কাঁচভাঙার মত ঝনঝনে উচ্ছসিত হাসির শব্দে মনযোগ টুটে গেল প্রলয়ের। অনেক কষ্টে ঘুরে তাকানো থেকে নিজেকে সংযত করল। গোধূলি, নামটা ওকে মানায় না। মেয়েটা এত উচ্ছল, প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরপুর, জীবন ওর প্রতি পদক্ষেপে ছাপ ফেলে যায় সুস্পষ্ট। ওর নাম হতে পারতো প্রভাতী, যখন প্রাণের সাড়া নিয়ে সূর্য হেসে উঠে। কিংবা মধ্যাহ্ন, যখন মাথার ওপরে সূর্য জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। হতে পারতো বৈকালী, বিকেলের নরম রোদে যে সময়টা কোমল হাসি হেসে থাকে। গোধূলির বিষন্নতা ওর সাথে খাপ খায় না। প্রলয় খুব সাবধানে ঘুরে তাকায়। গোধূলি দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে পাখির মত উড়ে যাবার ভঙ্গিতে ঘুরছে বন্ধুদের চারদিকে, আর হেসে কুটিকুটি। এত ছেলেমানুষ এখনও! এমন পাগলি!
দেখতে দেখতে প্রলয়ের মুখের হাসিটা আস্তে মিলিয়ে যায়, চোখদুটো জ্বালা করে ওঠে। ও মাথাটা একটু ঝাকায়, যেন কিছু ঝেড়ে ফেলবে। তারপর আবার তাকায়, খুব ভালভাবে। ওর মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠে।
রাত, রুমের সবাই ঘুমে অঘোর। কম্পিউটারের সামনে প্রলয়। পাগলের মত হার্ডডিস্কের হাজারটা ফোল্ডারের ভিড় থেকে অনেক যত্নে লুকিয়ে রাখা, খুব সচেতনভাবে ভুলে থাকা একটা ফোল্ডার খুঁজে বের করে প্রলয়। একজন মানুষ, কিছু ছবি, কিছু মূহুর্ত, চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে আছে ফ্রেমের চারদেয়ালে। দেখে প্রলয়, মেলানোর চেষ্টা করে পাগলের মত। বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের সামনে জমে ওঠা কুয়াশার জালটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। মাউসের ওপর হাতটা কাঁপে। প্রলয় দেখে পাশাপাশি রাখা দুটো ছবি। এত মিল! এত মিল! কি করে সম্ভব?
>>শোনো, শোনো একটা কথা বলি। তুমি যতবার প্রেমে পড়বা সেটাই তোমার লাইফের ফার্স্ট টাইম, ঠিক আছে? সেই একই ফিলিংস, একই সব। আর কখনো...কখনোই কম্পেয়ার করতে যাবা না। প্রতিটা মানুষ আলাদা। যার যার মতন। তুলনা করবা কেন? আজব!
---কিন্তু আপু, বিশ্বাস কর এত মিল দুজনের চেহারায়.....চোখ, চিবুক, হাসি.......................। আমি দুজনের ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলাম!
>>তোমাকে আমি কতদিন বলছি পুরানো ছবিগুলো ডিলিট করে দাও। কেন রেখে দিছো, হ্যাঁ? তোমার কি আর কোন ফিলিংস অবশিষ্ট আছে? এতটুকুও? ডু ইউ স্টিল লাভ হার?
---আপু, পারি না যে!
>>পারতে হবে। পারতে হবে তোমাকে। পাস্ট ইজ পাস্ট। ঝেড়ে ফেলে দাও সেটা। ভুলে যাও যে চলে গেছে তাকে। সে তোমার অনুভূতির এতটুকু মূল্য দেয় নাই। তারজন্য তুমি কেন তোমার সময় নষ্ট করবা? তোমার লাইফ তোমার, সেইটা নিয়ে এখন ভাবো। লক্ষ্মী ভাই আমার.................
অধরা কথা বলে যায়। বকা দেয়, আদর করে বোঝায়, হাসে, অনুনয় করে। প্রলয় শুধু চুপ করে শোনে। শুনতে শুনতে হারায় একটা খুব সুরেলা একটানা কথার স্মৃতিতে। একটা সময় ছিল যখন এই কথার স্রোতে ভেসে যেতো প্রলয়ের সময়ের সব হিসাব-নিকাশ। প্রলয় হারিয়ে যেতো, ডুবতো, ভাসতো, তার সারা পৃথিবী ছিল ওই একটা কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, হাসির ঝংকার, আদর মেশানো অদ্ভূত সব আবদার। কথার পিঠে কথা দিয়ে সাজানো রূপকথা। একই স্বপ্নে বিভোর, একই সুরে বেজে চলা, বয়ে চলা একই পথে।
ভালবাসা...... ভালবাসা........গাঢ় নীল আকাশটাকে রাঙিয়ে, সাজিয়ে, দাপিয়ে উড়ে চলা লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনী একদল ঘুড়ি...........স্বপ্নালু চোখ...........হাসিমাখা মুখ..........বুক ভরা ভালবাসা..........ভালবাসা...........
বোওওওওওও কাট্টা............!!! সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা পাক খেতে খেতে পড়ে যাচ্ছে। নাআআআআআ..............প্রলয় ব্যাকুল হয়ে হাত বাড়ায়, ধরতে পারে না। ঘোর কুয়াশা এসে ঘিরে ধরে ওকে, আচ্ছন্ন হয়ে যায় নীল আকাশ, ডুবে যায় প্রলয় গাঢ় অন্ধকারে।
---আপু ওকে আমি এত ভালবাসতাম! ও আমার নিজেরই একটা অংশ ছিল। যেমন আমার একটা হাত কিংবা চোখ কিংবা হৃদয়।
>>কিন্তু ও তো বোঝেনি, তাই না? তোমার ভালবাসাকে পায়ে দলে চলে গেছে।
---ও বলেছে ফিরে আসবে।
>>তোমার কাছে?
---না, শুধু দেখতে আসবে আমি কেমন আছি।
>>খুব ভাল আছো তুমি। বল, ভাল আছো! সে তো তার লাইফটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে, রঙিন করেছে স্বপ্নগুলো। তুমি কেন ধূসর তাহলে? একজনের জন্য লাইফ থেমে থাকে নাকি!
---আমি আর ভালবাসতে পারবো না আপু। ভালবাসা মরে গেছে।
>>ভালবাসা মরে না কখনো। গোধূলিকে ভালবাসনি?
---আহ........গোধূলি! ও কেন এল আমার জীবনে? ও উচ্ছল একঝলক বাতাসের মত, ঝলমলে এক গোছা জরির রিবনের মত, টুকটুকে, চঞ্চল একটা চড়–ই পাখির মত। আমি ওর কাছে যেতে পারি না, ভয় হয় বড়। আমি দূরেও সরে থাকতে পারি না, ভীষণ কষ্টে দুমড়ে যাই। ওকে চাইতে পারি না, অত দুঃসাহস নেই আমার। ওকে ছাড়াও চলবে না, আমি এত অসহায়।
>>তুমি ওকে বলছো না কেন বলতো? না পারলে বল, আমিই গিয়ে জানিয়ে আসি।
---না আপু, ও আমার না, হবে না কখনো। আমি পরম যত্নে আগলে আছি অন্যের সম্পদ।
>>সোনাভাই আমার.............
...................নিরবতা......................নিরবতা.................নিরবতা.........................কেউ কিছু বলে না। কিছু নেই বলার।
ঝকঝকে নীল আকাশের নিচে এক টুকরো সবুজ। জীবনের ঐশ্বর্যে ভরপুর। প্রলয়ের সাজানো বাগান। গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে ভালবাসায় জড়িয়ে আছে দুটো গোলাপ.......প্রলয়-প্রিয়তা। ভালবাসা.....................ভালবাসা.................বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, তারপরেও ভালবাসা। প্রলয় সে ভালবাসার ফাক-ফোকর খুঁজে পায়নি। লখিন্দরের লোহার বাসরেও কালসাপ ঢুকেছিল। আর এতো কেবল একটা বাগান। বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, ফাক ফোকরের কমতি নেই। সন্তর্পণে ঢুকে পড়া কালসাপের প্রথম ছোবলের বিষে নীলে নীল, তারপর কাল, বিষাক্ত বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটা। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। হাত বাড়িয়ে, চোখ পুড়িয়ে প্রলয় দেখে প্রিয়তান চলে যাওয়া। নীলকন্ঠের বিষে আকণ্ঠ নিমজ্জিত প্রলয় শুধু বিড়বিড় করে বলে যায়, “ভাল থেকো, ভাল থেকো, যেখানেই থাকো, ভাল থেকো...........”
প্রিয়তার হিসহিসে স্বর চাবুকের মত আছড়ে পড়ে, “অভিশাপ দিয়ো না বলছি। অভিশাপ দিয়ো না।”
শিউড়ে উঠে প্রলয়। “অভিশাপ! অভিশাপ!” দুমড়ে যায়, কুকড়ে যায়। “কেন চলে গেলে সোনাপাখি? কি নেই আমার! কি দিইনি তোমাকে!”
“কি আছে তোমার! একবার নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন করো। আমার পাশে দাঁড়াবে! তোমার প্রতিবিম্বই তোমার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পাবে।”
“তোমাকে ভালবেসেছি। এক আকাশ সমান ভালবাসা, সাত সমুদ্র ভালবাসা। নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারি তোমার জন্য।”
বিষ ছড়ায় প্রিয়তার মুখ থেকে ছিটকে পড়া প্রতিটি শব্দ, “হাহ! ভালবাসায় কি হয়! বেঁচে থাকার জন্য ভালবাসাই সব নয়। তোমার জীবন নিয়ে আমি কি করবো? আমার যা প্রয়োজন তা তোমার নেই........নেই........নেই........নেই.........”
ভেসে যেতে যেতে মিলিয়ে যায় প্রিয়তার স্বর। প্রলয় নীল হয় গভীর বিষাদে, আচ্ছন্ন হয়, ডুবে যায়। আর খুঁজে পায় না, কখনো না।
>>আমি তার সব চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছি, মুছে ফেলেছি সব মেসেজ, সব মেইল ডিলিট করে দিয়েছি। ভালবাসা বলে কিছু নেই। ভালবাসা মরে গেছে।
---কাঁদে না লক্ষ্মী আপু। সব ঠিক হয়ে যাবে।
>>ভালবাসা মরে গেছে সোনাভাই। ভালবাসা মরে গেছে।
রুমে যেতে ইচ্ছা হয় না প্রলয়ের। অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে মাঠে। সিগারেটের ধোঁয়া দেয়াল তৈরি করে তার চারপাশে। সে দেয়ালের বাইরে সব আবছা, অস্পষ্ট, আচ্ছন্ন। ঝাপসা চোখে গোধূলিকে দেখে প্রলয়, দূরে, অনেক অনেক দূরে। খুব ইচ্ছা হয় কাছে যায়, ভালবাসে। কিন্তু কিছুতেই পারে না। গোধূলি দূরেই থেকে যায়, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, ভালবাসা যায় না। ভালবাসা মরে গেছে।
....................................................................................................
যার জন্য প্রযোজ্য: প্রলয় হেরে গেছে; হেরেছে অধরাও। কিন্তু তোমাকে জিততে হবে সোনা ভাই। তোমাকে আমি হেরে যেতে দিবো না।