প্রতিদিন যখন ক্লাসে ঢুকি শুনি বাচ্চারা ক্রমাগতই হিন্দী সিনেমা, নায়ক-নায়িকা, কার্টুন ক্যারেক্টার নিয়ে গল্প করে যাচ্ছে। এমনকি খুব সাবলীলভাবে হিন্দী বলেও তারা। ১৪ই ডিসেম্বর ক্লাসে ঢুকে বাচ্চাদের নাম ডাকলাম, পিছন ফিরে বোর্ডে তারিখ, উপস্থিত-অনুপস্থিত লিখছি আর শুনছি ওরা গল্প করছে 'কে রা-ওয়ান, কে জি-ওয়ান' সেসব নিয়ে। আমি ঘুরে খুব ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ১৪ই ডিসেম্বর দিনটা সম্পর্কে কে বলতে পারবে। কি হয়েছিল ওই দিনে?
তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর একজন বলল, আজকে ভিক্টরী ডে। আর এরকজন বলল, বড়দিন। আমি ওদের এ্যাসাইনমেন্ট দিলাম যেন সবাই বাসায় যেয়ে পত্রিকা পড়ে আর আজকের দিনটা সম্পর্কে জেনে আসে। পরদিন তাদের আমি জিজ্ঞাসা করবো।
আমার এই বাচ্চাগুলো ক্লাস থ্রিতে পড়ে। টিচারস রুমে ফিরে যখন ঘটনাটা বললাম, সিনিয়র ক্লাসের এক শিক্ষক তাঁর পর পর তিন ক্লাসে অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেন একই কথা। নবম শ্রেণীর পড়ালেখায় খুব খারাপ, অমনোযোগী, ভয়ংকর দুষ্ট একটা ছেলে ছাড়া কেউ উত্তর দিতে পারল না।
কিন্তু এসব বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ১৫ই আগস্ট কি? আমি জানি তারা খুব সহজেই জবাব দিবে, ভারতের স্বাধীনতা দিবস। চাই কি জাতীয় সঙ্গীতটাও শুনিয়ে দেবে নির্ভুলভাবে। ১৪ই আগস্ট সম্পর্কেও তারা জানে বেশ ভালভাবেই। কিন্তু বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের চরম বিতৃষ্ণা। এক বাচ্চাকে বলছিলাম সামনে পরীক্ষা, বাংলাটা আগে শেষ কর। সে কিছুক্ষণ বইটা উল্টে পাল্টে করুণ মুখে বলছে, মিস কেন বাংলাই পড়তে হবে! সে অন্য যেকোন কিছু পড়তে রাজি, বাংলা বাদে। আটাত্তুর মানে ও লেভেল পড়ুয়া এক ছাত্র বলছিল, এইটি এইট।
কেন?
আজ সন্ধ্যায় যখন ওর বাসায় গেলাম, দেখলাম ওর মা গভীর মনযোগ দিয়ে ফুল ভলিউমে হিন্দী সিরিয়াল দেখছে। তিনি উঠে গেলে ছেলেরা হিন্দী কার্টুন দেখবে, এটাই স্বাভাবিক।
খুব ছোট ক্লাস থেকে শুরু করে একদম উঁচু ক্লাসের বাচ্চাদের আমি দেখেছি কি ভীষণভাবে তারা হিন্দীতে আসক্ত! ইংরেজী মাধ্যম স্কুল বলে বাংলা ক্লাস ছাড়া অন্য যেকোন সময়ে তারা বাধ্য ইংরেজীতে কথা বলতে। শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে কড়াকড়ি। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণীতো বটেই, প্রথম শ্রেণীর বাচ্চাদেরও আমি দেখেছি অবলীলায় হিন্দী বলছে, কোথাও তাদের বাধছে না। সমস্তক্ষণ তারা বিভিন্ন চ্যানেল আর চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। তারা শুদ্ধ, সঠিক ইংরেজী শিখছে না। তারা বাংলাও শিখছে না, বাংলা-ইংরেজী খুবই বিচিত্র উচ্চারণে একটা আজগুবী ভাষায় কথা বলে। কাঁচের উপর ধারাল কিছু টানলে যেমন গা শিউড়ে উঠা কিঁইইইইইচ একটা শব্দ হয়, ওই ভাষাটা শুনলে ঠিক একই অনুভুতি হয়।
তবে তারা হিন্দীটা রপ্ত করেছে বেশ ভালভাবেই।
কেন?
কারণ তাদের শেখানোর কেউ নেই। বাবা-মা সমস্তক্ষণ এত ব্যস্ত যে তাঁরা সন্তানকে ভাষা, দেশ, সাধারণ জ্ঞান, ন্যায়-নীতি, ভাল আচরণ-মন্দ আচরণ, বড়দের সম্মান, বন্ধুদের সহযোগিতা, নৈতিকতা কিচ্ছু শেখাতে পারেন না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কে, কিংবা মেসি কোন দেশের খেলোয়াড় এই সাধারণ উত্তরগুলোও তারা দিতে পারে না। যখন তখন বন্ধুর সাথে মারামারি, নোংরা ভাষায় গালাগালি শুরু করে দেয় খুব সামান্য, তুচ্ছ কারণে; শিক্ষকের সামনেই। শিক্ষককে দেখে পথ ছেড়ে দেয় না, বরং তাঁকেই নেমে যেতে হয় পথ থেকে। কত অবলীলায় তারা বলে দেয়, I hate Bangladesh! কেন? কারণ বাংলাদেশ সবকিছুতেই হেরে যায়, সবকিছুতেই পিছিয়ে।
আমার মনে পড়ে না ছোটবেলায় আমাকে কেউ খুব যত্ন নিয়ে দেশ, স্বাধীনতা, দেশপ্রেম এই জিনিসগুলো সম্পর্কে বলেছিল। এ সম্পর্কে আমার জ্ঞান পাঠ্যবইয়ের পড়া পর্যন্তই সীমিত ছিল বরাবর। আমি নিজে খুব যে সচেতন ছিলাম তাও আমি কখনো বলি না। বরং অনেকটাই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া ছিলাম। কিন্তু তারপরও যখন বাংলাদেশের খেলা হয়েছে আমি রুদ্ধশ্বাসে দেখেছি, উত্তেজনায় ছটফট করেছি; পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যখনই বাংলাদেশ নিয়ে কোন কথা শুনেছি আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছে; ইতালি থেকে চাচা একবার এক ভাইয়ের জন্য শার্ট এনেছিলেন, আনার পর দেখা গেল তাতে লেখা 'মেইড ইন বাংলাদেশ', তখন বোধহয় আমার বয়স বার কি তের, কি খুশিই না লেগেছিল তখন! আনন্দে শিরশির করেছে সমস্ত শরীর। কোথায় পেয়েছিলাম এই বোধ?
ছোটবেলায় আমি আর ছোট ভাই খুব ঝগড়া, মারামারি করতাম, সারাক্ষণ লেগে থাকতাম একজন অন্যজনের পিছে। কিন্তু বাইরের কেউ যদি ওকে কিছু বলতো, আমি দুহাতে ওকে আড়াল করতাম, প্রয়োজনে নিরীহ, মৃদুভাষী আমি গাল ফুলিয়ে ঝগড়াও করতাম। আমার এক বন্ধু ছিল খুব হিংসুটে। ও একবার অনেক নিচু মন্তব্য করেছিল আমার পরিবার নিয়ে, আমি ওর সাথে বহুদিন কথা বলি নি। আমার স্কুলটার ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও মান ছিল খুব খারাপ। কিন্তু আর কোন স্কুলকে আমি কোনদিন ভাল বলি নি। আমারটাই সেরা। আর যখন দেশের প্রশ্ন আসে, অনেক গর্ব আর অহংকার নিয়ে আমি বলি, আমার বাংলাদেশ...সকল দেশের সেরা...
আমার এই বোধের জন্ম হয়েছিল আমার পরিবার থেকে, আমার স্কুল থেকে, হৃদয়ের খুব গভীর থেকে।
এখনকার বাবা-মা ভুলেও ভাবে না বাচ্চাদের কিছু শেখানোর আছে তাদের। এক গুচ্ছ টাকাসহ ঘাড়ে গাদা গাদা বই চাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু স্কুলেই বা কে শেখাবে! ওইদিন যখন আমি অক্ষম রাগে, দু:খে, হতাশায় টিচারস রুমে ফিরে চিৎকার করছিলাম খুব বয়স্ক দুজন শিক্ষক ছাড়া কারো কোন সমর্থন পাই নি। বরং একজনকে দেখেছি মাথা নিচু করে ব্যঙ্গের হাসি হাসতে। ক্লাস পার্টি বলে একটা বিচিত্র সংস্কৃতি এদের আছে। স্কুল থেকেই তখন সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সারাদিন ধরে তারা উঁচু শব্দে হিন্দী গান চালাতে থাকে আর সেই সাথে চলতে থাকে নাচ। শিক্ষকেরাও ওইদিন বাচ্চাদের সাথে তাল মেলান। গত ক্লাস পার্টিতে আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে গানটার সাথে বাচ্চারা, শিক্ষকরা একই তালে নাচছে সে গানটা আমি কোনদিন এর আগে শুনিওনি। ওদের সবার মাঝখানে নিজেকে একটা আজব চিড়িয়া লাগছিল। দুই শিক্ষকের মুখে সেদিন বিজয় দিবস এবং পতাকা নিয়ে এত অবমাননাকর কথা শুনেছি যে পরের দুই দিন আমি আর তাদের সাথে কথা বলতে পারি নি।
বাচ্চাগুলো বাসায় কিছু শেখে না, বাবা-মার শেখানোর ইচ্ছেটুকুই নেই। অনেক বাবা-মাকে আমি খুব গর্ব করে বলতে দেখেছি, আমার বাচ্চাতো বাংলা বলতে-লিখতেই পারে না, সবসময় ইংরেজীই বলে। আমার স্কুলে অন্য দেশের যেসব বাচ্চা আছে তারা বাংলার বদলে পরিবেশ বিজ্ঞান পড়ে। আমার ক্লাসে একটা নতুন বাচ্চা ভর্তি হল। ওরা বাংলাদেশী, আবার একইসাথে আমেরিকার নাগরিক। ওর মা একদিন এসে বলল, ওর জন্য বাংলাটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ওকে পরিবেশ বিজ্ঞানটাই পড়াতে চাচ্ছি। আর তাছাড়া আমরাতো থাকবোও না বাংলাদেশে, বাংলা না শিখলেও হবে। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি বলতাম, বাংলা ওকে পড়তেই হবে, এটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার হাতে ছিল না। স্কুলেও তারা কিছু শিখতে পারে না। কারণ শিক্ষকদের অবস্থা আরো করুণ। তাই আমি যখন তাদের বলি, আমার ক্লাসে কেউ হিন্দী বলতে পারবে না। ওরা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। 'কেন মিস!' বাসায় বা শিক্ষকের কাছে শুনে ওরা এটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে।
আমি খুব ছোট্ট একটা স্কুলে কাজ করি। কিন্তু এখানেই আমি আরো বড় বড় স্কুলগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের দেখা পাই। তাই একটা সার্বিক চিত্র আঁকতে আমার কষ্ট হয় না। একটা পুরো প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে। সামনের প্রজন্মটাও আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি। এই লজ্জা, এর দায়ভার কি আমাদের না?
আজকাল খুব হতাশ লাগে এসব দেখলে। কি আশ্চর্য জীবনীশক্তিতে ভরপুর এই কচি প্রাণগুলো। অথচ এদের এ জীবনীশক্তির কি বিপুল অপচয় হয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কিন্তু কি করবো! খুব দু:খ নিয়ে ওইদিন ছোটবোনকে বলছিলাম, অনেক কথার শেষে ও বলল, তুমি একা কি-ই বা করবা আপু। সব কথার শেষ কথা ওটাই হয়ে আসছে সবসময়। আমি একা কি করবো! এটা কি আমার একার দায়িত্ব! কি দরকার তারচেয়ে, চোখ বুজে নিজেরটা বুঝে নেই না কেন, বাকি সব উচ্ছন্নে যাক। তারপরে সব সয়ে যায়, আমরাও গা ভাসিয়ে দেই স্রোতে। কিন্তু কিছুই কি করার নেই? কোন সমাধানই কি নেই?
শেষের আগে:
১৪ তারিখ বাচ্চাদের এ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম দিনটা সম্পর্কে জেনে আসতে। পরদিন ক্লাসে ঢুকে যখন জানতে চাইলাম, দেখলাম অর্ধেকের বেশি বাচ্চাই বলতে পারছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ওইদিন পাকিস্তানিরা সমস্ত শিক্ষক, ডাক্তার, লেখক, সাহিত্যিককে হত্যা করেছিল। আমি জানতে চাইলাম 'কেন?'
তারপর নিজেই উত্তর দিলাম, 'ধর আমাদের স্কুলটাই একটা দেশ। তোমরা সবাই এখানে আছো, কিন্তু কোন স্যার-মিস নাই। সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে খারাপ লোকেরা। তখন কি হবে? খুব ভাবল তারা, আর তারপরে তাদের চোখের তারাই আমাকে বলে দিল কি ভীষণ উপলব্ধি তাদের হয়েছে। আমি ওদের কথা দিয়েছিলাম আমাদের দেশের জন্মকথা বলবো। ক্লাসের একমাত্র পাকিস্তানী ছাত্রী কাবিশার কথা ভেবে সবাই বলছিল, মিস এখন এগুলো বললে কাবিশা মন খারাপ করবে। আমি বললাম, না, কাবিশাকেও জানতে হবে। শুরু করেছিলাম ব্রিটিশ আমল থেকে, শেষ করেছি ১৬ই ডিসেম্বরে। আমার বলা শেষে স্তব্ধ প্রত্যেকটা কোমল মুখ আর তাদের জ্বলজ্বলে চোখ দেখে মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের জন্যও তারা অনুভব করতে পেরেছে দেশকে, মাকে। পুরো সময়টা কাবিশা বসে ছিল মাথা নিচু করে, ওর ফর্সা গালগুলো লাল টকটকে হয়ে গিয়েছিল। আমি জানি সে তার বাবা-মার কাছে কিছু শোনে নি এ বিষয়ে, আর যদি শুনে থাকেও তবে সেটা ভুল। আজ যদি সে তার দেশের মানুষের আচরণে লজ্জিত হয়ে থাকে, মনে মনেও ক্ষমা চায় তার বন্ধুদের কাছে তবে সেইসব নরপশুর আত্মার উপর সেটা হাজার গুণ অভিশাপ হয়ে লাগবে।
ক্লাস ফোরের নাফিস একদিন বলছিল, বাংলাদেশ ভাল খেলতে পারে না। তাই সে বাংলাদেশকে ঘৃণা করে। ছোট্ট, ছটফটে রাহীম লাফ দিয়ে উঠে নাফিসের বুকে মেশিনগান তাক করে বলে উঠল, তাহলে তোকে ১৬ই ডিসেম্বরে আমি মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মারবো। গতকাল সারাদিন ব্লগে ঘুরে আমি মন ভাল করে দেয়া একটা লেখাই পেয়েছিলাম। আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছিল লেখাটা পড়ে।
শেষ কথা:
হতাশায় ডুবে যেতে যেতে আমার এই ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি একদিন এরাই আবার ফিরিয়ে আনবে ভুল পথে যাওয়া আর সব্বাইকে। খুব গর্বভরে বলবে, 'আমার বাংলাদেশ...সকল দেশের সেরা...'
...................................................................................
আজকাল এসব নিয়ে প্রায়ই খুব বিক্ষিপ্ত থাকি। জানি খুব এলোমেলো হল লেখাটা, যা বলতে চেয়েছিলাম সব বলা হল না। তবু....লিখলাম....
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:২৬