somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাকাশের সম্রাটঃ গিয়াস আদ-দীন জামশেদ মাসুদ আল-কাশানি—আল-কাশি (১)

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্য-পারস্যের উচ্চভূমিতে, পর্বতমালার গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলে গেছে বিখ্যাত লবণ মরু কাভির-ই-নামাক— উত্তর-পশ্চিমে এলবুর্জ পর্বতমালা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে দাশত-ই-লুতের মরু পর্যন্ত। আর কাভির-ই-নামাকের প্রান্তভাগে মেয়েদের শাড়ির আঁচলের মতো বালিয়াড়ির ভেতর এঁকেবেঁকে চলেছে সওদাগরদের বাণিজ্য পথ। ক্বুম থেকে কেরমান পর্যন্ত এরকমই একটি পথের ধারে ইস্ফাহানের কাশান নগর—ঊষর, রুক্ষ প্রকৃতিতে শ্যামল ছায়াঘেরা, খেজুরবীথি শোভিত এক মরুদ্যান।

একদিকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো বিশাল কাভির, অন্যদিকে স্নিগ্ধ শান্ত সবুজ মরুদ্যান, ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পথিকরা দুদণ্ড জিরিয়ে নেয় কাশানে, আর সুপ্রাচীন এলুমাইটদের আমল থেকেই কাশান গড়ে উঠে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে। উটের পিঠে সওদাগররা আসে কাশানের বিখ্যাত কার্পেটের খোঁজে, আসে তার সিরামিক টালি, চকচকে রেশম, তাম্র ও মর্মর পাথরের তৈজসপত্র এবং গোলাপজলের সন্ধানে । এসব ছাড়াও কাশানের মানুষ গর্ব করে আরেকটি বিশ্বাস নিয়ে, যে গর্ব করত তাদের পূর্বপুরুষগণও—জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণ করে প্রাচ্যদেশীয় যে তিন জন জ্ঞানী পুরুষ বেথেলহেমের স্বর্গীয় নবজাতকের জন্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন কাশানেরই সন্তান।


১৪২০ খ্রিস্টাব্দের উষ্ণ এক অপরাহ্ন। কাশানের বিখ্যাত বাজারে ভেষজ ঔষধপাতি নিয়ে বসে আছেন একজন চিকিৎসক, শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্য চেহারা, অন্তঃকরণটিও কোমল তাঁর। নাম গিয়াস আদ-দীন জামশেদ মাসুদ, কাশানের সন্তান হওয়ায় নামের সাথে যোগ হয়েছে আল-কাশানি, ফলে তাঁর পুরো নাম গিয়াস আদ-দীন জামশেদ মাসুদ আল-কাশানি। ইস্ফাহানে তিনি পরিচিত জামশেদ নামে, আর ইস্ফাহানের বাইরে তাকে মানুষ চেনে মূলত আল-কাশানি হিসেবে।


“পেটের ব্যথাটা আবারও বেড়েছে, বাবা জামশেদ।” বোরখা পড়া বৃদ্ধা এক মহিলা এসে সামনে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকান জামশেদ, তাঁরই পাশের গাঁয়ের জোবাইদা বেওয়া।
“এই লতাটা পরিষ্কার করে ছেঁচে এক বাটি পানির সাথে মিশিয়ে খাবেন।” বেতের শীতল পাটি থেকে একগোছা জংলা লতা তুলে নেন জামশেদ। “তিন দিন খেলেই আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে। প্রতিদিন দুটি করে লতা ছেঁচলেই হবে। আর সবসময় পরিষ্কার পানি পান করবেন, খাওয়াদাওয়ার প্রতি যত্ন নিবেন।”
“আল্লাহ তোমার ভাল করবেন, বাবা।” বোরখার ভেতর থেকে কিছু খেজুর বের করেন জোবাইদা বেওয়া, চিকিৎসার পারিশ্রমিক, অথবা তা মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসারই প্রকাশ।

পরিষ্কার পানি আর ভালো খাবার! জোবাইদা বেওয়া চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জামশেদ—কাশানের মানুষের জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! ইস্ফাহানের ঐশ্বর্য হারিয়ে গেছে ঘেঙ্গিস-পৌত্র হালাকু খানের ঘোড়ার খুরের আঘাতে। তবু যখনই সামলে উঠেছিল সেবারের ধাক্কা, তখনই স্তেপের উচ্চভূমির কনকনে শীতের ভেতর থেকে জ্বলন্ত অগ্নিঝড়ের মতো এসেছে তৈমুর লঙ, ঘেঙ্গিসের রক্তবীজ খোঁড়া তৈমুর, পারস্যের পথে পথে রেখে গেছে মানুষের মাথার খুলি।

প্রথম পতন ঘটে রে নগরের, সেই ১৩৮৪ সালে। জামশেদের বয়স তখন মাত্র ৪ বছর, ছোটবেলার কথা তার মনে পড়ে না তেমন। বড় হয়ে শুনেছেন বাবা আর অন্যান্য পড়শীদের মুখে। ১৩৮৬ সালে অবরুদ্ধ হয় ইস্ফাহান, তৈমুরের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার জামশেদের প্রিয় ইস্ফাহান।

ইস্ফাহানের দেয়াল টপকে গুণে গুণে ৭০,০০০ সৈন্য পাঠায় তৈমুর, একটিমাত্র আদেশঃ সবাইকে একটি করে মাথা নিয়ে আসতে হবে। তৈমুরের রক্তলোলুপ বাহিনীতে তারপরও এমন কিছু সৈন্য ছিল যাদের কাছে নিরীহ মানুষের শিরচ্ছেদ ছিল অসহনীয়, ফলে তারা অন্যদের কাছ থেকে মাথা ক্রয় করতে লাগল। সৈন্যদের প্রাচুর্যের কমতি নেই, আর ইস্ফাহানেও অভাব নেই মানুষের মাথার, ফলে খুব তাড়াতাড়িই মাথার মূল্য নেমে আসল এক স্বর্ণমুদ্রা থেকে অর্ধ-স্বর্ণমুদ্রায়। ইস্ফাহানের দেয়াল ঘেঁষে ৭০,০০০ খুলি দিয়ে পিরামিড নির্মাণ করে বিজয়োৎসব পালন করল খোঁড়া তৈমুর।


এরপর দ্রুতই পতন ঘটে শিরাজের—মহাকবি হাফিজের শহর, গোলাপ ও আনন্দের শহর শিরাজ। বৃদ্ধ হাফিজ, কবিদের সম্রাট, তখনও বেঁচে ছিলেন। আমির তৈমুর ডেকে পাঠায় তাঁকে শিরাজের দরবারে। রোষকশায়িত লোচনে হুঙ্কার ছাড়ে, "এত বড় সাহস তোমার, এ-কী লিখেছ তুমি?
আগার আন তুর্ক ই শিরাজ বা-দাশত আরাদ দিল এ মা রা
বা খাল এ হেন্দুয়াশ বাখশাম, সমরখন্দ ও বোখারা রা!

[শিরাজের প্রিয়া যদি রাখে দিল মোর, তার হাতের পরে,
তার কপোলের এক কৃষ্ণ তিলক তরে
সমরখন্দ আর বোখারাকে আমি বিলাই অকাতরে ]

"আমার এই ঝলসে উঠা তরবারি দিয়ে পদানত করেছি জনপদের পর জনপদ, তাদের সম্পদ দিয়ে বছরের পর বছর তিলে তিলে গড়ে তুলেছি সমরখন্দ আর বোখারাকে, আর তুমি, ছেঁড়া পোশাকপরা ভিখিরি, শিরাজের কোন মেয়ের সামান্য তিলের বিনিময়ে তা বিলিয়ে দিচ্ছ!"
"এভাবে দান করেই নিঃস্ব আজ আমি, হে আমির, আর গ্রহণ করে তুমি হয়েছ ঐশ্বর্যশালী।" দীপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেন কবিদের সম্রাট।


অসি সম্রাটের মুখে কথা সরে না, বিস্ময় শ্রদ্ধায় অবনত হয় নিষ্ঠুর হৃদয়। ১৩৯০ সালে মারা যান হাফিজ, তৈমুরের অনুরোধ সত্ত্বেও তার দরবার প্রত্যাখান করেন। পারস্যের গুলবুলিস্তানের মহান গোলাপ জননী জন্মভূমিকে ছোট করেননি, ভাবেন জামশেদ।

১৪০৫ সালে শিরদরিয়ার তীরে মারা যায় তৈমুর, পূর্ব তৈমুরিদ সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তার পুত্র শাহরুখ। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে থাকে এরপর, কারণ পিতার রক্ত-লোলুপতা পাননি শাহরুখ, আর শাহরুখের স্ত্রী গওহর শাদ পারস্যেরই মেয়ে। এখন অবশ্য মঙ্গোল সাম্রাজ্যের তখতে বসছেন শাহরুখ-গওহর শাদের পুত্র উলুঘ বেগ, শাসন করেন সমরখন্দ থেকে।

সূর্য ঢলে পড়ছে দিগন্ত রেখায়, মাগরিবের সময় হয়ে এলো। জিনিসপত্র গুছাতে থাকেন জামশেদ, বাড়ি ফিরতে হবে।
"আরে, জামশেদ! কবে ফিরলে ইস্পাহানে? এবার কোথায় গিয়েছিলে?"
"আরে, আহমাদ যে!" ছেলেবালার বন্ধুকে দেখে চেহারা উদ্ভাসিত হয় জামশেদের। "এবার গিয়েছিলাম শিরাজ, ফিরলাম গতকাল।"
"তুমি এক আজব মানুষ বটে, জামশেদ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াও এই বয়সে। কত হলো? প্রায় চল্লিশ, তাই না? এভাবে নগরে নগরে হেঁটে মানুষকে চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের কীএমন রহস্য শিখিয়ে বেড়াও, আর তাতেই তোমার কি উন্নতি হচ্ছে? রাহা খরচটাও তো উঠে না। তা না করে আরেকটু সংসারী হলে অনেক সচ্ছল থাকতে আজ।"

মুচকি হাসেন জামশেদ, "একদিক থেকে তুমি ঠিকই বলেছ, আহমাদ। হয়তো বৈঠকখানায় কাশানের কার্পেট পাততে পারতাম আজ, পুরোনো এ জোব্বার পরিবর্তে হয়তো থাকত চকচকে রেশুমের পাঞ্জাবি; এসব জীবনের উন্নতিরই পরিচায়ক বটে। আবার ক্বুম থেকে শিরাজে, শত শত মানুষের সামনে যখন প্রকাশ করি সেই চন্দ্রগ্রহণের রহস্য যা আমি অবলোকন করেছিলাম ১৪০৬ সালে, কিংবা চন্দ্রগ্রহণের পরের বছর লেখা আমার প্রথম গ্রন্থ সুল্লাম আল-সামা তথা মহাকাশের সিঁড়ি থেকে যখন যুবকদেরকে পড়ে শোনাই, তখন তাদের চোখে অন্যরকম একটা আভা দেখি; আমার কাছে এ-ও জীবনের উন্নতি, সবচেয়ে বড় সাফল্য, প্রিয় আহমাদ। ভিন্ন দুটি সাফল্য থেকে একটিকে আমি বেছে নিয়েছি মাত্র। তুমি জানো, নিজে নিজেই লেখাপড়া শিখতে হয়েছে আমার, জীবিকার কষ্টটা ছিল বড়, তার চেয়েও বড় কষ্ট ছিল কেতাব-পুঁথি কিনতে না পারা। তাই আমি চাই, জানার মধ্যে যে অপার আনন্দ, মানবকল্যাণে এর যে অপরিমেয় অবদান, পারস্যের সন্তানেরা তা শিখুক আরো সহজে।"

আহমাদ অনেক কিছুই মেলাতে পারেন না তার বন্ধুর, কিন্তু জানেন জ্ঞানী এক খাঁটি মানুষ জামশেদ।
“চাচ্চু, চাচ্চু, দাদাজান তোমাকে এক্ষুণি বাড়ি যেতে বলেছেন। সমরখন্দ থেকে ঘোড়ায় চড়ে সৈন্য এসেছে!" দৌঁড়ে ছুটে এসে খবর দেয়এক বালক।
সমরখন্দ থেকে! অবাক হন জামশেদ।
“কেন? কয়জন এসেছে রে, রাশেদ?”
“জানি না। বিশ জন, সবার হাতে বল্লম আর কোমরে তলোয়ার। তিন জনের হাতে তীর ধনুক।” হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয় রাশেদ।

আহমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন জামশেদ। সাথে আসতে চাইলে বাঁধা দেন আহমাদকে, কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে বন্ধুকে জড়াতে রাজি নন তিনি। বাড়ির পথ ধরেন জামশেদ।

[চলবে]

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৩৬
৩১টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×