গুড ফ্রাইডে ও ইস্টার সানডে মূলতঃ খ্রিস্টবিশ্বাসীদের ধর্মীয় উৎসবের দিন। গলগাথা নামক স্থানে যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধকরণ, মৃত্যু ও সমাধি থেকে তাঁর পুনরুজ্জীবনের স্মরণে এ উৎসব পালিত হয়। এ বছর বিশ্বের অধিকাংশ দেশের খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ মার্চ ২৫ তারিখ শুক্রবার এবং ২৭ তারিখ রবিবার গুড ফ্রাইডে এবং ইস্টার সানডে পালন করছে।
যীশুর বিচার সম্পর্কিত শাস্ত্রীয় বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তাঁকে শুক্রবারে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিলো। দু’টি ভিন্ন গোষ্ঠির মতে এটি হয়েছিলো ৩৩ খ্রিস্টাব্দে। আইজ্যাক নিউটন বাইবেলীয় ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং অমবস্যার তিথি বিচার করে গুড ফ্রাইডেরে যে সালটি নিরূপণ করেছেন, সেটি হলো ৩৪ খ্রিস্টাব্দ। ক্রুসিফিকেশন ডার্কনেস এন্ড একলিপস পদ্ধতি নামে একটি তৃতীয় পদ্ধতিতে হিসাব করে গুড ফ্রাইডের বছর নিরূপন করা হয়েছে ৩৩ খ্রিস্টাব্দ।
বাইবেল বা সুসমাচার অনুযায়ী যীশুর শিষ্য যিহুদা ইস্কারিয়াতের সহায়তায় প্রধান পুরোহিত ও বৃদ্ধ নেতাদের পাঠানো লোকেরা লাঠি ও ছোরা হাতে নিয়ে গেৎশিমানি বাগানে যীশুকে গ্রেফতার করে। যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কার স্বরূপ যিহুদাকে ত্রিশটি রৌপ্য মূদ্রা (পবিত্র বাইবেল; মথি ২৬:১৪-১৬) দেয়া হয়েছিলো। যিহুদা প্রধান পুরোহিতদের লোকদের বলেছিলেন যে, তিনি যাঁকে চুম্বন করবেন তিনিই যীশু। যীশুকে গ্রেফতার করে হাননের প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়। হানন ছিলেন সেই বছরের জন্য নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত কায়ফারের শ্বশুর। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে বিশেষ ফল না হওয়ায় তাঁকে প্রধান পুরোহিত কায়ফারের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সাহেড্রিয়ান(প্রাচীন ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ) একত্রিত হয়(পবিত্র বা্ইবেল; যোহন ১৮:১-২৪)।
যীশুর বিচার সভায় বিভিন্ন সাক্ষী পরস্পর বিরোধী সাক্ষ্য প্রদান করেছিলো। যীশু সেই প্রসঙ্গে একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি। অবশেষে প্রধান পুরোহিত নিজে উঠে যীশুকে শপথ পূর্বক নিজ বক্তব্য জানাবার আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, “জীবনময় ঈশ্বরের দোহাই, আমাদের বল, তুমিই কি ঈশ্বরের পুত্র সেই খ্রিস্ট?” যীশু উত্তর দিলেন, আপনি নিজেই তা বললেন। তাছাড়া আমি আপনাদের বলেছি, এখন থেকে আপনারা দেখবেন মানবপুত্র সর্বশক্তিমানের দক্ষিণ পাশে উপবিষ্ট। আবার মেঘবাহনেও তাঁকে নেমে আসতে দেখবেন।” প্রধান পুরোহিত এ কথার জন্য যীশুকে ঈশ্বর নিন্দার দায়ে অভিযুক্ত করলেন(পবিত্র বাইবেল; ২৬:৬৭-৬৬)।
পরদিন সকালে সকল সভাসদগণ যীশুকে রোমান সম্রাট পন্টিয়াস পিলাতের নিকট নিয়ে গেল। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, সিজারকে রাজস্ব দানে বাধা ও নিজেকে রাজা ঘোষণা করার অভিযোগ আনা হলো(পবিত্র বাইবেল; লুক ২৩:১-২)। পিলাত ইহুদী সমাজপতিদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী যীশুর বিচার ও শাস্তি প্রদানের অনুমতি দিলেন। কিন্তু ইহুদী সমাজপতিরা জানালেন আইন অনুযায়ী তাঁদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার অনুমতি নেই(পবিত্র বাইবেল; যোহন ১৮:৩১)।
পিলাত নিজে যীশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এবং ইহুদী বিচারকদের জানালেন যে, তিনি যীশুকে শাস্তিদানের কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। যীশু গালিলিয়ের লোক জেনে তিনি গালিলিয়ের শাসক রাজা হেরোদের উপর যীশুর বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন। হেরোদ তারণোৎসব ভোজসভা উপলক্ষে সেই সময় জেরুজালেমেই ছিলেন। হেরোদ যীশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন উত্তর পেলেন না। তিনি পুনরায় যীশুকে পিলাতের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। পিলাত সমাজপতিদের জানালেন যে, তিনি বা হেরোদ কেউই যীশুকে দোষী মনে করছেন না। শেষে পিলাত সমস্যা সমাধানের জন্য যীশুকে শুধুমাত্র চাবুক মেরে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করলেন(পবিত্র বাইবেল; লুক ২৩:৩-১৬)।
তারণোৎসব ভোজসভার রীতি অনুযয়ী এদিন ইহুদীদের অনুরোধক্রমে রোমানরা একজন বন্দীকে ছেড়ে দিতেন। পিলাত জনসাধারণকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তারা কার মুক্তি চাইছে। প্রধান পুরোহিতদের অঙ্গুলি হেলনে জনগণ খুনী বারাব্বাসের মুক্তি চাইল। পিলাত যীশুকে নিয়ে কি করা উচিৎ সে ব্যাপারে সকলের মতামত চাইলে সকলেই একবাক্যে বললো, “ওকে ক্রুশবিদ্ধ করুন” (পবিত্র বাইবেল; মার্ক ১৫:৬-১৫)। পিলাতের স্ত্রী পূর্ব রাত্রে যীশুকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিনি পিলাতকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, “এ ধার্মিক মানুষটির ক্ষতি করো না” (পবিত্র বাইবেল; মথি ২৭:১৯)।
পিলাত যীশুকে কষাঘাত করে তাঁকে মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে আবার সর্বসমক্ষে নিয়ে এলেন। প্রধান পুরোহিত তখন যীশুর বিরুদ্ধে ঈশ্বর দ্রোহীতার নতুন অভিযোগটি আনলেন। ভয় পেয়ে পিলাত পুনরায় যীশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ভিতেরে নিয়ে গেলেন(পবিত্র বাইবেল; যোহন ১৯:১-৯)। জনতার সম্মুখে এসে পিলাত আবার যীশুকে নিরপরাধ ঘোষণা করলেন। তিনি পানিতে হাত ধুয়ে জানিয়ে দিলেন, যীশুর বিচারে তিনি আর অংশ নেবেন না। তবে সম্ভাব্য দাঙ্গা রোখার জন্য এবং নিজের ক্ষমতা রাখতে পিলাত যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুর নির্দেশ দিলেন(পবিত্র বাইবেল; মথি ২৭:২৪-২৬)। “নাজারাথের যীশু, ইহুদীদের রাজা” লেখা একটি ক্রুশ যীশু বয়ে নিয়ে চললেন গলগাথা নামব স্থানে। তাঁকে ক্রুশবহনে সাহায্য করেছিলেন সিরেন বাসী সিমিয়োন। গলগাথায় অপর দুই অপরাধীর মাঝখানে রেখে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো(পবিত্র বাইবেল; যোহন ১৯:১৭-২২)।
যীশু ছয় ঘন্টা ক্রুশে যন্ত্রণা ভোগ করেন। শেষ তিন ঘন্টায় (দুপুর তিন ঘটিকা থেকে) অন্ধকারে সমস্ত অঞ্চলটি ঢেকে যায়। অতঃপর তিনি চিৎকার করে প্রাণ ত্যাগ করেন। তখন ভূমিকম্প হয়, সমাধিপ্রস্তরগুলো ভেঙ্গে যায় এবং প্রধান মন্দিরের পর্দা উপর থেকে নীচ অবধি ছিড়ে যায়। যে সেঞ্চুরিয়ন ক্রুশবিদ্ধকরণের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন, “ইনি সত্যি সত্যিই ঈশ্বর পুত্র ছিলেন”(পবিত্র বাইবেল; মথি ২৭:৪৫-৫৪)। যীশুর মৃত্যু হয়েছে কিনা তা জানতে পিলাত সেঞ্চরিয়নকে আদেশ দিলেন(পবিত্র বাইবেল; মার্ক ১৫:৪৪)। এক সৈনিক যীশুর দেহে বর্শার আঘাত করাতে ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ও পানি নির্গত হলো(পবিত্র বাইবেল; যোহন ১৯:৩৪)। সেঞ্চুরিয়ন পিলাতকে যীশুর মৃত্যু সংবাদ দিলেন(পবিত্র বা্ইবেল; মার্ক ১৫:৪৫)। এ দিনটি ছিলো শুক্রবার। খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ এ দিনটিকে গুড ফ্রাইডে হিসাবে বিভিন্ন প্রার্থনার মধ্য দিয়ে পালন করে।
সানহেড্রিয়ানের সদস্য যীশুর গোপন অনুসরণকারী আরিমাথিয়ার যোসেফ যীশুর বিচারে সম্মতি দেননি। তিনি পিলাতের নিকট থেকে যীশুর মৃতদেহ চেয়ে নেন(পবিত্র বাইবেল; লুক ২৩:৫০-৫২)। নিকোদিম নামে যীশুর আরেক জন অনুসরণকারী সানহেড্রিয়ানের সদস্য সোয়া মন ওজনের অগরু নিয়ে যীশুর মরদেহ কাপড়ে মুড়তে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলেন(পবিত্র বাইবেল; যোহন ১৯:৩৯-৪০)।
আরিমাথিয়ার যোসেফ যীশুর দেহ পরিস্কার বস্ত্রে মুড়ে ক্রুশবিদ্ধকরণ স্থানের অদূরে একটি বাগানে তাঁর নিজের জন্য নির্মান করা প্রস্তর খোদিত সমাধি মন্দিরে রেখে দিলেন(পবিত্র বাইবেল; মথি ২৭: ৫৯-৬০)। নিকোদিম এলেন সোয়া মন গন্ধরস মেশানো অগরু নিয়ে।
ইহুদী সৎকার প্রথা অনুযায়ী সেগুলো রেখে দিলেন আচ্ছাদন বস্ত্রে যীশুর দেহের সঙ্গে(পবিত্র বােইবেল; যোহন ১৯:৩৯-৪০)। একটি বড় পাথর দেয় তাঁরা সমাধির মুখ রুদ্ধ করে দিলেন (পবিত্র বাইবেল; মথি ২৭:৬০)। সূর্যাস্তের সাথে সাথে সাব্বাস (ইহুদীদের ধর্মীয় প্রথা) শুরু হয়ে যাবে বিধায় তাঁরা শীঘ্র ঘরে ফিরে এলেন (পবিত্র বাইবেল; লুক ২৩:৫৪-৫৬)। খ্রিস্টবিশ্বাসীদের মতে তৃতীয় দিন রবিবার যীশু মৃত্যুকে জয় করে পুনরুজ্জীবিত হন। এদিনটিকেই প্রতি বছর খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ ইস্টার সানডে হিসাবে পালন করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ২:৪৫