দারফুর, সুদান, ২০১০ সালের কোনো এক সময়।
যুদ্ধের ডামাডোলের আওয়াজ আগের মত না থাকলেও স্থানীয়দের মনে গেঁথে যাওয়া স্মৃতি, শহরের চারপাশে রয়ে যাওয়া ধ্বংসচিহ্ন আর রাস্তায় দিন-কাটানো অগণিত শিশু ও নারীর হতদরিদ্র চেহারা-পরিচ্ছদে যুদ্ধের ভয়াবহতার ছাপ সুস্পষ্ট। বরং এতটাই উজ্জ্বল আর জীবন্ত, যে কোন আগন্তুকের পক্ষেও অনুধাবন করতে মোটেও বেগ পেতে হয় না।
তবে, আমরা যারা জাতিসংঘের হয়ে এসি রুমের চারদেয়ালের মধ্যে কাজ করি, তাদের অনেকেরই এই ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয় না। শুধুমাত্র, অফিস কম্পাউন্ডের বাইরে গেলেই এই বাস্তবতা অনুভব করতে হতো। এভাবেই চলছিল আমার দারফুর জীবন; যা বদলে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই, সেনেগালের এক ক্যাপ্টেনের সাহচর্যে।
একত্রে কাজ করতে করতেই সেনেগালের ক্যাপ্টেন আবদুলের সাথে আলাদা একটা অন্তরঙ্গতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। যার শুরু মুলত, ফজরের নামাজে প্রায় প্রতিদিনই একই সময়ে একই রাস্তায় যাতায়াতের সুবাধে। অবশ্য শুরুর দিকে, শুধুমাত্র সালাম বিনিময়ের মধ্যেই সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ ছিল। এর পরে একই অফিসে পাশাপাশি কাজের সুবাদে আলাপচারিতা জমে উঠতে সময় লাগেনি। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের আলোচনা থেকে ভৌগোলিক সীমারেখা গায়েব হয়ে যায়। নিজের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি আফ্রিকা মহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে আমরা গল্পের টপিক বের করে ফেলতে সক্ষম হই।
অফিসের কাজের অংশ দিসেবেই আমাদের মাঝে মাঝে লম্বা ফিল্ড ট্রিপ-এ যেতে হতো। গাড়ী নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়তাম, ধু ধু মরুভূমির মাঝে; যেসব যাত্রার কোন নির্দিষ্ট ফেরার সময় বেঁধে দেয়া ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা একই গাড়ীতে কথা বলার মাঝে, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা , প্রচলিত কুসংস্কার এমনকি ব্যক্তিগত অনেক কিছুই চলে আসত; ফলশ্রুতিতে, নিজের মানসপটে আরেকজনের দেশ, সমাজ বা পরিবার সম্পর্কে স্বচ্ছ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে বেশি সময় লাগল না, আমাদের কারোরই।
ফিল্ড ট্রিপগুলোকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করত, বিশেষ করে ইউরোপীয়রা। কিন্তু আবদুল বা আমি, কেউই এমন ভাবতাম না। বরং, আমাদের কাছে মরুভূমির এই লম্বা জার্নিগুলো উপভোগ্য ছিল। এমনকি মুসলমান হিসেবে প্রায় সব জায়গাতেই স্থানীয়দের কাছ থেকে আলাদা কদর পেতাম। স্বাভাবিকভাবেই, আমরা নিয়মিত এই লম্বা ফিল্ড ট্রিপগুলো নিতাম; যেখানে মাঝে মাঝে দিন শেষে রাত পর্যন্ত মরুভূমিতে কাটাতে হতো।
একদিন, আবদুল আমার টেবিলের উপর একটা ম্যাপ রেখে বললো,
- চলো, পিরামিড দেখে আসি। এখান থেকে মাত্র ১৭০ কিমি দূরে।
আমার বিস্ময় লুকিয়ে রাখতে পারলাম না!
- কিভাবে সম্ভব! সুদানেতো কোনো পিরামিড নেই ! এগুলো আছে, মিশরে!
আবদুল আমার কথা মানতে নারাজ। সে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে কি কি সব বলল – যার মোদ্দা কথা হলো, পিরামিড শুধু মিশরেই নির্মাণ করা হয়নি। কিছু পিরামিড মিশরের বাইরেও নির্মাণ করা হয়েছে। এমন কিছু পিরামিড পড়েছে সুদানের মধ্যে। আর সুদানের এই পিরামিডগুলো দারফুর থেকে ২০০ কিমি দুরেও না। অথচ, আমরা এগুলো না দেখেই এদেশ থেকে চলে যাব? সেটা কিভাবে সম্ভব !!!
আবদুলের জোরাজুরিতে না পেরে, অফিসে যাতায়াত করে এমন কয়েকজন স্থানীয় লোকের সাথে আলাপ করলাম। তারা সবাই নিশ্চিত করলো যে, মরুভূমির মধ্যে একটা পরিত্যক্ত পিরামিড সত্যিই রয়েছে।
আমাদের আনন্দ আর দেখে কে!
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললাম – আমরা পিরামিড দেখতে যাবো। অফিসের ট্রান্সপোর্ট সেকশনের সার্বিয়ান তরুণীকে ম্যানেজ করে সবচেয়ে ভালো গাড়ীটা বাগালাম। আমাদের হিসেব অনুযায়ী, গড়ে ঘন্টায় ৫০ কিমি স্পিডে প্রাডো জীপে চার ঘন্টার বেশি লাগবে না। তারপরেও মরুভুমি, অজানা রাস্তা, ধুলো, বালি ইত্যাদি বিবেচনা করে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। তাই, ফুয়েল ট্যাংক পুরোপুরি ভরেও এক্সট্রা ফুয়েল ট্যাংক আর পানির বোতল ভরে নিলাম গাড়িতে।
তিন ঘন্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে কম করে হলেও প্রায় একশবারের উপরে আবদুলকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছি যে, আমরা সঠিক রাস্তায় রয়েছি কিনা। বরাবরেই মতোই সে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছে যে, আমরা সঠিক রাস্তা ধরেই এগুচ্ছি। যদিও রাস্তার পাশের ছোট-বড় ক্যাকটাসের ঝোপ, মরুভূমির এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় একই রকম দেখতে হাতে গুনা কয়েকটা অনুচ্চ কাঁটা গাছ, আর দিগন্তের সীমানায় পাহাড়ের অবয়ব ছাড়া চারপাশের সাথে ম্যাপ মিলিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। তবুও সে প্রতিবার আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ম্যাপের দিকে তাকায়, এর পরে চারপাশে মনোযোগ দিয়ে কি কি যেন লক্ষ্য করে এবং সবশেষে জানায় যে, রাস্তা ঠিক আছে।
সে একজন আর্মি অফিসার। তার ম্যাপ রিডিং স্কিল নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই, কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলাম। কিন্তু তারপরেও মনের ভিতরে আপনা-আপনিই উদ্বেগ বেড়েই চলছিল। হয়ত তার ম্যাপ রিডিং এ কোনো ধরনের ভুল হচ্ছে, যা আমরা ধরতে পারছি না – এমন একটা ভাবনা আমাকে ক্রমাগত কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে শুরু করলো। ভাবতে ভাবতে, ক্রমাগত বর্ধমান উদ্বেগের পাশাপাশি এখন অনাগত অনিশ্চয়তার ভয় জন্ম নিয়ছে আমার মনে।
আমরা যে রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম, তাতে মাঝে মাঝে গাড়ীর চাকার দাগ চোখে পড়ছিল। অর্থাৎ, এই রাস্তা ধরে গাড়ী চলে এবং রাস্তার কোনো না কোনো অংশে মানুষের বসতি আছে। এমনকি, দিগন্তে দেখা পাহাড়ের পাদদেশেও হতে পারে।
গাড়ী থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে, ভালো লাগত। কিন্তু জিজ্ঞেসটা করবো কাকে? কাউকে রাস্তায় পেলে তো ! যদি কাউকে পাইও, আমাদের দুজনের কেউই আরবী বলতে পারি না। না সে আমাদের সমস্যা বুঝবে, না আমরা তার সমাধান বুজবো!
আমরা যে মরুভূমির উপর দিয়ে চলছি, সেটা বিখ্যাত সাহারা মরুভূমির অংশ। এতক্ষণ পার হওয়ার পরেও আমার মনে হচ্ছে না, আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি পৌছেছি। আমি আবার তাকে রাস্তা এবং গন্তব্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। সে কিছু না বলে, যথারীতি ম্যাপের দিকে মনোযোগ দিলো, আবারও। ম্যাপ অনুযায়ী, আমাদের গন্তব্যস্থল আর মাত্র ২০ মিনিট বা তার চেয়ে একটু বেশি দুরে। তবে, আমাদের আশেপাশের অবস্থা এবং চারপাশের দৃশ্য অনুযায়ী, আরো অনেক দূরে যেতে হবে বলে মনে হচ্ছিল আমার কাছে।
চুপচাপ আরো প্রায় ৩০ মিনিট ধরে গাড়ি চালিয়ে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাওয়ার। সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে আসায় মরুভূমির উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদেরকে অবশ্যই বিকেলের মধ্যে ফিরতে হবে। অন্যথায়, রাতে মরুভূমিতে পথ হারানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। উপরোন্ত, আরেকটা বিপদের আশংকা করছি এখন, ইঞ্জিনের ওভারহিটিং-এর ফলে গাড়ীর কোন সমস্যা হতে পারে। কারণ, গাড়ির এসি আশানুরূপ ঠাণ্ডা হচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত আমি গাড়ী থামিয়ে ফেললাম। অবশ্য ততক্ষণে দারফুর থেকে প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। কোথাও পিরামিডের কোন চিহ্ন নেই , এমনকি একটা ইট বা যে কোনো ধরনের স্থাপনার বিন্দুমাত্র চিহ্নও চোখে পড়েনি কোথাও। ততক্ষণে নিজের বেকুবপনায় নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল; কোন দুঃখে মিশরের এক অধিপতি মরুভূমির এই প্রান্তে এসে পিরামিডের মতো স্থাপনা নির্মাণ করবে?
তবে, ম্যাপে কিছু একটার উপস্থিতি নির্দেশ করছিল। কিন্তু সেটা কোথায়? আমাদের পিছনে কিছু ছিল না। আর, আমাদের আশেপাশেও কিছু দেখছি না। সামনে শুধু দিগন্তের কাছাকাছি পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। আর বলাই বাহূল্য,প্রায় সীমাহীন ধু ধু মরুভুমি যা আমাদের সামনে অনেকগুলো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে সামনের দিগন্তবিস্তারি মরুভূমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আসলে আমরা দৃষ্টির সীমানায় পিরামিড বা পিরামিডের কাছাকাছি ধরনের কিছু একটা চোখে পড়ে কিনা – বের করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ছোটবড় ক্যাকটাসের ঝোপ, কিছু কাঁটা গাছ আর প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কিছু ছোট ছোট ঝোপঝাড় ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না। অল্পক্ষণেই চাঁদি ফাটানো রোদের নামকরণের স্বার্থকতা টের পাচ্ছিলাম। কারণ তাপমাত্র প্রায় ৫০ ডিগ্রির উপরে। এমন গরমে বেশিক্ষণ রোদের নিজে দাঁড়িয়ে থাকাটাও বিপদজনক।
মুখের দিকে তাকিয়ে, প্রথমবারের মতো সেনেগালের এই ক্যাপ্টেনকে দ্বিধান্বিত মনে হলো। আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা হতাশ কন্ঠেই বললো,
- চলো, ফেরা যাক।
ছবিঃ গুগল।
(আরেকজনের কাছ থেকে শোনা গল্প)
শেষ পর্বের লিংক
মরীচিকা (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৪৩