somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুহক

০৬ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি জানি ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, সবসময় জানতাম। সে প্রস্তুতি আমার মনে মনে নেয়াই ছিল। আমি জানতাম কারণ আমি কখনো কাউকে ধরে রাখতে পারি না। কিংবা আমি নিজেই হয়ে উঠতে পারি না কারো অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ সারারাত আমার সেই বিদায়ের প্রস্তুতিই নেয়া।



আর কখনো ফিরবো না, এটা স্থির করেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা কখনো ভাবি নি একসাথে থাকবো। হয়তো আমরা দুজনই ভয় পেতাম অনেক। ভয়টা যে আসলে কিসের, তাও আমি নিশ্চিত নই। হতে পারে হারানোর, হতে পারে আমরা দুজনই বিশ্বাস করতাম 'ভালবাসার মৃত্যু ঘটে মিলনে। একসাথে থাকা আর অভ্যাস পাশাপাশি থাকা চিরচেনা দুটো মানুষকে অচেনা করে তোলে, ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু বিরহ তা কিছুতেই হতে দেয় না। বরং স্মৃতি রয়ে যায় জ্বলজ্বলে, চির নতুন।' যদিও আমরা কখনো কথাগুলো নিয়ে কোন আলোচনা করি নি। যেমন কখনো বলি নি 'ভালবাসি", তার কোন প্রয়োজন ছিল না আসলে কখনোই। আমরা এই সম্পর্কটার নাম দেই নি কোন, নাম ছিল না আমাদের পরস্পরের প্রতি এই অদ্ভূত অনুভূতিরও, আমি তাকে কখনো ডাকিনি প্রেমিক বা অন্য কোন নামে। সে আমার নিজেরই একটি অংশ ছিল, যার কোন নাম দিতে নেই।

কোন পিছুটান আমার ছিল না, কোন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিলাম না দুজনের কেউ। তাই যখন চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, কষ্ট পেলেও ও আমাকে কিছুই বলে নি। একবারও বলে নি, 'যেয়ো না', কারণ জানতো তাহলে আমি রয়ে যেতাম। ও সেটা চায় নি, চাইতে নেই। তাই ভাবতো সে।

সব সব কিছুতেই অদ্ভূত রকমের মিল ছিল আমাদের, আমাদের রুচি, পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন, ভাবনা...কিন্তু তারপরও মিল হল না আমাদের। আমি ওর কাছে একটা জিনিসই চেয়েছিলাম। ও হয়তো ভেবেছিল আমার অন্য সব খেয়ালের মত এটাও নিছক একটা ছেলেমানুষি। কিন্তু আমার জন্য সেটা কেবলই একটা খেয়াল ছিল না। আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, একমাত্র সম্পদ আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি।

যখন আমার ভিসা হয়ে গেল, আর তিন সপ্তাহ পরেই আমি চলে আসছি জানলাম নিশ্চিতভাবে, তখনই আমি আমার ভেতরে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। একটা স্বপ্নের মধ্যে, একটা ঘোরের মধ্যে তখন আমার বাস। আমি চলছিলাম যেন চাবি দেয়া কোন পুতুলের মত। আমার সেই স্বর্গীয় অনুভূতির কথা, সেই গর্বিত অর্জনের কথা জানাইনি আমি কাউকে, এমন কি তার বাবাকেও না। একা বয়ে বেড়িয়েছি সমস্ত কিছু, যেমন তাকেও আমার একাই বইতে হয়েছে।

একদিন জানতে চেয়েছিলাম, 'যদি কখনো আমি হারিয়ে যাই, কেমন লাগবে তোমার?' এইসব কিশোরীসুলভ আবেগ তার কাছে অর্থহীন মনে হলেও ওইদিন সে কিছুটা আপ্লুত হয়েছিল। ক্ষণিক নিরব থেকে উত্তর দিয়েছিল, 'উদভ্রান্ত লাগবে'। তার কতটা উদভ্রান্ত লেগেছিল আমার দেখা হয়ে ওঠে নি, কারণ আমি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলাম ছেলেকে নিয়ে। হ্যাঁ, ছেলে! বরাবর লক্ষ্মী মিষ্টি একটা মেয়ের স্বপ্ন দেখলেও আমার পুতুলের মত একটা ছেলে হল!

চলে আসার পর কম কষ্ট করতে হয়নি আমাকে। যে সময়টায় আমাদের দেশের মেয়েরা আত্মীয়, বন্ধু দিয়ে ঘিরে থাকে, অনেক আদর আর যত্নে থাকে সেই সময়টা আমি কাটিয়েছি একদম একা। শুধু তাই নয়, প্রতি মুহূর্ত আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে টিকে থাকার। স্টুডেন্ট ভিসায় এলেও শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারিনি পড়া, অসুস্থ শরীর, চিকিৎসার অর্থ যোগাড় সবকিছু নিয়ে বড্ড এলোমেলো ছিলাম তখন।

আমার ছেলেটা বড্ড লক্ষ্মী! কিভাবে যেন বুঝতে পারতো মা'র কতটা কষ্ট হয়। কোনদিন সে কিচ্ছু নিয়ে অভিযোগ করেনি। চুপচাপ সয়ে গেছে যেকোন কষ্ট, যেকোন মন খারাপ কিংবা অভিমান ভুলে গিয়ে চেষ্টা করেছে মাকে খুশি করার, একদম সেই ছোট্টবেলা থেকে। একাই তার বাবা-মা, পুরো পরিবার হতে চাইলেও সে যে তার বাবাকে মিস করে নি তাতো নয়। আট বছর বয়স পর্যন্ত বহুবার সে জানতে চেয়েছে বাবার কথা। কিন্তু তারপর যখন তাকে বললাম, 'আর দশটা বছর অপেক্ষা কর। বলবো তোমাকে সবই', থেমে গিয়েছিল সে।

যে গভীর প্রেম আর ভালবাসায় আমি একটি প্রাণকে পৃথিবীতে এনেছিলাম, তা বোঝার ক্ষমতা এ পৃথিবীর খুব কম মানুষেরই ছিল। তাই আমাকে লুকাতে হয়েছিল ওর অস্তিত্বের কথা সবার কাছে। বারবার দেশ থেকে তাড়া এলেও ফিরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবিনি আমি। বয়ে বেড়িয়েছি দুটো সত্ত্বাকে, বাস করেছি দুটো পৃথিবীতে। যার একটার পুরোটা জুড়েই আমার ছেলে, আমার বাস্তব; আর অন্যটা ভান, যেখানে সবাই আমাকে জানে বড্ড নি:সঙ্গ।

মাঝে মাঝে হয়তো মনে হয়েছে আমি কি ঠকালাম ওকে! তাকে কোন পরিবার বা স্বাভাবিক জীবন আমার দেয়া হল না। বাবার ভালবাসা ও পেল না। কিন্তু পরক্ষণেই উপলব্ধি করেছি, না, ঠকাইনি। আমি জানতাম এই বাস্তবতা মেনে নেয়ার মানসিক শক্তি ওর বাবার ছিল না। সে হয়তো এড়িয়ে যেতে চাইতো এই সত্যিকে। কিংবা মেনে নিলেও সাময়িক আবেগে অন্ধ হয়ে হয়তো পেতে চাইতো আমাদের দুজনকেই, পূর্ণ করতো এই পরিবারটাকে। কিন্তু খুব বেশিদিনের জন্য না। একসময় সে মুক্তি পেতে চাইতো এই বন্ধন থেকে। কখনো না পাওয়া হয়তো সহ্য করা যায়, কিন্তু পেয়ে হারানোর কষ্ট আমি আমার ছেলেকে দিতে পারি না। তারচেয়ে হারিয়ে যাওয়া অনেক সহজ সমাধান।

দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলাম আমি তাকে। আসার আগে ছিল ফেব্রুয়ারি মাস, আমি তাকে নিয়ে ঘুরে এসেছি বইমেলা। সে প্রাণের স্পন্দন সে ঠিকই অনুভব করেছিল, তাকে আমি দেখিয়েছি বসন্ত উৎসব, তাকে আমি শুনিয়েছি সমুদ্র গর্জন, দেখিয়েছি পূর্ণিমা রাতের অপার্থিব সৌন্দর্য। আমি জানি সে সবই অনুভব করেছে, হোক না তখন তার বয়স মাত্র মাইনাস পাঁচ সপ্তাহ। যেভাবে সে অনুভব করেছে আমার হৃদম্পন্দন প্রতি মুহূর্তে, আমি জানি সেভাবেই সে দেখেছে আমার চোখে প্রতিটি জিনিস। আর সেজন্যই এত দূরে জন্মেও, কোনদিন না দেখেও সে গভীরভাবে ভালবাসে তার দেশকে। যেমন সে ভালবাসে তার বাবাকে। যাকে সে কখনো দেখে নি, যার নামও তার জানা নেই...অথচ তার প্রতিটি চিন্তা অনুভব জুড়ে সে আছে। আমি যখন ছেলের দিকে তাকাই, ওর বাবাকেই দেখি। ও যখন হাসে, দুষ্টুমি করে চুল ঝাকায়, উদার গলায় গান গায় কিংবা খুব গভীর কোন চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলে অবলীলায় ওর লেখার খাতায়...আমি প্রতি মুহূর্তে সেখানে শুধু ওই একজনের ছাপ দেখতে পাই। আমার কি কষ্ট হয়! নাহ.......বরং অদ্ভুত গর্ববোধে আমার বুক ভরে যায়।

ছেলেকে নিয়েই আমার পৃথিবী, ওকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি পুরো আঠার বছর। আর কিছু নিয়ে ভাববার অবসর আমার ছিল না। এমন নয় যে এরমধ্যে আমার জীবনে অন্য কেউ আসে নি, চেয়েছে আমার এবং ছেলের দায়িত্ব নিতে, হতে চেয়েছে আমার নির্ভরতা, আশ্রয়। কিন্তু কখনো আমি কাউকে মেনে নিতে পারি নি। মনে হয়েছে অন্যায় করা হবে, ছেলের বাবার সাথে তো বটেই, এমন কি ছেলের সাথেও। মা'র প্রতি আস্থা হারাবে সে। আমি কখনো সেটা চাই নি।

আমি কখনো তাকে জানাইনি কেন আমরা ছেড়ে গিয়েছিলাম পরস্পরকে, কেন একটি অসম্পূর্ণ পরিবারে তার বাস, জানাইনি কে তার বাবা। কিন্তু আমি কথা দিয়েছিলাম জানাবো। যখন তার বয়স আঠারো হবে, যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হবে, যখন স্বাবলম্বী, স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, যখন সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখবে।

কাল ছেলের আঠারতম জন্মদিন। জানি, সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে আমার কাছে নিজের গল্প শোনার। সে অপেক্ষা করে আছে মা তার কথা রাখবে। ছেলেকে আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছি, শিখিয়েছি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে, ছেলেকে আমি নিজের চেয়ে ভাল চিনি, যেমন চিনতাম ওর বাবাকে। আমি জানি ও ফিরে যাবে বাবার কাছে। নিজের ভেতরে ওর অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যাকে ছেড়ে আমি একদিনও কাটাইনি, জানি সেই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে অবলীলায়। আমিতো এটা সবসময়ই জানতাম। আমি কোনদিন কাউকে ধরে রাখতে পারি নি, যেমন আঠার বছর আগে আমার পুরো অস্তিত্ব দিয়েও ধরে রাখতে পারি নি ওর বাবাকে।

আজ সারারাত আমার কাল ভোরের জন্য অপেক্ষা, প্রস্তুতি আসন্ন বিদায়ের।



শিরোনাম কৃতজ্ঞতা: রানা ভাইয়া
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:১৬
৬৪টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×