somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দীপ্তিমান ছায়ামানুষেরা

২২ শে জুলাই, ২০১১ ভোর ৫:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি বসেছিলাম একা...অন্ধকার একটি ঘরের মাঝখানে...যেখানে জ্বলে আছে এক চিলতে আলো.......আর ছিল তারা, সবাই.......একসাথে......



গলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের ভেতর হাতুড়ির ধুপধুপ, বহুচেষ্টাতেও নাড়াতে পারছি না হাত কিংবা মাথা। কিছু পরে যখন সম্বিত ফিরে পেলাম কাঁপছি তখন থরথর করে। সারা গা ভিজে গেছে ঘামে।

রোজ রাতে ভীষণ আতংকে আমি জেগে উঠে বসি, ঠিক এই সময়টাতেই। রাতের অন্ধকার চিরে আলো জেগে ওঠার ঠিক আগ মূহুর্তে যখন আঁধারটা হয়ে উঠে খুব খুব গাঢ়, তখনই তারা আসে। রোজ.......কী ভীষণ মূর্তি তাদের! আমার ঘুমটুকুর প্রতি তাদের বড় লোভ। ক্লান্ত আমি যখনই লোভীর মত ঢলে পড়ি ঘুমের কোলে, তারা এসে হাজির হয়। আজ আমি চারদিক বনে ঘেরা ছোট্ট একটা ঘরে আটকা পড়েছিলাম। তারা এসেছিল রাতের চেয়েও গাঢ় অন্ধকার, ঘুটঘুটে কাল নেকড়ে হয়ে। ঘিরে ছিল আমার নড়বড়ে ছোট্ট ঘরখানা। অন্ধকারে তাদের ঝকঝকে দাঁত আর জ্বলজ্বলে চোখ জেগে ছিল। শুধু অপেক্ষা...কখন তারা বেরিয়ে আসবে তাদের হিংস্রতর রূপটি নিয়ে।

এমনি করেই প্রতি রাতে আসে তারা, কোনদিন হিংস্র কোন পশু হয়ে, কোনদিন নিষ্ঠুর দানবের রূপে কিংবা অশরীরী কোন ছায়া হয়ে। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত আমার বহু প্রার্থিত, আরাধ্য ঘুমকে নিয়ে নিষ্ঠুর হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। ভীত আমি নিজেই নিজেকে আঁকড়ে ধরে চেয়ে থাকি শূণ্য চোখে অন্ধকারে...কোন এক অদৃশ্য শিল্পী নিপুণ হাতে তার ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে সেই অন্ধকারকে হাল্কা করে তোলে। ঘুমহীন আমার চোখের কোলে জমা হয় রাত্তিরের কাল।

আমার আজকাল ক্রমাগত জড়িয়ে পড়া বিষন্নতার জালে এ যেন তাদের এক নিষ্ঠুর পরিহাস। জড়িয়ে পড়ছি গাঢ় নীল নীল বিষাদের অলীক এক চাদরে। হাচড়ে পাচড়ে যতই নিজেকে জাগাতে চাইছি ততই যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ছি। যেন পানিতে ডুবে যাওয়া একজন মানুষ। হাত-পা ছুঁড়ে যতই মাথা জাগাতে চায় ততই আরো বেশি করে তলিয়ে যায়। তলিয়ে যাচ্ছি বিষন্নতায়। আবার, আরেকবার এর মুখোমুখি হতে হোক আমি চাইনি।

আজকাল মাঝে মাঝে নিজেকেই খুঁজে পাই না। সবার মধ্যে থেকেও আমি যেন নেই, হারিয়ে গেছি কোথায়! একটা ভীষণ খাড়া দেয়াল খাদের একেবারে কিনারায় যেন দাঁড়িয়ে আছি টলমলে পায়ে। আর এক পা এগুলেই হারিয়ে যাবো অতল গহবরে। আমি নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ঠিক হল কি ভুল...যা করছি, যা করেছি তাতে কতটুকু দায় নিজের, কতটুকু আমাকে স্বীকার হতে হয়েছে পরিস্থিতির, চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আমার ওপর...এমনি সব চিন্তায় দিন-রাত আমি অস্থির হয়ে থাকি। এক দন্ড সুস্থির হয়ে বসতে পারিনা কোথাও। কেবলই মনে হতে থাকে ভুল হল, কোথায় যেন ভীষণরকম ভুল হল। আমার অলস মস্তিষ্ক সারাক্ষণ ডুবে থাকে গভীর কিন্তু নিস্ফল সব চিন্তায়। যার একমাত্র গন্তব্য হল নিজেকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যাবজ্জীবন বা তারচেয়েও কঠিন কোন শাস্তির বিধান দেয়া। সত্যিই এটা আমার কতখানি প্রাপ্য তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। শুধু এতটুকু জানি আমার অবচেতন মন ক্রমাগত হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার প্রতিপক্ষ, দ্বিতীয় একটি সত্ত্বা...যার সাথে এই দুর্বল আমি একটু একটু করে হেরে যাচ্ছি। মাথা পেতে নিচ্ছি তার দেয়া অপবাদ, মেনে নিচ্ছি সব ধরনের অন্যায় শাস্তি।

আমার ঘাড়ে সওয়ার হওয়া সেই অন্ধকার অপদেবতাটি রোজ ক্লান্তিহীনভাবে তার সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে চলেছে আমার ঘুমের ঘোরে। যতভাবে সম্ভব দেখিয়ে চলেছে ভয়, যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়ি আমি, মেনে নিই তার আধিপত্য। আমি নই...আমি নই...আমার এই প্রায় অনিচ্ছাকৃত দুর্বল আকুতিটুকু তার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও মর্মে পৌঁছে না। আমার ভেতরের শ্বেতপোশাকের ছোট্ট পরীটি ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। একসময় হয়তো তাতে আর একবিন্দু শুভ্রতার লেশ অবশিষ্ট থাকবে না। অক্ষম আমি গভীর বিষাদে চেয়ে থাকি তার দিকে।

রোজ রাতে তারা আসে। ভোর হবার ঠিক আগে যখন অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে ওঠে, শান্তিময় গভীর ঘুমে ডুবে থাকে চরাচর, ঠিক সেই সময়টায় জেগে উঠি আমি। এক অবর্ণনীয় আতংকে জমে যাই আমি, আমাকে গ্রাস করে নেয় সেইসব লোভী নেকড়ের দল, ছায়াময় অশরীরী, কিংবা ভীষণ দর্শন সব দানব। রাতের পর রাত তারা চালিয়ে যায় তাদের এইসব তান্ডব।




সে রাতেও এসেছিল তারা। সবাই...একসাথে...
চাপ চাপ অন্ধকার ঘরটির ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা বিছানা, তার মাঝে বসে আছি আমি। আমাকে জড়িয়ে আছে মিষ্টি আদরের মত এক পশলা কোমল আলো।

অবাক চোখে আমি দেখছিলাম নিজেকে। বেশ রঙচঙে দামী একটা শাড়ি পরে, খুব সেজেগুজে বসে আছি আমি। একা.....যেমন রোজ থাকি.....আর তারা সবাই মিলে ঘিরে ছিল আমাকে, সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে বিছানার চারধারে। আবছা অন্ধকারে তাদের ছায়া ছায়া মূর্তি দেখা যাচ্ছিল শুধু। বিভিন্ন বয়সের, নারী-পুরুষ-শিশু...সবারই পরনে একইরকম পোশাক, ফ্যাকাশে রঙের ফতুয়া আর পাজামা, যেমনটা অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর আগে পরানো হয় রোগীকে। মরার মত ফ্যাকাশে তাদের মুখ, ভাবলেশহীন চোখ...একদৃষ্টে দেখছে সবাই আমাকে। সেই দৃষ্টিতে সবকিছু ছাপিয়ে কি যেন এক মায়া! বিদায়ের গভীর বিষাদ!

তাদের হাতে ছিল ফুল। রাশি রাশি ফুল। তাদের মতই ফুলগুলোও ছিল নিষ্প্রান, ফ্যাকাশে ধূসর...যন্ত্রের মত তারা ফুলগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিল বিছানায় বসে থাকা আমার দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার! ফুলগুলো যখনই আমার কাছাকাছি, আমাকে ঘিরে থাকা আলোর বলয়ে এসে পড়ছিল, তারা ফিরে পাচ্ছিল প্রাণ, উজ্জলতা, এমনকি বর্ণও। ফ্যাকাশে ধূসর ফুলগুলো হয়ে উঠছিল নানা রঙে রঙিন।

আমার এত কাছে তারা কখনোই আসেনি। হাত বাড়ালেই যেন তাদের আমি ছুঁতে পারি। তবু আমার হাত বাড়ানো হয় না। আমার বিছানাটি ঝলমলে, রঙিন ফুলে রাঙিয়ে দিয়ে একে একে তারা মিলিয়ে গেল আঁধারে। আর ধীরে ধীরে আলো হয়ে উঠল আমার পুরো ঘরটিও।



সে রাতের পর আর কখনো আসেনি তারা। সে রাতের পর আর কখনো আমার অবচেতন মনের সাথে, অন্ধকার অপদেবতাটির সাথে ছোট্ট সাদা পরীটিকে যুদ্ধ করতে হয় নি। জানতে পেরেছিলাম আমার সঠিক অবস্থানটি, ভুল অথবা সঠিক-দুটোই। আমার মনে হয়েছিল অন্ধকার থেকে আলোর জগতে আমাকে ফিরিয়ে দিতেই তারা এসেছিল......... সবাই, একসাথে........


আমার পৃথিবীটাকে উজ্জ্বল, আলোকিত, বর্ণিলতায় পূর্ণ করে তারা হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য........




............................................................

বহুদিন আগে দেখা একটি স্বপ্ন অথবা দু:স্বপ্ন হাসান মাহবুবকে বলতে বলতে ঠিক করলাম যে দুজন নিজেদের মত করে লিখবো। সেই চেষ্টাই করা হল এখানে। নামটাও হাসানের কাছ থেকেই পাওয়া।
কেউ কখনো খুঁজে কি পায়... আমার স্বপ্নটি নিয়ে লেখা হাসানের গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:০৭
৪৭টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×