somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পৃষ্ঠা নাম্বার চারশত তিন

১৭ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ১০:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মিতুকে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে বেশ ক’দিন যাবত। হাসপাতাল টু বাসা, বাসা টু হাসপাতাল। তার উপর আছে মেয়েকে স্কুলে দেওয়া ও স্কুল থেকে নিয়ে আসা। রান্না বান্নাসহ সংসারের হাজারটা কাজ মিতুকে একাই সামলাতে হয়।

সারাদিন এত ধকল যায় যে, নিজের শরীরের প্রতি নজর দেওয়ার সময় নেই। মিতুর বাবার অবস্থা ভালো না। ঢাকায় এনে নিজের বাসায় রেখে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে মিতু। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বাবা গ্রামেই থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে তার বাবা আজগর সাহেবের পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়েছে।

আজগর সাহেব অবশ্য গ্রাম থেকে শহরে আসতে চাননি। তিনি চেয়েছেন যা হবার তা হবে। শেষ বয়সে আর এসব অপারেশন করে নিজের শরীরকে কাঁটা ছেড়া করবেন না।

কিন্তু মিতু নাছোড়বান্দা সে তার বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছে যে, এখন তো আর আগের যুগ নেই। এখন কত জটিল জটিল অপারেশন করা হয় আর এটা তো সামান্য পিত্ত থলির পাথর। ফুটা অপারেশন করে সহজেই পাথর বের করে ফেলা যায়।

আগামীকাল বাবার অপারেশন। সে মনে মনে মানত করেছে যদি অপারেশন সাকসেসফুল হয় তাহলে সে এতিমখানার বাচ্চাদের সবাইকে একদিন বিরিয়ানি খাওয়াবে।

সন্ধ্যায় বাবাকে দেখে এসে মেয়ের জন্য নাস্তা বানানোর পর এক কাপ চা খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকলো । শরীরের ক্লান্ত ভাব চলে গেলে সে বাবার ব্যাগটাকে আবার গুছাতে শুরু করল। বাবার লুঙ্গি, গামছা আরও যা যা লাগে তা হাসপতালাতে দিয়ে আসতে হবে।

বাবার ব্যাগে সবসময় একটা দুইটা বই থাকে, ডায়েরী থাকে, কলম থাকে জামা কাপড়ের সাথে।

কি মনে করে ডাইরিটা খুলে চোখ বুলাতে থাকলো মিতু। বাবার হাতের লেখা কি সুন্দর ! এখনও যেন ম্লান হয়নি। হঠাৎ চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল মিতুর।

চৌত্রিশ বছর আগের এই দিনে বাবা লিখে রেখেছেন ঘটনাটি -

আজকে মনটা ভালো নেই। একমাত্র মেয়েটার গল ব্লাডার স্টোন ধরা পড়েছে। এত অল্প বয়সে মেয়েটার পিত্তে পাথর ধরা পরল সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

মিতুর মা মনোয়ারা কেঁদে কেঁদে একাকার। এত অল্প বয়সে কেন বাচ্চার এমন কঠিন রোগ হলো। একটার পর একটা রোগ লেগেই থাকে, হয় ঠান্ডা, নয়তো জ্বর, নয়তো পেট ব্যথা আর এখন তো বড় অসুখ ধরা পড়েছে।

আল্লাহ এখন আমি কি করবো, কোথায় যাব। আমি আর সয্য করতে পারিনা। মনোয়ারার শেষ কথাগুলো যেন পাথরের মত আঘাত করে যাচ্ছে আমার বুকে।

স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের গলাটাই কেমন অদ্ভুত কণ্ঠ শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে এখনই বুঝি কান্না বেরিয়ে আসবে। মেয়েটা যদি বাবা-মা দুজনকে কাঁদতে দেখে তাহলে সে ঘাবড়ে যাবে।

তাই স্ত্রীকে অভয় দিয়ে বলি-আরে এত টেনশন এর কি আছে, কান্নার কি আছে ? আল্লাহর পক্ষ থেকে রোগ এসেছে আল্লাহই নিরাময় করবেন। দেখিনা ডাক্তাররা কি বলে ? যদি ঔষধের মাধ্যমে না সারে তাহলে অপারেশন করাবো। তুমি এত ভেঙ্গে পড়না।

হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে মেয়েকে জড়িয়ে মনোয়ারা বেগম আরেকবার কেঁদে উঠলো। মেয়ে মিতুকে খাওয়ানোর সময় কেঁদে ওঠে, ঘুম পাড়ানোর সময় কেঁদে ওঠে। নামাজ পড়ার সময় কেঁদে ওঠে । মোটকথা শয়নে স্বপনে যখনই তার মনে পড়ে মেয়ের পিত্ত থলিতে পাথর তখনই সে কেঁদে ওঠে।

পাঁচ বছরের মিতু বাবাকে বলে, মা এত কাঁদে কেন ?মাকে যখই দেখি তখন শুধু কান্না করে।

মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, মায়ের মন ভালো নেই তাই কাঁদে। মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে আমারও চোখে পানি চলে আসে ।

সেদিন মিতু খেলা করছিল খেলনা নিয়ে।তার মা পাশের রুমে নামাজ পড়ছিল। সে নামাজ শেষে দোয়া করছে আর কান্না করছে খোদার দরবারে। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে ভাল করে দাও। আমার মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

কোন ফাকে আমার চোখে যে পানি জমেছে টের পাইনি। মেয়ে হঠাৎ তাকিয়ে বলে, বাবা তোমার চোখেও পানি !

আমি অন্য দিকে মুখ সরিয়ে বলি, আমি চোখ কচলিয়েছি তো তাই পানি জমেছে। মনে হয় চোখে কিছু একটা পড়েছে।

মেয়েকে কি করে বলি, ওরে এই পানি তো তোর জন্য, এই কান্না তো তোর জন্য। তোর কিছু হয়ে গেলে কি করে থাকবো রে মা, কি করে বাঁচবো। কি দিয়ে নিজেকে বুঝ দেবো।

অনেকে অনেক পরামর্শ দিল। ঢাকায় বড় ডাক্তারের কাছে নেওয়ার আগে হোমিও ওষুধ খাওয়ানো শুরু করলাম। অনেকের নাকি ঔষধ সেবনে পিত্তের পাথর হোমিও সেরে যায়। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছে হয়তো সেরে যেতে পারে।

মেয়ে ওষুধ খেতে চায় না ঝাঁজ লাগে কিন্তু তবুও তিন বেলা তাকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে।

এক মাস পর আবার আল্ট্রা করা হলো কিন্তু রিপোর্ট ভাল আসেনি। তেমন কোন উন্নতি হয়নি আগের মতই রয়েছে গলব্লাডার স্টোনটা।

মনে যতটুকু আশা বেধেছিল তাও আবার হতাশায় নিভে গেল ।আবার অস্থিরতা দেখা দিল মেয়েকে কোথায় নিব, কি করব। টেনশনে টেনশনে আমাদের দু’জনের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। সন্তান ভাল না থাকলে বাবা মা কি করে ভাল থাকে।

সবার পরামর্শ আর ধৈর্য ধরে তিন মাস হোমিও খাওয়ানোর পর আল্ট্রা করে দেখা গেল পাথরটা গলে গেছে। মেয়ের রোগ মুক্তি হয়েছে এর চেয়ে জীবনে বড় আর কোন চাওয়া নেই। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।


ডায়রির পাতা থেকে চোখ ফিরায় মিতু। বাহিরে তুমুল অন্ধকার । কখন রাত্রি হয়ে গেছে সে টের পায়নি। মিতুর চোখে পানি চলে আসে। এক সময় বাবা মেয়ের জন্য কেঁদেছে এখন মেয়ে বাবার জন্য কাঁদে। মিতুরও বাবার মত ডাইরি লেখা অভ্যাস রয়েছে। সে ও নিয়মিত ডায়রি লিখে।

মিতু ভালভাবে খেয়াল করল আজকে তার ডায়েরির লেখার পৃষ্ঠা নাম্বার চারশত তিন। কি কাকতালীয় ব্যাপার। বাব আর মেয়ে একই পাতায় একই কাহিনী লিখে রাখছে। সময় বুঝি এমনই কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে সবার অগোচরে।

বাবা তাকে নিয়ে লিখেছে সেই কত বছর আগে সেটা ছিল চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠা। আজ এতটা বছর পর সে বাবাকে নিয়ে লিখছে সেটাও চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠা।

মিতুর স্বামী হাবিব অফিস থেকে ফিরে বলল, কি ব্যাপার এত চাপের মধ্যে থেকেও তুমি ডাইরি লিখতে বসলে। অন্য সময় যখন অবসর থাকবে তখন না হয় লিখতে ।

মিতুর মুখ থেকে কোন কথা বা প্রতিউত্তর না শুনে সে মিতুর কাছে এসে বসলো। স্ত্রীর চোখে পানি দেখে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল যে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।

মিতু বাবার ডায়েরির কথা খুলে বলল হাবিব কে।

হাবিব বলল, এটাই নিয়তির খেলা । একসময় বাবা সন্তানের জন্য নিজের সবটুকু উজার করে বাঁচিয়ে তোলে আবার বাবা যখন শেষ বয়সে অসহায় হয়ে যায় তখন সন্তান বাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

আজগর সাহেবের অপারেশন সাকসেসফুল হল। মিতু তাকে জিজ্ঞেস করল বাবা তুমি কি খাবে? তিনি সানন্দে বলে উঠলেন গ্রিল আর বাটার নান।

মেয়েকে অবাক হতে দেখে আজগর সাহেব ভালোভাবে চারপাশ দেখে বুঝতে পারলেন তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। তখন তার মনে হল যে উনি অপারেশনের রোগী তাকে এই মুহূর্তে এই খাবার দেওয়া হবে না । তাই তিনি চুপ করে থেকে বললেন, কিছু তরল খাবার দাও।

নাতনি মেহরিমা বলে উঠলো, নানা ভাইয়া তোমাকে কি আইসক্রিম দেবো, নাকি চকলেট দেবো।

আজগর সাহেব বললেন, তোমার যা খুশি দাও আমার খেতে না নেই। আজগর সাহেব আবার খুনসুটিতে মেতে উঠলেন। দেখে কে বলবে তার অপারেশন হয়েছে।

আজগর সাহেব বাসায় ফিরলেন। আনন্দে ভরে উঠলো একটি পরিবার। মিতু ফিরে পেলেন বাবাকে। এভাবেই বারবার ফিরে আসুক বাবা নামের বট বৃক্ষের ছায়া সন্তানের উপর।


ছবি সৌজন্য-ব্লগার নামে বইয়ের পোকার পোস্ট থেকে নেওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ১০:৫৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৩

লিখেছেন মোহাম্মদ আলী আকন্দ, ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:৩২

সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (৮)
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: শুভঙ্করের ফাঁকি: (১)

সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে মোট ১৮টি ধারায় মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গল্প প্রকাশিত হবার পর নিষিদ্ধ হয়

লিখেছেন জাহিদ শাওন, ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:৫০


এক কাপ চা, শীতের সন্ধ্যায় বেশি ঝালের ভর্তায় মাখানো চিতই পিঠার অজুহাতে বুকপকেটে কতবার প্রেম নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম সে গল্প কেউ জানে না।
আজকাল অবশ্য আক্ষেপ নেই।
যে গল্প... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশের মিলিটারীকে ক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৩:২৪



১৯৭১ সালের জেনারেশন'এর কাছে ইন্দিরা (১৯১৭ - ১৯৮৪ ) ছিলেন ১ জন বিশাল ব্যক্তিত্ব; যু্দ্ধ লেগে যাওয়ার পর, উনি বলেছিলেন যে, বাংগালীরা ভালো ও নীরিহ জাতি, তিনি এই জাতিকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৩

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৮:২৩

জুলাই ১৮: ছাত্রলীগের হামলা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে ১৭ই জুলাই কমপ্লিট শাট ডাউন কর্সুচী ঘোষনা করে বৈষম্যিরোধী ছাত্র সংগঠন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সঠিক ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইসরায়েল নামক গজবে আক্রান্ত

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×