ছেলেটা ক্যাটারার!
খাবার সার্ভ করা তার কাজ... কাজটা খারাপ না। ভদ্র কাজ, সুন্দর পোশাক পরে ফিটফাট থেকে সবাইকে খাবার সার্ভ করতে হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা এদের কর্তব্য। সুন্দর ভাবে খাবার পরিবেশন করাটাও...
ছেলেটা খুব নম্রভাবে আমার কাছাকাছি দাড়িয়ে বললো, " ম্যাম, সবজি দেব?"
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, " না..."
ছেলেটা মনে হলো যেনো দুঃখ পেয়েছে। এমনটা তো হবার কথা না। সবজির মত ভালো খাবার ইদানীং কেউ খায় না। তবে ভেজ বার্গার , ভেজ পিৎজা খাওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে...
ব্যাপার না, জেনারেশন চেঞ্জ হচ্ছে। আলু ভর্তা কেউ খেতে চায়না, তবে স্ম্যাশড পটেটো দিলে আগ্রহের সাথেই খাবে। হাহাহা।
ফর্সামত ছেলেটা, তেমন মোটাসোটা না। চিকনচাকন, খুব একটা তেল চর্বি খাওয়া পড়েনা বোঝাই যায়। অন্যকে খাইয়ে এদের শান্তি এবং স্যালারি ।
আমি আবার ছোলেটাকে ডাকলাম, " এইযে..."
ছেলেটা মুহূর্তে আমার দিকে তাকালো।
" আমাকে সবজি দিয়ে যান, অল্প দেবেন... আর চিংড়ি মাছ আছে নাকি ওতে? চিংড়ি থাকলে দেবেন না, আমার এ্যালার্জী। "
ছেলেটা এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, " চিংড়িতে আমারো এ্যালার্জী...খেতে হবেনা সবজি, ডাল নিন... "
ছেলেটার চোখটা মায়া মায়া। আমার আবার এক বদভ্যেস... কাউকে ভালো লাগলে তার চোখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। সবার চোখে মায়া থাকেনা মেরিলিন মনরোর মত, কারো চোখ হিটলারের মতও হয়।
আমি ডাল পছন্দ করিনা। তবু কিছু বললাম না, একটা দিন খেলে কিছু হবেনা। গিলা কলিজার ডাল...খারাপ না খেতে।
কিন্তু ছেলেটা আমার ভালোমানুষি কে অস্ত্রের মত ব্যবহার করে আমার প্লেটটা ডাল দিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে গেলো!
মনে হচ্ছিলো প্লেটে বন্যা হয়েছে, ভাতগুলো মাটি আর গিলা কলিজাগুলো ভেসে ভেসে যাচ্ছে....
এর শাস্তি ওকে পেতে হবে। কি শাস্তি দেয়া যায়... ভাইয়া ডাকা যেতে পারে! ছেলেরা সাধারণত রূপবতী মেয়েদের কাছ থেকে ভাইয়া ডাক শুনতে ভালোবাসেনা। অরূপবতীদের কাছ থেকে শুনতে ভালোবাসে কিনা জানা নেই।
তবে ভাইয়া ডাকলে প্রতিশোধ ঠিকঠাক হবেনা। আঙ্কেল ডাকা যেতে পারে, সেটা একটা দারুন বিচার হবে!
বছর তিন চারেকের জুনিয়র একটা মেয়ে আঙ্কেল ডাকার পর ছেলেটার এক্সপ্রেশন কেমন হবে ভাবতেই আমার হাসি পেয়ে গেলো। কিছুতেই থামেনা, এদিকে টেবিলে সবাই বসে আছে। প্রাণপণে হাসি চেপে রাখতে গিয়ে উল্টা বিষম খেলাম আর কাঁশতে লাগলাম ভয়াবহভাবে।
অবশ্য আঙ্কেল বা ভাইয়া যাই বলিনা কেনো, উনিই জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক একটা ব্যাপার... বিষম খেলে হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিলে আস্তে আস্তে কমে যায় সবটা। উল্টা আমাদের একগাদা জল খাওয়ানো হয়, এমন অবস্হায় জল খাওয়াটাও কষ্টকর।
আমি উঠে পড়লাম। মাথা বো বো করে ঘুরছে, হাসির ফলাফল এত ভয়াবহ হবে ভাবিনি।
কমিউনিটি সেন্টার এর বাথরুম এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে এক্সপেক্ট করিনি। চকচক করছে চারিদিক। কিন্তু আমার কাশি কমেনি, বেসিনের উপর ঝুঁকে বমি করবার চেষ্টা করলাম। খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে এলাম সুস্হ মানুষের মত, কিছুই হয়নি। Everything is ok..!!
ততক্ষণে অন্যদের খাওয়া শেষ। আমার জন্যে ওয়েটও করলো না শয়তানীর দল! কত্তবড় খাদক সবগুলো...
বিয়েটা আমার এক বান্ধবীর, কম বয়সেই বিয়ে হচ্ছে। হাজবেন্ড থাকে ফরেনে। দেখতে শুনতে ভালো, ফেমিলি স্ট্যাটাসও ভালো। অথচ আমার ফ্রেন্ডের নাকটা বোঁচা আর এমন কোনো গুনও নেই বলার মত। সব মিলিয়ে রাজকপাল বটে! শুনেছি বোচা নাকের মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায়না!
আমি ফিরে আসার সময় দেখলাম ক্যাটারার ছেলেটা মায়া মায়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো খাসির রেজালা দিয়ে আমার প্লেটে টর্নেডো তৈরি করার ইচ্ছে ছিলো তার। অথবা চাঁটনী আর মিষ্টি দই ঢেলে ঢেলে দিয়ে আমার প্লেটের বারোটা বাজানোর!
কিন্তু তাকে সেই সুযোগই দেবার সুযোগ হলো না। খাওয়ার ইচ্ছে উবে গেছে। উনি যখন টেবিল পরিষ্কার করছে তখন চেয়ারে ফেলে রাখা পার্সটা তুলে নিলাম হাতে।
চলে আসবার সময় শুনি একটা আধাবুড়ো ধরনের লোক চেঁচিয়ে ঐ ছেলেটাকে বলছে, " ঠিক করে পরিষ্কার কর...কি কাজ করিস টেবিলই পরিষ্কার হয়না? ঠিক কর! "
হাড় চিঁবোনো, এটো করা সব টেবিলের উপর ফেলে ভালো মানুষেরা চলে গেছে। ছেলেটা হাসিমুখে সব পরিষ্কার করছে। ওর নিশ্চই ঘেন্না লাগছে, তবুও চুপচাপ দাড়িয়ে কাজ করছে।
ওরা কাজের লোক না, ওরা স্টুডেন্ট। পার্টটাইম জব করে...
আমি চলে এলাম। কিছুক্ষণের জন্য ওর লাইফের গল্পে ঢুকে পড়েছিলাম। হয়তো আজ বাড়ি ফিরে এই ছেলেটা তার রুমমেটদের হেসে হেসে বলবে, " জানিস... আজ ডাল দিয়ে একটা মেয়ের প্লেট ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও কিছু বলেনি..."
" দোস্ত, মেয়েটা কি সুন্দরী? "
ছেলেটা বিজ্ঞের মত বলবে, " সৌন্দর্য কি শুধু চেহারায় থাকে...সৌন্দর্য থাকে মনে। "
বন্ধুরা হা করে কথা শুনবে। ছেলেটা চোখ বড় বড় করে আজ ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর নানারকম বর্ণণা দেবে।
আমিও বেশ কয়েকবছর পর খাবার টেবিলে আমার একজন প্রিয় মানুষকে নিয়ে বসব। নিজে রান্না করা খাবারগুলো তার প্লেটে উঠিয়ে দেবার সময় সে বলবে,
" এতো সুন্দর খাবার সার্ভ করা কে শেখালো তোমায়?"
আমি উত্তর দেয়ার আগে কনফিউজড হব। কে শেখালো! ভাইয়া না আঙ্কেল?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৪