সমুদ্রতে সময় কাটানো তার অনেকটা নেশার মত। ঘন্টার পর ঘন্টা সে সমদ্রের তলদেশে সময় কাটায়। মায়ামী বিচ এ কাজ করে কোস্ট গার্ড এর। যদিও তার কাজ সমুদ্রে আগত যারা ইযর্ট বা সমুদ্রে সাতার কাটা অবস্থায় বিপদে পরে তাদের বাঁচানো। তীরে লাইফ সিকিউরিটি র কাজ করে। কিন্তু সমুদ্র , পানি তার অনেক টা জীবনের মত। প্রতিদিন কিছুটা সময় এর পানিতে অবগাহন করে যেন জীবনের স্বাদ পায় সে।
নাম তার রিশান মৌতিফ । ক্যালিফোর্নিয়া তে তার বাস যদিও কাজের জন্য প্রতিদিন দিনের অধিকাংশ সময় এই বিচ এ কাটায়। আজ বিচ এ দুর্যোগ সংকেত দেওয়া হয়েছে কতক্ষণ আগে। ধীরে ধীরে সব মানুষ বিচ ছেড়ে নিরাপদ লোকালয়ে ফিরে গিয়েছে। একমাত্র সে এখন সাতরিয়ে চলেছে পানিতে। আজ সে ডুবুরীর পোশাক পরে নিয়েছে। সাতরে সে আজ চলে গিয়েছে সমুদ্রের তলদেশে। আজ চলে এসেছে অনেক গভীর ভিন্ন এক জায়গায়।
আচমকা চোখে এক আলোর ঝলকানি পড়তে সে থমকে দাঁড়াল। আলো অনুসরণ করতে করতে অভিভূত হয়ে দেখল সামনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তির পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছে। শারীরিক আকৃতিতে মনে হচ্ছে মানবী নারী !!! চমকে আর ও মনযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে সামনের ছায়ামূর্তি কে অনুসরণ করতে থাকে।অবাক হয়ে লক্ষ্য করে একসময়ে মূর্তি টি এসে থামে একটি বিশাল ঝিনুক আকৃতির প্রাসাদের সামনে। বা প্রাসাদ না বলে ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন বলা যায়। অভিভূতের মত দেখল সামনে কোন একটা কিছু চাপ দিতে দরজার মত একটা পাল্লা খুলে গেল। মেয়েটি এর ভিতরে ঢুকতে দরজা টি বন্ধ হয়ে গেল।
রিশান হতাশ হয়ে গেল সঙ্গে ঢুকতে পারলনা বলে। একবার ভাবছে দরজায় নক করবে কিনা। সঙ্গে সঙ্গে আবার দরজাটি খুলে গেল। সে তড়িৎে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
আশ্চর্য্য একটা গুনগুন আওয়াজের সাথে মাথা হেলিয়ে মনে হচ্ছে গান গাইছে। এ কি কল্পনা তার ? ডুবুরীর মাস্ক পরে গান গাইতে পারার কথা না।
এত স্বচ্ছন্দে মেয়েটা মাথা দুলিয়ে সাতরে যাচ্ছে ভাবা স্বাভাবিক এ সমুদ্রের এক কন্যা। এই পাতালে তার বাস।
খুব সাবধানে একটু দূর থেকে মেয়েটিকে অনুসরণ করতে থাকে সে।
একসময় মেয়েটি ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দেখল। ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল রিশান। সচেতন হতে দেখল মেয়েটা সাগরের একেবারে তলদেশে চলে এসেছে। তার হাতে এক সার্চ লাইট আছে যা দিয়ে মনে হচ্ছে কিছু একটা খুজছে সে। একটা জায়গায় থামল। কিছু লতাপাতা ধরনের টেনে টেনে ছিড়ে নিল।
এবার সে আগের জায়গায় যেতে শুরু করল। হিসাব মতে সে প্রায় ছয় ঘন্টা কাটিয়ে ফেলেছে সাগরে। এই মুহুর্তে থাকা তার জন্য ঠিক নিরাপদ না। তার ডুবুরীর পোশাক আর কতক্ষণ অক্সিজেন সরবরাহ করবে সেটা ও ভাববার। কিন্তু তারপর ও নেশাগ্রস্থের মত অগ্রবর্তিনী কে অনুসরণ করে চলেছে।
আবার আগের সেই ঝিনুক আকৃতি খোলস এর কাছে চাপ দিতে দরজা খুলে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ইশারায় তাকে ডেকে বসল মেয়েটি।
চমকে প্রায় মাথা নিচু করে ফেলতে নিয়েছিল সে। পরে যখন বুঝে গেল ধরা পড়ে গিয়েছে সামনে এসে দাড়াল। মেয়েটির ইশারামত ঝিনুক আকৃতি যানটির ভিতরে এসে ঢুকল। ভিতরে আসার পর এক সুইচ চাপতে দেওয়াল আস্তে উল্টে মেঝের উপর লেগে গেল। সাগরের পানি তলদেশে চলে গেল।
এ অনেক টা ডুবো জাহাজ এর মত। মেয়েটি এবার তার ডুবুরীর পোশাক খুলে ফেলল।
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল রিশান মৌতিফ এর। অসহ্য রকমের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া এক তন্বী রূপসীর সামনে সাগরের তলে।
হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল সে।
আমি ত্রিলিনা নিত্রিভ জেহার্ব এর কন্যা।
নিত্রিব নিত্রিব কোথায় নামটি পড়েছে। স্মৃতির পাতা হাতড়াতে গিয়ে চমকে উঠে তাকায় পাশ্ববর্তিনীর দিকে।
প্রফেসর নিত্রিভ সৌর মন্ডলী নিয়ে গবেষণায় আলোড়ন ফেলে দেওয়া তথ্য প্রফেসর এবং তার অন্তর্ধান ,অনেকদিন যাবত বড় দৈনিক সংবাদে এর খবর প্রতিদিন ই পড়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সে।
আপনার বাবা হতভম্ব অবস্থা থেকে উঠে এই শব্দ ই উচ্চারণ করতে পারল।
বাবা এখানে।
আবার ও হতভম্ব হওয়ার পালা।
আমার জন্য।
আপনার জন্য কেন ?
খেয়াল করে দেখুন আমায়। মেয়েটি বলে এবার বেদনার স্বরে।
তাকিয়ে এবার বুঝতে পারে কেন মেয়েটি এত স্বচ্ছন্দ পাতালে সাতারে। এতক্ষণ মেয়েটিকে মনে করেছিল লম্বা গাউন পরে আছে। গাউন একটু তুলে সে দেখাল তার শরীরের আকৃতি। নিচের দিকে মাছের মত। মানুষের মত কোন পা নেই যা বলা যায় অনেক টা মাছের লেজ পাখার মত।
এত অপূর্ব সুন্দরী মনমোহিনী যে কিনা ,মুখের সৌন্দয্যে হেলেন অফ ট্রয় ,ক্লিওপেট্রা কে ও পিছনে ফেলে দেওয়ার মত। রিশানের মনটা বেদনায় ভরে গেল।
আমি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন আমার মায়ের এই রোগ ধরা পরে। বড় অদ্ভুতভাবে তার শরীরের নিচের অংশ শুকিয়ে যেতে থাকে ,একসময় দুই পা মিলিয়ে যায়। উনি হাটতে পারতেননা। কিন্তু পানিতে নামিয়ে দিলে শুধু সাতার কাটতে পারতেন। আমার জন্মের পর মা মারা যান। কেন না পানি ছাড়া অসুস্থ হয়ে যেতেন। বাবা সারাক্ষণ ওনাকে বাথ ট্যাব এ শুয়ে রাখতেন।
আমি পনের বছর পর্যন্ত আর সব মেয়েদের মত ছিলাম। যখন আমি নারীত্বে পৌছলাম সেদিন থেকে আমি যেন থাকতে পারছিলামনা ,মাটিতে হাটতে পারছিলামনা। একসময় আমার মায়ের মত হল আমার , দুই পা লোপ পেয়ে গেল তখন আমার বয়স আঠার। বাবা ভয় পেয়ে চলে এলেন এই সাগরের তলদেশে পৃথিবীর মানুষের আড়াল থেকে। আমার বয়স এখন চব্বিশ। ছয় বছর ধরে আমি সাগরের তলদেশে আছি , শেষের দিকে মেয়েটি মুখ ঢেকে ফেলে।
রিশান বেদনা অনুভব করে মেয়েটির পাশে বসে পড়ে।
তুমি কি কিছু খাবে ? ক্ষুধার্ত ? জিজ্ঞাসা করে মেয়েটি।
আমি শুধু সবজি খেতে পারি কিন্তু তোমার জন্য মাছ বারবিকিউ করতে পারি যদি খেতে চাও।
খেতে খেতে আর ও কিছু কথা জানা হল। তার বাবা এক আশ্চর্য্য লতা গুল্মের সন্ধান পেয়েছেন তিনি তা দিয়ে এক অয়েন্মেনট বানিয়েছেন যা এখন সে ব্যবহার করছে ,এখন শরীরে ব্যথা কম অনুভব হয়। বাবা এখন আশাবাদী যে আমি সুস্থ হয়ে উঠব। পৃথিবীতে আবার ফিরে যাব। স্থলের কোন মানুষের সাথে আমার সংসার হবে এইটুকু বলে সে হাসল।
তোমাকে এই অবস্থায় ও যে কোন ছেলে ঘর সংসার করতে চাবে আমিও চাই ,কিন্তু তা হয়তবা তোমার জন্য নিরাপদ হবেনা ,তুমি সার্ভাইব করতে পারবেনা ,মনে মনে আবেগে কথা গুলি বলতে থাকে রিশান।
তুমি কি কিছু বললে মেয়েটি হেসে জিজ্ঞাসা করে।
রিশান হেসে বলে মনে মনে বলছিলাম।
দুজনে দুজনের দিকে আবেগে তাকায়।
রিশান এর যাওয়ার সময় হয়ে এল। বিদায় নেয় সে প্রত্যাশা নিয়ে এ নিশ্চয় কোন স্বপ্ন নয়। কাল ও আমি ওকে দেখতে চাই। যদি পারতাম তাকে পৃথিবীর মাটিতে নিয়ে একসঙ্গে হাত ধরে হাটতে।
স্বপ্ন দেখছে সে এখন ই। প্রকৃতি জানে হয়ত হতে পারে কোনদিন।
সমাপ্ত