সৃষ্টির ঊষা লগ্ন থেকেই মানুষ প্রতিনিয়ত শিখছে। আদিম যুগের মানুষের অবস্থা ইতিহাসে পড়েছি, তাদের না ছিল ঘর বাড়ি, না ছিল শিক্ষা, না ছিল চিকিৎসা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও তখন থেকেই শুরু হয় শিক্ষার হাতেখড়ি তাদের দৈনন্দিন কর্ম কান্ডের মাধ্যমে। আদিম অবস্থা থেকেই আজ একাবিংশ শতাব্দিতে মানুষ বিজ্ঞানের চরম উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে, এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে শিক্ষার কারণে। মনিষীগণ শিক্ষা সম্পর্কে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তন্মধ্যে একটি- 'কাঙ্খিত আচরণিক ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের নামই শিক্ষা।‘ তাই মানুষ যখন যা শিখে সেই শেখার মাঝে ফাঁক থাকলে তাকে আর শেখা শিখণ বলা যায় না। দাদুর মুখে শুনেছিলাম, তাদের আমলে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির চরিত্রে অসততার ছাপ ছিল না। শিক্ষার্থী যতটুকু শিখেছে অকপটে শিখেছে। শিক্ষক যতটুকু শিখিয়েছেন হৃদয় উজাড় করে, অন্তর নিংড়িয়ে, নির্মল, প্রাণবন্ত প্রাণে শিখিয়েছেন; তাতে ছিল না কোন কপটতা, ছিল না কোন অপকৌশল ও শঠতা। দাদু আরো বলেছিলেন, সেকালে নাকি কোন প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন ছিল না, কোচিং সেন্টার ছিল না, এমন কি নোট বই, গাইড বইয়েরও প্রচলন ছিল না। দিন দিন শিক্ষার যতই উন্নতি ঘটেছে ততই প্রতিযোগিতা মূলক প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থাপনা, কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা, নোট বই, গাইড বই ছাপানো ও বিক্রয়ের ব্যবস্থাপনা দূর্বার গতিতে বেড়ে চলেছে। উদ্দেশ্য শুধু টুপাইস ( অর্থ ) কামানো, অর্থাৎ বিত্তবান হওয়ার ধান্দা। তাকালেই চারপাশে দেখতে পাই প্রায় সকলেই যেন অর্থের নেশায় মাতাল হয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শুধু ব্যবসা করে অর্থবান হয়ে গগণচুম্বী অট্টালিকা গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। এতে মানুষের কল্যাণ হোক আর অকল্যাণই হোক, জাতির উন্নতি হোক অথবা জাতির বিপর্যয় হোক সেদিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। তাই প্রায় সকলেই স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে রকেটের গতিতে ছুটছেন ডিজিটাল সুখ পাখিটির পেছনে। বিগত কয়েক বছর ধরেই পত্রিকার পাতা চোখের সামনে তুলে ধরলেই দেখতে পাই, প্রশ্ন ফাঁস! প্রশ্ন ফাঁস!
দেখা যাচ্ছে, পি.এস.সি. থেকে বি.সি.এস. পরীক্ষা পর্যন্ত প্রত্যেক পরীক্ষায়ই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। সকল শ্রেণীতে এত নোট বই, গাইড বই, প্রাইভেট সেন্টার, কোচিং সেন্টার এর ছড়া ছড়ি থাকা সত্তেও আবার প্রশ্ন ফাঁসের প্রয়োজন হয় কেন তা মগজেই ঢুকছে না। ভাবতে অবাক লাগে যে, সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য প্রতিটি শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের কাঁধে দেশের ভবিষ্যত দায়িত্বভার তুলে দেওয়া। কিন্তু যেভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে তাতে কি সরকার মহোদয়ের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে না? জাতি কি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে না? এই কি আমাদের ডিজিটাল শিক্ষা? শিক্ষার উদ্দেশ্য কি আত্বকেন্দ্রিকতা ও অসততা? তাহলে এই শিক্ষা মানুষ কে কখনোই মানুষ করতে পারেনা, দেশ কে কখনো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা।
দাদু বলেছিলেন, শিক্ষা মানুষ কে বিনয়ী , নম্র ও ভদ্র মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। শিক্ষা মানুষের মনের অন্ধকার ও কু-সংস্কার দূর করে মানুষ কে সত্যিকারের জ্ঞান গরিমায় আলোকিত করে একজন খাঁটি মানুষে পরিণত করে। আর সেই মানুষের দ্বারা দেশ ও দেশের মানুষের তথা সকল সৃষ্টির কল্যাণ সাধিত হয়। কেবল এরূপ মানুষই পারে সকল দ্বিধা-দ্বন্ধ ভুলে সকল মানুষ তথা সকল সৃষ্টি কে ভালবাসতে এবং পর কে আপন করে নিতে। আর এরূপ মানুষের অন্তর নিহিত শিক্ষা-ই আদর্শ শিক্ষা-সফল শিক্ষা।
'প্রশ্ন ফাঁস' এর ঘটনা দূরীকরণে সততার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ অর্থাৎ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষগণ সকল কে সবিনয়ে অনুরোধ করছি,- আসুন সবাই মিলে সততার পতাকা তলে সমবেত হই। শিক্ষাঙ্গনকে কলুষতা মুক্ত করি। সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করে সুনাগরিক গড়ে তোলার সংগ্রাম চালিয়ে যাই। দেশ ও জাতিকে বিশ্বের দরবারে গর্বিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করি। আর যদি আমরা তা না পারি, বর্তমান চলমান অবস্থা চলতেই থাকে তাহলে কোন দিন আমরা সত্যিকারের শিক্ষিত ও সত্যিকারের মানুষ হতে পারব না। এমন কি আমাদের দেশ মাতাকে যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারব না। তাই কবি বলেছেন,-
"সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধা জননী
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি"
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:১৯