আজ পহেলা বসন্ত। বসন্তের এই দিনটি ঘিরে মৃণের রয়েছে কিছু স্মৃতিমধুর মূহুর্ত। মৃ্ণের মনে পড়ে তখন তার বয়স ৮/৯ হবে মায়ের সাথে গিয়েছিলো লেডিস ক্লাবে। লেডিস ক্লাবের আনাচ কানাচ সেদিন ছিলো ফুলে ফুলে সয়লাব। মৃণকে মা সাঁজিয়ে দিয়েছিলেন ফুলের সাজে। বাসন্তী রঙ্গ শাড়ি। হাতে গলায় ফুলের মালা। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচের আপা যেই নাচটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন "ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কিবা মৃদুবায়" সেটিই নাকি নাচতে হবে তাকে। এমনই বলেছিলেন মা। মৃণ ছোটবেলায় ভীষন চঞ্চল ছিলো। বাবা বলতেন এটি আমার চঞ্চল প্রজাপতি। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি দেখলেই তাই মৃণের মনে হত সে আগের জনমে প্রজাপতি ছিলো। এই আগের জনম পরের জনম বলতো তাদের বাড়ির সেতারার মা। কিছু হলেই বলতো, বাবারে আগের জন্মে না জানি কি পাপ করিছিনু, এই জন্মে মাইনষের বাড়ি খাঁটি খাতি হলো। এই কথা বলে সে যেভাবে চুক চুক শব্দ করতো তা মনে পড়লে আজও হাসি পায় মৃণের।
সে আজ খুব ভোরে উঠেছে। ঘুম ভাঙ্গতেই তার মনে পড়েছে নভোর কথা। ছোট খালা যখন প্রেমে পড়ে। সেই ছেলেকে নানুদের বাড়ির কারো পছন্দ ছিলো না। তাই তখন তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওদের বাড়িতে। নানু বলতেন, চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। ছোট খালা অনেক মন খারাপ করে থাকতো। তার চোখের আড়াল হলেও সেই ছেলে কখনই মনের আড়াল হত না। ঘুমের মাঝেও রাজু রাজু করে চিল্লায় উঠতো। রোজ রোজ চিঠি লিখতো সেই ছেলেটাকে। তারপর জমিয়ে রাখতো। সেই চিঠি পাঠানো হত না কিন্তু খালা রোজ রোজ লিখতো। বলতো যেদিন ওর সাথে দেখা হবে । সব চিঠি দেখিয়ে বলবো।দেখো তোমাকে আমি রোজ কত ভালোবাসতাম। এ কথা শুনলে ওর খুব হাসি পেত। মৃণ তখন সেভেন এইটে পড়ছে। প্রেম ভালোাবসা ভালোই বুঝে সে তখন। ছোট খালা বলতো জানিস? সকালে ঘুম ভেঙ্গেই আমার ওকে প্রথমে মনে পড়ে। এটার কারণ কি জানিস? সকালে ঘুম ভেঙ্গে যার কথা মনে পড়ে সেই মানুষকে তুই ভালোবাসিস। মানে তুই তার প্রেমে পড়েছিস। এ কথা ভেবে সাত সকালেই লাল হয়ে ওঠে মৃণ। তার মানে সে নভোর প্রেমে পড়েছেই।
কিন্তু ছোটখালা? যাক সে সব কথা।
কাল রাতে সেও নভোকে চিঠি লিখেছে। যদিও চিঠিটা তার ঠিক মনের মত হয়নি। মনের ভালোবাসা কোন ভাষায় কিভাবে প্রকাশ করা যায় ভেবেই পায় না সে। আজ নভোকে সে ভড়কে দেবে। কয়েকদিন ধরেই তার নানা রকম ফন্দী বের করেছে সে। এই সন্যাসী বাবার ধ্যান এবার ভাঙ্গিয়েই ছাড়বে সে। একেক ফন্দী ভেবে একেকবার একা একাই হেসে উঠেছে। আর একটু হলে ধরাই পড়ে গিয়েছিলো সেদিন মায়ের কাছে। সেদিন আয়নার সামনে বসে মাথয় ওপর ওড়না তুলে দিয়ে বউ সেজে দেখছিলো নিজেকে আর ভাবছিলো নভো ওকে দেখলে কি ভাবতো এ কথা ভেবে নিজেই হাসছিলো। মা যে কোন ফাঁকে এসে পিছে দাঁড়িয়েছে জানতেও পায়নি। হঠাৎ মা বলে উঠলেন, কিরে বউ সাঁজার এত শখ হয়েছে? তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মৃণের তখন কি যে অবস্থা! মনে হচ্ছিলো ধরণী দ্বিধা হও।
আলমারী খুলে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর বাসন্তী শাড়িটাই বের করে সে। আহা আজি এ বসন্তে গুনগুন করে মৃণ অকারণ আনন্দে।তাড়াতাড়ি গোসল সেরে সাজতে বসে। এমনিতে মৃণ সাজ বলতে একটু পাউডার, আর লিপগ্লস ছাড়া কিছুই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ তার খুব সাজতে ইচ্ছে হলো। শাড়ির সাথে কাজল, টিপ আর
কমলা লিপস্টিকও দিয়ে ফেলে। কানে ঝুমকা পরে আলগোছে হাত খোঁপা করে নেয়। তারপর ইউনিভার্সিটিতে ছোটে। মা রান্নাঘরে বিজি আছেন, মায়ের চোখ এড়াতেই কোনো মতে দূর হতে বিদায় জানিয়ে পালায়। গাড়িতে বসে অকারনেই গান ধরে গুনগুন, 'আজ সবার রঙ্গে রঙ্গ মিলাতে হবে, ওগো আমার প্রিয় তোমার রঙ্গিন উত্তরীয়, পরো পরো পরো তবে' এই যাহ, নভোর জন্য তো আজ বাসন্তী রং পাঞ্জাবী দরকার ছিলো। নভোর কি বাসন্তী পাঞ্জাবী আছে? আচ্ছা ওকে কেমন লাগবে পাঞ্জাবীতে। মৃণের মনে হয় নভো ওর দেখা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুরুষ। নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। আচ্ছা কেউ এইভাবে হাবুডুবু খায়? ছি ছি।
তেজগা লিঙ্ক রোডের সামনে এসে গাড়ী থামায় মৃণ। একছুটে আড়ং এ ঢুকে যায়। অনেকক্ষন ধরেও সে কিছুতেই বাসন্তী রং পাঞ্জাবী সিলেক্ট করতে পারেনা। নভোনীল এর দেবদূতের মত স্বর্গীয় চেহারায় যেন গাঢ় নীল পাঞ্জাবীটাই বেশি মানাবে। নভোনীলকে নীলেই মানাবে বেশি। নিজের মনকে প্রবোধ দেয় মৃণ। মনে বাঁজে নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগলো লাগলো, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগলো;
অস্ফুটে বলে নভোনীল তুমি আমার নীল দিগন্ত আর আমি তোমার নীল দিগন্তের ফুলের আগুন হতে চাই। বসন্তের সৌরভের শিখা ছড়িয়ে যাক চারিদিকে আজ।
চারুকলার সামনে নেমে দেখে কোথাও নভোনীলের দেখা নেই। অথচ কাল এখানেই ওর আসার কথা ছিলো। ভুলিয়ে ভালিয়ে নানা ফন্দী ফিকির করে নভোকে এইখানে আসতে রাজী করিয়েছিলো সে। ভুলেই গেলো নাকি বেটা? রাগ লাগছে মৃণের। সে উদ্বিঘ্ন মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো এমন সময় দুজন ফোটকা ছেলে সামনে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে গান গেয়ে চলে গেলো, সে যে কেনো এলো না কিছু ভালো লাগে না , এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো" তাদের দিকে তাকিয়ে এমন রাগ লাগলো মৃণের। কিন্তু মাথায় ঘুরতে লাগলো সেই লাইনটাই। মজা দেখাবো, মজা দেখাবো।
এমন সময় মহামান্যের দেখা মিললো। ভাঙ্গাচুরা জিন্স আর হাফ স্লিভ কালো রঙ্গের টি শার্ট পরে রাস্তার উলটো দিক দিয়ে হেলে দুলে হেঁটে আসছেন তার স্বপ্ন পুরুষ মিঃ দেবদূত। আচ্ছা ভালো বেয়াক্কল তো? এই দিনে কেউ কালো রঙ্গের কাপড় পরে? আজ কি শোক দিবস? ভাগ্যিস পাঞ্জাবীটা এনেছে সে। নভো ওকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। তারপর এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে। অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। চারুকলা বসন্ত উৎসব থেকে তখন ভেসে আসছে মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে...
ওর দিকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে মৃণ বলে উঠলো, কি দেখছো ওমন করে?
- তুমি এত সেজেছো কেনো? আজ কি তোমার জন্মদিন?
- জন্মদিন মানে? আমি কি আজ একা সেঁজেছি? চারিদিকে তাকিয়ে দেখো তো. সবারই কি আজ জন্মদিন? আচ্ছা তুমি কি বলোতো?
আজ কেউ কালো রঙ্গ পরে? তোমার বাসন্তী না হোক একটাও কি পাঞ্জাবী নেই? আজকের দিনে কি একটুও মনে পড়লো না সে কথা?
- আমি পাঞ্জাবী পরি না।
- কেনো? কেনো পরোনা?
- ভাল্লাগে না।
- ভাল্লাগেনা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! ব্যাগ থেকে পাঞ্জাবীর প্যাকেটটা বের করে মৃণ। নাও এখুনি এটা পরো।
- পরবো মানে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে ?
- আমি জানিনা কেমনে পরবা। পরে আসো যাও।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নভো গেইটের ভেতর দিয়ে বুঝি ওয়াশ রুমের দিকেই যায়। সেই দিকে তাকিয়ে হাসি ফুটে ওঠে মৃণের মুখে। অবাধ্য অবিনীত পুরুষকে বাধ্যগত করাতেই বুঝি নারীর আনন্দ-
বাঁধনকাটা বন্যটাকে মায়ার ফাঁদে ফেলাও পাকে
ভোলাও তাকে বাঁশির ডাকে বুদ্ধি বিচার হরা...
ধীরে ধীরে গেইটের দিকে পা বাড়ায় মৃণ। একটা মেয়ে গান গাচ্ছে। কি সুন্দর করে গাইছে মেয়েটা। মৃণ সামনে এসে বসে।
এতদিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে
বালক বীরের মতন তুমি করলে বিশ্ব জয়
একি গো বিস্ময়!
অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন তূণে?
চারিদিকে এক সমুদ্র থই থই হলুদ বাসন্তী মানুষের মাঝে হেঁটে আসছে নীল রঙ্গের পাঞ্জাবীতে নভোনীল। মুগ্ধ তাকিয়ে আছে মৃণ......
নভো এসে ওর পাশে বসলো। মৃণ আলগোছে ওর কাঁধে মাথা রেখে সামনে তাকিয়ে রইলো। মৃণের খোঁপায় জড়ানো বেলিফুলের মৌমৌ সৌরভ নীলকে ভরিয়ে দিলো। নভো কিছুটা অবাক হলো হয়ত। কিন্তু কিছুই বললো না। বসে রইলো মৌনব্রত সন্যাসীর মত। যেন মৃণ অনন্ত কাল ধরে এভাবেই ওর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে।
মঞ্চে তখন এক জোড়া তরুণ তরুনী নেচে চলেছে....
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
আমার আপন হারা প্রাণ আমার বাঁধনছেড়া প্রাণ
মৃণ নভোর আঙ্গুলগুলির ফাঁকে নিজের আঙ্গুলগুলি শক্ত করে বেঁধে রাখলো........ মৃণের চোখ তখন পানিতে টলোমল যা মন্ত্রমুগ্ধ নভোর চোখেও পড়লো না......
https://www.somewhereinblog.net/blog/rimsabrina/30300148
https://www.somewhereinblog.net/blog/podmopukurblog/30300172
https://www.somewhereinblog.net/blog/meghshuvronil
https://www.somewhereinblog.net/blog/KA13/30301344
https://www.somewhereinblog.net/blog/akhenaten/30301933
https://www.somewhereinblog.net/blog/pulakbest/30302046
https://www.somewhereinblog.net/blog/niazsumon/30302426#c12838473