গিয়ে এক হাত কপালের কাছে তুলে ফেলেছে; সম্ভবত রোদের তিব্রতার কারণেই চোখে সরাসরি রোদ লাগতে দিচ্ছে না। আমাদের দিকে হাটতে শুরু করেছে দেখে, দুজনেরই উদ্বেগ বাড়তে শুরু করলো।
আমাদের কাছে থেমে সে কি যেন বলছে! কোন ভাষায় কথা বলছে?
ভয় আর সন্দেহ আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে আমি তার কোনো কথাতেই মনোযোগ দিতে পারছি না, বুঝতে পারার তো প্রশ্নই উঠে না। তবে তার চোখে মুখে হিংস্রতার অনুপস্থিতি আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কোনো আক্রমনাত্নক ভঙ্গি না থাকায়, একটু একটু করে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে, সে ইংরেজিতে কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই সে আবদুলের কাছ থেকে শার্ট নিয়ে, আবার তার হাতেই গুঁজে দিয়ে তাকে শার্টটি গায়ে দিতে বলল।
এতক্ষণ না বুঝলেও, এই সুদানী তরুণের আরবী একসেন্টে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিন্তু পরিষ্কার ইংরেজিতে বলা কথাটুকু বুঝতে মোটেও দেরী হলো না, আবদুলের। সে আমাকেও একই আদেশ দিল। আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ মেনে নিলাম। আসলে যে পরিমাণ ভয় পেয়েছি, তাতে তর্ক করতে যাওয়া দুরের কথা কোনো কথা পর্যন্ত বলার সাহস হচ্ছিল না। মনে মনে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি, আমাদের গাড়ী ছিনতাইয়ের পাশাপাশি আমাদেরকে অপহরণও করা হতে যাচ্ছে। যাক, অন্তত এই মরুভূমিতে মরতে হবে না। আবার, পরক্ষনেই লুকা’র কথা মনে পড়াতে মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ইতালিয়ান এই ভলান্টিয়ারের সাথে যা করা হয়েছিল, তার চেয়ে মেরে ফেলা ভালো ছিল।
সুদানী তরুণ এবার আমাদের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে নিল। ধীরে ধীরে পানির বোতলের ক্যাপ খুলতে শুরু করেছে।
কি ঘটতে যাচ্ছে, কিছুই জানি না, বুঝতে পারছি না; এমনকি অনুমানও করতে পারছি না। পুরো ব্যাপারটি অনিশ্চিত এবং ধারনার বাইরে। তবে, ভয়ংকর কিছু যে সামনে অপেক্ষা করছে, সে ব্যাপারে মনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে মনে পড়ল, অফিসের অনেকেই সময়ে সময়ে সতর্ক করেছে, যেন অহেতুক মরুভূমিতে ঘুরাঘুরি করতে না যাই। এমনকি আজ সকালে গাড়িতে পানির বোতলের ক্রেট তুলতে তুলতে বাসার সুদানী দারোয়ান আবদুল বাতিন কি মনে করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যেন আল্লাহর নাম নিয়ে পথে যাত্রা শুরু করি।
মুহূর্তের মধ্যে দেশের অনেকের কথা মনে পড়তে শুরু করল – মুরুব্বীদের কাছ থেকে দোয়া চেয়ে বিদায় নিয়েছিলাম। মনে সন্দেহ জেগে উঠলো - আমার দোয়া কামনায় হয়তবা খাঁদ ছিল, কিংবা আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল; কে জানে, আমি শুধু আনুষ্ঠানিকতা পুরো করতেই দোয়া চেয়েছিলাম!
আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে, সে আমাদের হাতে পানির বোতল ফেরত দিয়ে পানি খেতে বললো। আমরা তৃষ্ণার্ত ছিলাম না। তাসত্বেও, আদেশ পালনে দেরী করলাম না। বাস্তবে অবস্থা এমনি যে, আমরা এখন যা করতে বলবে, তাই করবো; যে কোনো আদেশ পালন করতে প্রস্তুত। শুধু, আমাদের যেন কোনো ক্ষতি না করা হয়।
কেউ কোনো কথা বলছি না। তাই, পানি খাওয়া শেষ হওয়ার পরে, অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল। আমাদের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, তরুনটি হেঁসে ফেলল। তার হাঁসি দেখেও আমরা ধারনা করতে পারছি না, এর পরে আমাদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে। সে এবার হাসতে হাসতে বলল,
- রিল্যাক্স, রিল্যাক্স।
এতক্ষণ আদেশের স্বরে কথা বললেও, এখন তার কণ্ঠে নমনীয়তার ছোঁয়া টের পাওয়া যাচ্ছে। সে নিজে থেকেই ব্যাখ্যা করে বুঝালো, কেন এই সময়টাতে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো বিপদজনক। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বয়সে তরুণ হলেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ কাজে লাগাতে সে কার্পণ্য করেনি; যা তার আচরণে পরিপক্কতা উপহার দিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা তাকে যথেষ্ট ভদ্র মনে হচ্ছে এখন। কথা বলতে বলতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
- তোমরা এই অসময়ে এখানে কি করছিলে?
- আমরা পিরামিড দেখতে এসেছিলাম।
আবদুল উত্তর দিল।
পিরামিড!!
তরুণের কণ্ঠে বিস্ময়।
আসলে সে তার বিস্ময় লুকানোর চেষ্টা করছে না। আবার জিজ্ঞেস করে যখন একই উত্তর পেল, তখনও তার চোখে মুখে বিস্ময় গেড়ে বসে আছে। তরুণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আমার মনে হল, সে ভাবছে যে আবদুল মনে হয় ইংরেজী তেমন ভালো জানে না। কারণ, সে যা বলছে, তার কোনো মানে হয় না। এখানে পিরামিড আসবে কোত্থেকে! সম্ভবত, সে পিরামিড বললেও অন্য কোনো কিছু বুঝাতে চাইছে। কিন্তু ভাষার সীমাবদ্ধতায় ‘পিরামিড’ বলে ফেলছে।
সে আর কথা বাড়ালো না। অল্প কথায় আমাদেরকে সতর্ক করে দিল যে, অনভ্যস্তদের ভুলেও মরুভূমিতে যাওয়া উচিৎ নয়। আর যদি নিতান্ত বাধ্য হয়ে যেতেই হয়, তাহলে সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়টা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এক্ষেত্রে হয় সকাল, আর নয় বিকাল বেছে নেয়াই শ্রেয়। এর বাইরে অন্য সকল সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।
মুহূর্তের মধ্যেই প্রশান্তির এক শীতল ছোঁয়া সারা শরীর জুড়ে অনুভব করলাম। আলাপে আর কোনো জড়তা নেই এখন। ছোট এক হাঁসি দিয়ে, তরুণ নিজে থেকেই জানালো যে, সে খারতুম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শুনেই আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল, সবাই মুখেই ততক্ষণে স্মিত হাঁসি চলে এসেছে। আমরাও তার ইংরেজি জানার রহস্য উন্মোচন করতে পেরে আরো কিছুক্ষণ হাঁসিটা মুখে ধরে রাখলাম। আলাপচারিতা লম্বা হলো না, কারণ সে আমাদেরকে তাড়া দিল – দ্রুত জীপের ভিতরে গিয়ে বসো, আর ইঞ্জিন স্টার্ট দাও।
একজন আগন্তুক যতক্ষন আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার কথা খুশী মনেই মেনে নিতে রাজী আছি। তাই, কালবিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আবদুল, চালকের আসনে, আর আমি তার পাশে। মরুভূমির দিকে আরেকবার তাকিয়ে, সে আমাদেরকে কোথাও না থেমে সরাসরি আমাদের বেইসে ফেরত যেতে বললো। সেই সাথে এও বললো, পথে অবশ্যই আমরা যেন প্রচুর পানি খেতে থাকি।
সালাম বিনিময় আর ধন্যবাদ পর্ব শেষ করে, আবদুল এমন গতিতে জীপ টান দিলো – মনে হচ্ছিল টেইক অফ করার পূর্বমুহূর্তে কোনো বিমান তার ফাইনাল রান নিচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত, আমরা দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম। এখন নিজেদেরকে বিপদমুক্ত মনে হচ্ছে; মনে হচ্ছে, এ যাত্রা আমরা বেঁচে গেলাম।
কিন্তু, আসলে কতক্ষনের জন্য ............... ?
বা, আসলেই কি আমরা বেঁচে গেলাম? একটু পরেই মনের মধ্যে উকি দিলো এই প্রশ্ন। কারণ, অন্য অনেক কাহিনীর মতোই আমাদের ফিরতি যাত্রা নিরুপদ্রব কিংবা ঘটনাবিহীন ছিল না।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে, আমরা অনেক দুর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের দৃস্টি সীমা এত বিস্তৃত হয়েছে যে, মনে হচ্ছে দারফুরও দেখতে পারবো কিছুক্ষনের মধ্যেই। কেবল তখনই হঠাৎ খেয়াল হলো মরুভূমির রং কিছুটা গোলাপী মনে হচ্ছে। অথচ, আমরা যখন সকালে বের হয়েছিলাম, তখন সোনালী দেখাচ্ছিল। আরেকটু ভালো মতো লক্ষ্য করে বুঝলাম আমরা অনেক উঁচুতে উঠে এসেছি। বাস্তবে, আমরা প্রায় ৪ ঘন্টাই ক্রমান্বয়ে উঁচুতে উঠছিলাম। নিজেই অবাক হলাম, এত উঁচুতে উঠে এসেছি আমরা !! অথচ, একটুও টের পাইনি !!!
প্রায় দুই ঘন্টা একটানা গাড়ি চালিয়ে আসার পরে, আবদুল জানালো যে, সে অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করছে। আমারও তখন খুব ক্লান্ত লাগছিল, তাই গাড়ি চালাতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে এগুচ্ছি। তবে, হঠাৎ হঠাৎ তার কথা খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, সে গাড়ি চালাতে চালাতেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তাই সীট বদল করে ফেললাম।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই দারফুর শহর চোখে পড়ল। তবে, আমার শরীর এখন আর চলতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে আবদুলের অবস্থা আরো খারাপ। তার নাকি প্রচন্ড বমি আসছে। আমার পেটেও মোচড় দিচ্ছে। আর না পেরে, আবদুল বললো যে, সে জানালা দিয়েই বমি করে ফেলবে। বলতে না বলতেই, সে বমি করে ফেললো।
বমি করার কিছুক্ষন পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে; অবসাদে ঘুম ঘুম আসছে। তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কয়েকবার ডাকার পরেও তার তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। আমার মনে হলো, সকালে যে চিকেন শর্মা নিয়ে এসেছিলাম; সেগুলোর মধ্যে কিছু একটা গড়বড় হয়েছিল নিশ্চয়। তা ছাড়া এমন পেট কামড়ানোর আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বিকেল ৫ টা।
দারফুর শহরে প্রবেশ করেই সরাসরি ইউ এন হাসপাতালে চলে এলাম। আবদুলকে চেক করানো দরকার। আমি নিজেও কিছু ওষুধ নিবো। হাসপাতালে ঢুকেই লোকজন ডেকে আবদুলকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলাম। ততক্ষনে, আমি নিজেও অনেক কাহিল হয়ে পড়েছি। এতটাই কাহিল যে, বাথ্রুমে যাওয়ার জন্যে একজনের সাহায্য চাইতে হলো।
ফিরে এসে দেখি, আবদুল বিছানায় শুয়ে আছে। এক ডাক্তার তার হাতে স্যালাইনের সুঁই পুশ করছে। বুঝতে বাকী রইল না যে, ডাক্তারের যা জানার ছিল, তিনি তা ইতোমধ্যেই জেনে নিয়েছেন। আমার বমি বমি ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। সামলাতে পারলাম না, বমি করেই ফেললাম। বাথরুম থেকে ফিরে দেখি, আমার জন্যেও একটা বিছানা আর স্যালাইন রেডি করে রাখা হয়েছে। আমাকে স্যালাইন দেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙ্গতে দেখি, প্রায় এক ঘন্টা ঘুমিয়েছি। আমাকে জাগতে দেখে ডাক্তার এলেন। তেমন কিছু বললেন না, শুধু জানালেন যে, স্যালাইন শেষ হতে আরো প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে। তারপরেই আমরা যেতে পারবো। তখন আমি নিজে থেকেই জানতে চাইলাম,
- আমাদের কি হয়েছিল?
- সানস্ট্রোক (Sunstroke)।
বলেই, সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো।
পুরো বিষয়টা সহজ করে বুঝিয়ে বলে জানতে চাইল,
- তোমাদের কেউই কি জানতে না তৃষ্ণার্ত মানুষ মরুভূমিতে কিভাবে মরীচিকার পিছনে ছোটে?
- আমরা কেউই তৃষ্ণার্ত ছিলাম না। আমাদের পর্যাপ্ত পানি ছিল।
- আমি পানির কথা বলছি না। আমি তোমাদের শার্ট খুলে ফেলার কথা বোঝাতে চাইছি।
হায়, হায়!!
এই সেনেগালি দেখি সব ডাক্তারকে বলে দিয়েছে!
অথচ, সবাই, এই ইউ এন হাসপাতাল এড়িয়ে চলে। কারণ খুব সহজ। অদ্যবধি যতজনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, এই হাসপাতালে আসার পর থেকে। মনে মনে কামনা করছি, অন্তত সে এটুকু ফাঁস করে দেয়নি নিশ্চয় যে, আমরা কতদুর গিয়েছিলাম। কারণ, যে স্থানে গিয়েছিলাম, অতদুর যাওয়া নিয়মের মধ্যে পড়ে না। আর, নিয়ম ভাঙ্গার জন্যে তদন্ত এবং ফলশ্রুতিতে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি তার অজানা নয়।
ডাক্তার বলেই চলছে,
- তোমরা শার্ট খোলার সাথে সাথেই তোমাদের শরীরের পানি বাস্পে পরিণত হতে শুরু করে। আবহাওয়া এত গরম ছিল যে, তোমরা বিন্দুলাত্রও বুঝতে পারোনি। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই তোমরা দুজনেই পানি শুন্যতায় ভুগতে শুরু করেছিলে। এক্ষেত্রে তৃষ্ণা অনুভব করার পরিবর্তে এক ধরনের দ্বিধা আর অনুভূতি শুন্যতা মানুষের মনকে কব্জা করে ফেলে। আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে তোমরা মরুভূমির বেশি গভীরে যাওনি এবং খুব দ্রুত ফিরে এসেছো।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম
যাই হোক, আবদুল পুরো যাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা গোপন রেখেছে।
সব শুনে, এবার জানতে চাইলাম - অবসাদ আর বমির ব্যাপারে।
ডাক্তার আবার বলতে শুরু করলেন,
- অবসাদ আসলে মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ। পর্যাপ্ত পানি পান করা সত্বেও, মরুভূমিতে অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পানিশূন্যতা এতটাই দ্রুত এবং ব্যাপক যে, একজন তৃষ্ণার্ত অনুভব করার আগেই তার শরীর পানিশুন্য হয়ে যায়। তাই, দীর্ঘক্ষণ মরুভূমিতে থেকে পানি খেয়ে অনেকে যখন মনে করে যে সে প্রায় এক ব্যারেল পানি খেয়ে ফেলেছে, বাস্তবে তার শরীর তখন পুরো পানিশুন্য হয়ে গেছে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করে তিনি আমাদেরকে হাঁসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেন। যাওয়ার আগে, আবার উপদেশ দিলেন যে, তৃষ্ণার্ত অনুভুব না করলেও যেন আমরা প্রচুর পানি খাই। হাঁসপাতাল থেকে বের হতে হতে ভাবছিলাম, আজ কার মৃত্যু ধীরে ধীরে অবসাদ-এর বেশে আমাদের কাছে এগিয়ে এসেছিল? আমার না আবদুলের ?
পরবর্তীতে, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, সুদানে আসলেই পিরামিড রয়েছে। শহর থেকে ২২০ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে; যা নুবিয়ান পিরামিড (Nubian Pyramids) নামে পরিচিত। নীল নদের পাড়ে অবস্থিত এই পিরামিড দেখতে ট্যুরিস্টও যায়। তবে পুরো রাস্তা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই; শেষের একটা অংশ পার হতে হয় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে।
তবে, আমি আজো নিশ্চিত হতে পারিনি,
ঐ দিন আমাদের কোথায় ভুল হয়েছিল?
অচেনা-অজানা পথে এই রকম এক এডভেঞ্চার করাই কি ভুল ছিল?
নাকি, মরুভূমির সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে শার্ট খোলা?
অজানা এবং অনিশ্চিত যে কোন কিছুর প্রতি ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। মানুষ চারিত্রিকভাবেই এই ভয় থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে পারেনি। সুদানি তরুণের আবির্ভাব এবং প্রাথমিক কর্মকাণ্ড আমাদের মনে ভয় এবং সন্দেহ উদ্রেক করেছিল। অবশ্য সুদানের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঐ ভয় এবং সন্দেহ অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তার আবির্ভাব কি স্বাভাবিক ছিল?
আমাদের কোথায় ভুল হয়েছিল, আমি জানতে আর আগ্রহী নই। তবে, যে কৌতুহল আজো মিটেনি, তা হলো,
সারা রাস্তায় যেখানে আমরা কোনো মানুষ বা গাড়ি দেখিনি, সেখানে হঠাৎ কোত্থেকে সে উদয় হলো?
আবার নিজে নিজেই গাড়ি থামিয়ে, আমাদের গাড়ি পরীক্ষা করে, আমাদেরকে অতি দ্রুত ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো ?
(আরেকজনের কাছ থেকে শোনা )
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৪৪