ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী সুমাইয়া বেগমের অপরাধ ছিল- সে পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়। এ দেশে এ চাওয়াটা কম ভয়ানক নয় একটি অতি রক্ষণশীল পরিবারে। আজ নিউজটা দেখার পরেই এক সহকর্মী জানালো, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আবাসিক হলে থাকা তার বোনের পরিচিত। খুবই ভাল ও মেধাবী মেয়ে। তাদের দেশের বাড়ি যশোর হওয়ায় ঘণিষ্ঠতা ছিল। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। হিসাব মেলাই কেন এমনটা হল?
সিদ্দিকুর রহমান যশোরীর কন্যা তিনি। ওয়াজ করে তিনি জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। বাবার পছন্দ মেনেই বিয়ে করেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছিল তার পিতার চেয়েও রক্ষণশীল। তারা পড়ালেখা করাটা পছন্দ করছিল না। পড়াশোনা বন্ধ করতে হুমকি দেয়া হয়, মারধরও করা হয। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়তে চায়নি মেয়েটি। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর স্বামীর পরিবার চাপ দিতে থাকে পড়াশোনার বদলে গৃহস্থালির কাজে মনোযোগ দেওয়ার। এরমধ্যে আবার মেয়েটি চাকরি করতে চায়। মেয়েটির বাবা মারা যাওয়াতে সে আর্থিক সংকটেও পড়েছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না, রক্ষণশীল পরিবারটি মেনে নিতে পারেনি। প্রতিশোধ পরায়ণ পরিবারটি হত্যার পথই বেছে নেয়। এই পরিণতি রোধ করা যেতো?
মেয়েটির হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন জানিয়েছেন, ‘গত বছরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় সুমাইয়া আমাকে ফোন করে এবং জানায়, সে আমার সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চায়। যথারীতি সেদিন ডিউটি আওয়ারেই মাথায় সব সময় মাথায় ওড়না দেওয়া সুমাইয়া আমাদের হল অফিস রুমে এল। খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিল। জানাল, কিছুদিন আগেই তার বাবা মারা গেছেন। তার পরিবার খুবই রক্ষণশীল, কিন্তু তার বাবা চাইতেন, সে যেন চাকরি করে। খুবই মলিন মুখে সুমাইয়া জানায়, তার বাবা মারা যাওয়ায় সে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। সে কিছু একটা করতে চায়, আমি কোনোভাবে তাকে সহায়তা করতে পারি কি না। আমার কোনো গবেষণাকাজে সে সহায়তা করতে পারে কি না। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী সে। যা বলছে, খুব দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলছে। কোথাও দ্বিধা নেই, জড়তা নেই, আমতা-আমতা নেই। ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল কিন্তু কাজ করা, নিজের মতো জীবন যাপন করার অধিকারের বিষয়ে দুর্দমনীয়, বলিষ্ঠ। মেয়েটির জীবনবোধের ধার আমাকে স্পর্শ করে, কোথায় যেন ছুঁয়ে যায়।’
সেই মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হল না। নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের জন্য বাঁচা, নিজেকে নিয়ে বাঁচা হল না। আমরা ধর্মান্ধতার কথা বলি, নারী স্বাধীনতার কথা বলি। যখন একেকটা মেয়ে ঝরে যায় তখন কিছু আলোচনা করি, দুঃখ পাই কিন্তু পথের কাঁটা তুলতে ভূমিকা রাখি না। সেই কাঁটায় রক্তাক্ত হয়, হবে আরো কোন ছাত্রী।রক্ষণশীলতা নারীদের গৃহ বন্দী করে রাখতে চায়।শাস্ত্রীয় বিধানে নারীর জন্য চাকরির পথ খোলা নেই। যে সকল নারীরা রাজনৈতিক দল করে, তারাও নারীর সংকট নিরসনে খুব একটা এগিয়ে আসেনি। ভারতে উমা ভারতী, সুষমা স্বরাজ, স্মৃতি ইরাণী তাই নারীর চেয়ে হিন্দুত্ববাদেরই জয়গান গান। বাংলাদেশের কথা বললাম না- মামলা খাওয়ার ভয়ে।শুধু বলি ধর্মীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন নারীরা। নারী শৈশবে থাকবে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন আর বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের অধীন। নারীর কাজ পতি সেবা আর পুত্রসন্তান জন্ম দেয়া। সেই নারীকেই কামনা করে আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ।আর আমরা স্বপ্ন দেখি সমাজে উঠে আসবে হাজার হাজার নোরা। নোরা মানে ইবসেনের ডলস হাউজের সেই নোরা। তিনি পুতুলের সংসার করতে চাননি।আমাদের সুমাইয়াদের স্বপ্ন রক্ষণশীলতার জাল ছিন্ন করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২০ সকাল ৯:০১