টংগীর এক প্রাইভেট হাসপাতালে “কটসন” ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগী মেরে ফেলা হয়েছে(বিস্তারিত এখানে)। “কটসন” ইঞ্জেকশনের এত পাওয়ার হলো কিভাবে বোঝা গেল না। জ্বর আসলে যেমন প্যারাসিটামল দেই তেমনি একিউট এজমার রোগীকে সকাল বিকাল রাত্রি মুড়ি মুড়কির মত কটসন দেয়া হয়। বাস্তবে টক্সিক ডোজ বিবেচনা করলে প্যারাসিটামলের তুলনায় কটসন ইঞ্জেকশন একটা নিরীহ ড্রাগ ।
আমার মতে মামলা হওয়া উচিত ছিলো ঐ রোগীর এটেন্ডেন্স দের নামে, যারা ডাক্তার ঢাকা মেডিকেল এ রেফার করার পরেও রোগী নিয়ে যায়নি। সাধারন মামলা না খুনের মামলা। শুধুমাত্র আত্বীয় স্বজনের অবহেলায় রোগীটা মারা গেছে। মামলা হয়েছে ডাক্তারের নামে। মাথামোটা পুলিশ প্রশাসন ডাক্তারকে গ্রেপ্তারও করেছে।
হায়রে দেশের আইন...
আচ্ছা, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কি কয়েক বছরের মধ্যে এতই খারাপ হয়ে গেল যে শুধুমাত্র চিকিৎসকের অবহেলার কারণে হঠাৎ করে এত রোগী মারা যেতে শুরু করল?
পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলে না।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে বাংলাদেশের যতটুকু অর্জন তার প্রায় সবটাই কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে। শিশুমৃত্যু মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে দেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বে প্রশংসিত। এর কৃতিত্ব কিছুটা হলেও চিকিৎসকদের প্রাপ্য।
কোন লজিস্টিক্যাল/প্যাথলজিক্যাল সাপোর্ট বা যথাযথ একমোডেশন না দিয়ে , কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে প্রতি বছর একঝাক চিকিৎসককে পাঠানো হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখী হয়ে সেবা দিয়ে যাওয়া এই চিকিৎসকরাই তো এই অর্জনের পেছনের মূল কারিগর।
অথচ এরা আজ স্বীকার হচ্ছে নির্যাতনের।
অভিযোগ?
ভুল চিকিৎসা…
চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা দিচ্ছে সেটা বুঝতে হলে একজন চিকিৎসক হতে হবে। আর্টস নিয়ে পড়া সাংবাদিক বা এইট পাশ ওয়ার্ড সভাপতি চিকিৎসকের ভুল ধরার ক্ষমতা রাখে? কিভাবে?
একজন রোগী যখন মারা যায় স্বাভাবিক ভাবেই তার আত্বীয় স্বজনের মানষিক অবস্থা খারাপ থাকে। তাদের যদি উস্কায়ে দেয়া হয় যে রোগী মারা গেছে চিকিৎসকের ভুলে তখন তারাই ঘটায় এই ঘটনাগুলো। কত কয়েক বছর দেশের পত্রপত্রিকাগুলো সরকারি হাসপাতাল এবং ডাক্তারদের নামে নানা রকম মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী লিখে মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। এখন রোগী মারা গেলে মানুষ সবার আগে ভাবে ডাক্তার আসতে কি দুই মিনিট লেট ছিল বা ডাক্তার কোন ইঞ্জেকশন পুশ করেছিলো কিনা ?
অথচ এই পত্রিকাগুলো কখনো প্রচার করেনি যে সরকারী হাসপাতালে প্রতিদিন কত শত অপারেশন ফ্রি তে করা হচ্ছে। আউটডোর ইমার্জেন্সিতে নামমাত্র মূল্যে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে।
একটু তুলনা করে দেখুন সরকারী অন্য সেক্টর গুলোর সাথে সরকারী হাসপাতালের। সরকারী ব্যাংক, অফিস আদালত, শিক্ষাবোর্ড থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটা যায়গায় অবৈধ লেনদেন ছাড়া আপনি একটা কাজও আদায় করতে পারবেন না। হাসপাতালগুলোই একমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান যেখানে চিকিৎসা পেতে কোন ঘুষ লাগে না। কেউ কেউ হয়ত বলবেন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের বখশিষের কথা। তাদের বিনীত ভাবে জানাই এর সাথে চিকিৎসকদের কোন সংযুক্তি নাই এবং এই অর্থের পরিমানও অতি নগন্য। কোন রকম অর্থ লেনদেন ছাড়াই যেখানে দিনে হাজার হাজার রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে সেখানে চিকিৎসা দিচ্ছে যে চিকিৎসকরা তারা কি সততার জন্য প্রশংশা পাবার যোগ্য না? দেশের প্রতিটা সেক্টর যেখানে দুর্ণীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত সেখানে সম্পূর্ণ সিস্টেমকে ঘুষমুক্ত রেখে দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন যে চিকিৎসক রা তারা কি ন্যূনতম ক্রেডিট ডিজার্ভ করে না?
অথচ এরা কাজ করে মানুষের জীবন নিয়ে। কি পরিমাণ মানষিক চাপ একজন চিকিৎসককে নিতে হয় সেটা কি কেউ কল্পণা করতে পারে? একজন রোগীর জীবন মৃত্যু নিয়ে এদের কাজ। সেই কাজটা যাতে মনোযোগ দিয়ে করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা কি দেশের দায়িত্ব নয়? তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কি প্রশাসনের কর্তব্য নয়?
সামনে মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে যদি চিকিৎসককে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় তাহলে তার পক্ষে কোনদিনই সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া কি আসলেই সম্ভব ?
চিকিৎসকের সাথে দেশের অন্য সব পেশারজীবিদের কাজে অনেক পার্থক্য আছে। চিকিৎসক মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে কাজ করে। এত বেশী মানষিক চাপ অন্য পেশার মানুষকে সহ্য করতে হয় না। অন্য সব পেশার মানুষ বিভিন্ন রকম ছুটি ভোগ করে। খাতা কলমে চিকিৎসকরা এই ছুটিগুলো পেলেও বাস্তবে কিন্তু সেগুলো ছুটি নয়। নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি নিতে হলে তার নিয়মিত ডিউটিগুলো তাকে কোন না কোন ভাবে ম্যানেজ করতে হয়। ফলে কাগজে কলমে ছুটি পেলেও তাকে বাড়তি কাজ করে পরে সেগুলো পুষিয়ে দিতে হয়। শুধু এগুলোই নয় ঈদ, পূজা পার্বণে ইমার্জেন্সি সার্ভিস কিন্তু ঠিকই খোলা রাখতে হয় চিকিৎসকদের।
তাহলে চিকিৎসকরা কি বাড়তি প্রণোদনা আশা করতে পারে না? আলাদা বেতন কাঠামো কিংবা আলাদা কোন সম্মান, আলাদা কোন উৎসাহ ভাতা?
যাদের কাছে সর্বোচ্চ এবং আন্তরিক সেবা আমরা আসা করি তাদের জন্য একটু বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও কি রাষ্ট্রের করা উচিত নয়?
এই লেখা দেশের নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌছাবে না। কোন সমাধানও আসবে না। তাই ঘটনা প্রবাহের সর্বশেষ ফলাফল বলে নেই।
ইমিডিয়েট যে সমস্যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে তা হলো চিকিৎসক ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট দিতে ভয় পাচ্ছে। এজমার রোগীকে “কটসন” দেয়ার অপরাধে যদি তাকে গ্রেপ্তার হতে হয় তাহলে সে কিভাবে ইমার্জেন্সি রোগীর চিকিৎসা করবে। যে রোগীকে একটা ইঞ্জেকশন দিলে হয়ত সে আরেকটু বেশী সময় পেত মেডিকেল পর্যন্ত পৌছাইতে সেখানে নিরাপত্তার ভয়ে ডাক্তার কোন চিকিৎসা না দিয়ে রেফার করবে। ফলাফল কি হবে বুঝে নিন।
এখন দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটি ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখে না। আগামী পাঁচ-দশ বছর এভাবে চলতে থাকলে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবে দেশের দ্বিতীয় তৃতীয় লেভেলের ছাত্ররা। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো ডাক্তারদের মধ্যে বিদেশে যাবার ইচ্ছা এখন প্রবল ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে যেটা কয়েক বছর আগেও ছিল না। বলাই বাহুল্য দেশের বাইরে তারাই যাবে যারা বাশী যোগ্য, বেশী মেধাবী। আগামী ১৫-২০ বছরে চিকিৎসাক্ষেত্রে মেধাশূন্যতা দেখা যাবে।
এই সঙ্কট হবে ভয়াবহ সঙ্কট। অনেকটা মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার মত। মেরুদন্ড ভাঙার এই প্রক্রিয়া ইতিঃমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
কোন বিচিত্র কারণে আমাদের দেশের রাজনৈতিক/প্রশাসনিক ব্যাক্তিত্বদের ধারণা শুধু গ্রামে চিকিৎসকের থাকা নিশ্চিত করতে পারলে সকল সমস্যার সমাধান হবে।
সাময়িক এই মলম বিতরণ বন্ধ করে এবার তারা কি ভেবে দেখবেন কিভাবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি স্থায়ী এবং শক্তিশালী ভিত্তির উপর স্থাপন করা যায়?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:১৪