#ঘটনা-১
আজাদ সাহেব একজন সরকারী কর্মচারী। এবার তার একমাত্র কন্যা এইচ.এস.সি পাস করেছে। ভর্তিযুদ্ধে মেডিকেল কলেজের সিলেকশন লিস্টে অর্ন্তভুক্তির জন্য কোচিং করছে। নিত্যকার মত মেয়ের লেখা পড়ার খোঁজ নিচ্ছেন। তখন মেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা বাবা মেডিকেল ছাড়া ভার্সিটিতেও কি টেস্ট দিব?" "দিতে পার", আজাদ সাহেবের উত্তর। "তাহলে ভার্সিটিতে কোন সাবজেক্টে পড়ব?, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা? "মুহূর্তেই রেগে গেলেন আজাদ সাহেব। সহসা মেয়ের উপর তিনি রাগেন না। "থাপ্পর দিয়ে তোমার দাঁত ফেলে দিব, আর কোন সাবজেক্ট নাই? দরকার হলে চারুকলা বা বাংলায় পড়বা তাও সাংবাদিকতা না। যত্তসব ফালতু লোকের সাবজেক্ট।"
#ঘটনা-২
আসলাম প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার পর ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। এলাকার চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেটে বন্ধু রুশোদের বাসায় যাচ্ছে। ওদের পাড়ার সগীর চাচা দোকান থেকে অনেকটা বিনয়ের সাথেই (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদে) ওকে ডেকে বিভিন্ন কুশলাদি ও ভার্সিটিতে কোন বিষয়ে পড়ছে এসব জিজ্ঞেস করছিলো। যেই আসলাম উত্তর দিলো যে সে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়ছে, মুহূর্তেই ভদ্রলোকের মুখের রেখা পরিবর্তন হয়ে গেল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি আসলাম কে শুধালেন," ধুরো কি একটা সাবজেক্টে পড়ো যেইডা পইড়া যত্তসব উল্টাপাল্টা খবর লেখবা। নিজেও মরবা বাপ মারেও শান্তি দিবানা....."
#ঘটনা-৩
ক্যাফে দুই ব্যবসায়ীর কথোপকথনঃ
......
আজমলঃ কি অবস্থা ভাই...
আজমঃ আর কইয়েন না, এক সাংবাদিকে প্যারায় পড়ছি, হালায় হুদাই হুদাই বাড়িত আইয়া হুমকি দেয়, চান্দা চায় না দিলে রিপোর্টের হুমকি দেয়..
আজমলঃ...... *রপুত গুলা বেশি বাইড়া গেছে একে তো ভুংভাং নিউজ দেয় তার পর এহন আবার শুরু করছে চাঁদাবাজি। *জাদা গুলা তো আর এমনি এমনি মরে না।
আজমঃ আরে ভাই আমিও কইয়া দিছি, বেশি এড়িতেড়ি করবি তো এক্কেরে আজিমপুর পাডায়া দিমু........ *র বাচ্চা সব গুলা..
.....
উপর্যুক্ত ঘটনা গুলোর একটাও কিন্তু মনগড়া বা বানোয়াট না। বিশেষত শেষেরটাতে এতো পরিমার্জন দরকার হইছে যে আসল ঘটনাটুকুই শুধু বর্ণনা করা লাগছে। যাই হোক বর্তমান কালে বাংলাদেশের সাংবাদিক দের মানুষ মোটামুটি এরকমই সম্মান করে। ব্যতিক্রম আছে দু'এক জায়গায় কিন্তু তা বহুলাংশেই নগণ্য। একসময় সাংবাদিকরা মানুষের শ্রদ্ধার আসনে ছিলো। কারণ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জোড়ে অনেক বড়ো বড়ো পট পরিবর্তনের নজির বাংলাদেশে কম না। সম্পাদকদের তুখোড় সম্পাদকীয় পড়ে মানুষের মাঝে অন্য একটা বোধ জাগ্রত হত। মানুষ অত্যাচারীর মুখোশের ভিতরটা দেখতে পেত বেশ খানিক। আবার শাসকবর্গও সংবাদপত্র গুলোর সংবাদকে বেশ গুরুত্বের সাথেই দেখত। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা আজ মৃতপ্রায়। এখন সাংবাদিকতা হয়ে পড়েছে পক্ষপাতদুষ্ট। একদল আছে সরকারের হাজার নোংরা কাজও সেই লেভেলের রংচং মেরে জনগণের কাজে প্রকাশ করার কাজে, আরেক দল আছে যারা না কোন দলমতের; সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে যাদের রয়েছে এক অটুট বন্ধন। এই দুই শ্রেণির মাঝে আছে আরেক দল। এই আরেক দলটাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব ক্ষতিকর। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ধরুণ আপনি A, সাংবাদিক X কে Y এর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার জন্য ১০০০০০ টাকা দিলেন। কিছুদিন Y এর বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। Y দেখলো এতো বড়ো বিপদ। সে সাংবাদিক X কে ৫০০০০০ টাকা দিলো, টাকা পেয়ে সে আবার আপনি A এর বিপক্ষে সেই লেখা লেখতেছে। আর বোকা পাবলিকও তা খাচ্ছেও সেই। এই হলো বর্তমান কালের সাংবাদিক। যাকে আদর করে হলুদ সাংবাদিকতা (Yellow Journalism) বলা হয়।
আরেক দল আছে তারা আবার একটু স্মার্ট টাইপের। এরা এমনভাবে সংবাদটা লিখবে যেন মনে হবে আহা এরা কতই না মহান। এরা আবার সত্যি কাহিনী কে এমনভাবে লিখবে তা একবারে ফেলে দেবার মতও হবে না আবার খুব ধরার মতও হবে না। কিন্তু এদের সংবাদ পড়ে, অবশ্যই যারা বুঝতে পারেন; মনে হবে সবই ঠিক আছে কিন্তু কি যেন নেই এমন মনে হবে। এদের লেখার ভিতর যেমন অত্যাচারিতের করুণ আর্তনাদ থাকবে ঠিক একই সাথে অপরাধীর জন্যও কেমন একটা সহানুভূতির একটা রেশ থেকে যাবে। আপনি যদি বাংলা পড়ার মত লেখাটা পড়েন তাহলে তাদের কথা খুব একটা বুঝতে পারবেন না। এই সাংবাদিকরা হলুদ সাংবাদিকদের চেয়েও খুবই বেশি ক্ষতিকর। তাদের এই দুমুখো নীতির সংবাদে সাধারণ মানুষ খুব একটা লাভবান না হলেও যাদের দরকার তারা ভালই লাভবান হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ধরুন কোন এক ধর্ষক কোন এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। তো দুমুখো সাংবাদিক তার পত্রিকায় সংবাদটা ঠিকই ছাপিয়েছে কিন্তু মাঝখানে একটা লাইন যোগ করেছে অনেকটা এমন, "বেচারা ধর্ষক পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে"। লক্ষ্য করুন এখানে ধর্ষণের সংবাদ ঠিকই প্রকাশ করছে কিন্তু মাঝখান থেকে ধর্ষককেও আবার বেচারা বলে অভিহিত করছে। আমাদের আবার এমন একটা দেশ যেখানে ১০টা মার্ডার কেইসের আসামীর পক্ষেও আইনজীবী দাঁড়ায় তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। সেসব ক্ষেত্রে এই সামান্য শব্দ চয়নও কিন্তু অনেক বড়ো একটা ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়ায়। এরা অনেকটা চোরকে চুরিও করতে বলে আবার গৃহস্থ কে সর্তকতাও অবলম্বন করতে বলে। সময় বুঝে ভোল পাল্টালেও আম পাবলিক খুব একটা তাদের ধরতে পারে না।
বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ভালো বিপ্লব এনেছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায় শাসক শ্রেণির রোষানলে পড়ে ছাপাখানা বন্ধ হলেও ইন্টারনেট কিন্তু অনেকাংশেই স্বাধীন। তাই যেসব সংবাদপত্রগুলো দৃশ্যত বন্ধ আছে সেগুলো কিন্তু অনলাইনে তাদের উপস্থিতি ঠিকই জানান দিচ্ছে এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। এ উদ্যেগটা অনেকাংশেই সাধুবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু এই সুযোগটা গ্রহণ করছে কিছু ভুঁইফোড় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা নিউজ পোর্টাল গুলো। এরা তিলকে তাল করার ওস্তাদ। আর এরা এতই বস্তুনিষ্ঠ(?) সংবাদ প্রচার করে যে প্রায় সব সংবাদের সাথেই ভিডিও লিংক থাকবেই। আর অধিকাংশ ভিডিও লিংক গুলোই থাকে মূলত বিভিন্ন নীল ছবি বা ঐ ধরণের কোন ১৮+ সিনেমা থেকে কর্তিত দৃশ্যপট। যা আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল সংবাদের সাথে বিরোধপূর্ণ। আরেকটা বিষয় হলো এদের ওয়েব পেইজগুলোতে নোংরা কুরুচিপূর্ণ বিভিন্ন অনলাইন অ্যাডের ছড়াছড়ি। এদের সংবাদ প্রকাশ ভঙ্গি অনেকটা এরম, হয় এরা কোন আদি রসাত্মক গল্প বলছে। যেমন কিছু দিন আগে জনৈক স্বনামধন্য একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে একটা সংবাদ দেখলাম (সঙ্গত কারণে নাম প্রকাশ করা গেল না) একটা সংবাদ দিয়েছে যার শিরোনাম এমন,"মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়েই দরজা বন্ধ করে দিলেন বাবা, এরপর কি হলো তা দেখতে নীচের ভিডিও লিংকে ক্লিক করুন।" আসল সংবাদ টা হচ্ছে মেয়ে স্কুল শেষে সঠিক সময়ে বাসায় না এসে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে নির্ধারিত সময়ের পর বাসায় আসায় মেয়েকে বাসায় নিয়ে শাসন করেন আর একচোট মারধোর করায় মেয়েটা একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্যই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। আর আমাদের সাংবাদিকদের কথা কি আর বলব, কেউ একটু জোরে পাদ দিলেও এরা সেটা নিয়ে রিপোর্ট করে। কিন্তু বিষয় হলো সেই সংবাদের সাথে যে ভিডিওটা শেয়ার করেছে তা রীতিমত একটা ১৮+ ছবির কর্তিত অংশ। আমাদের বাঙালীদের একটা অংশ আবার বিশিষ্ট সাহিত্যিক রসময় গুপ্তের চিকন বইয়ের পাঠক। তারা এহেন টাইপের সংবাদ পেলে আর ছাড়াছাড়ি নেই। একেবারে খুবলে খাওয়ার যোগার। এতে যে বিষয়টা ঘটছে সেটা হলো হু হু করে এসব থার্ডক্লাশ নিউজপোর্টালের ভিউয়ার বাড়ছে আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ নিউজপোর্টাল গুলো।
আমাদের দেশের রাজনীতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে কোন সংবাদ পত্রই সরকারের বিপক্ষে কিছু বলার সাহস করছে না। কারণ হিসেবে এরা দাঁড় করিয়েছে সরকারের বিপক্ষে বলে পত্রিকা ব্যান হবার চেয়ে সরকারের চামচামি করাই শ্রেয়। এই অবস্থার জন্য সাংবাদিকরাই দায়ী। আগে যেকোন পত্রিকার সম্পাদক হত মোটামুটি নিরপেক্ষ লোক। এখন সে রেওয়াজটা পুরোই উল্টে গেছে। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক হচ্ছে তথা কথিত রাজনৈতিক প্রভাবহীন অথচ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পুষ্ট কিছু নোংরা মানুষিকতার অপদার্থের দল। বিভিন্ন সামাজিক অনাচারের বিষয়গুলাও তারা সম্পাদকীয়তে এমন ভাবে লেখে যেন দেশ কতটা শান্ত। আহা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবো না ক আমি.... এতে লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির নোংরা রাজনীতিবিদ আর ভঁইফোর পত্রিকাগুলো। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ জনসাধারণ। যেখানে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয় সম্পর্কে গবেষণা পত্র প্রকাশ করে এই সাংবাদিকগুলো এমন কোন খবরই পায় না।
এদের এই তুমুল মিথ্যাচারিতায়ই সাংবাদিকদের উপর মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দিনকে দিন কমে যাচ্ছে।সাংবাদিকতার অর্থই এরা পরিবর্তন করে ফেলেছে। বর্তমানে এমন এক প্রজন্মের উদ্ভব হচ্ছে যারা বাংলাদেশি কোন চ্যানেলের খবরই দেখে না। আমার এই কথা অনেকের কাছে অবাস্তব মনেই হতে পারে কিন্তু এটাই আসলে বাস্তব। এদেশে বর্তমানে নিউজ চ্যানেলগুলোর খবর দেখে বিশ্বাস করে অকাট বোকা লোক আর বিসিএস পরীক্ষার্থীরা। প্রথম দল দেখে তাদের কোন সেকেন্ড অল্টারনেটিভ নেই দেখে আর দ্বিতীয় দল দেখে নিজেদের স্বার্থের জন্য(পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য)। মূল বিষয়টা দাঁড়ালো বর্তমান সাংবাদিক শ্রেণির প্রতি মানুষের সম্মান সাদা বাংলায় বলতে গিয়ে একেবারেই কমতির দিকে। এ অবস্থার উন্নতি হওয়া আবশ্যক। না হলে একদিন তো দেয়ালে পিঠ ঠেকবে তখন কি করবেন বলুন তো?
এদের ভিতর যে আবার সৎ সাংবাদিক নেই তা নয়। এদের ভিতর ও অনেক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক আছেন যারা একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন। কিন্তু সমস্যা হয়েছে একগাদা পাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার গায়েও একটু ছিটেফোঁটা লাগবেই। তাদের অবস্থা হয়েছে তদ্রুপ। তাদের অনেকেই সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগও করেছে। কি বা করার আছে এছাড়া ? সত্য কথা লিখলে শাসকশ্রেণীর রোষানলে পড়তে হয় আবার নিজের বিবেকবোধও বাধা দেয় তাই বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকেই। বিষয়টা নিয়ে সবারই চিন্তা করা উচিত। কোন জাতি মিথ্যার সাথে চলতে থাকলে প্রতিনিয়ত জাতির প্রাণশক্তি কমতে থাকে। আর সংবাদপত্রকে বলা হয় একটা জাতির দর্পণ। তাই এই বিষয়ে এখনই নজর দেওয়া উচিত। সেই সব সাংবাদিক ভাইদের বলছি, কার বেডরুমের খাট কত হার্টজ (Hz) ফ্রিকোয়েন্সিতে (কম্পন) নড়ছে সেটা নিয়ে নিউজ কাভার না করে কোন কোন সেক্টরে একটা ফাইল ছাড়াতে গেলে ফাইলগ্রহিতার পকেটকে কয়বার ঝাঁকাতে হয়েছে সেটা বের করুন। কিছু মানুষ সেটা পছন্দ না করলেও সব মানুষ অন্তত ঘৃণা করবে না।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


