somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

পেই দো লা লোয়ার'য়ে চারদিন। পর্ব - ৪ ( পর্ণিক)

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গভীর ঘুমে জাগতিক পৃথিবী থেকে বিছিন্ন প্রায়।ক্রমাগত বেজে চলা এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।সকাল সাতটার ট্রেন ধরতে হবে। কিন্তু সমস্ত শরীরে ক্লান্তি এমনভাবে ভর করে আছে যে মন কিছুতেই সারা দিচ্ছেনা বিছানা ছাড়তে। পাশের রুমে ওরা মা মেয়ে বিভোরে ঘুমোচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ওদের দলে যোগ দিয়ে পর্ণিক ভ্রমণ বাতিল করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। পুর ট্রেনের টিকেটের টাকা জলে যাবে ভেবে শরীরের সমস্ত আলস্য ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। নাস্তা না করেই ক্যামেরাটা সঙ্গী করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম ওদেরকে ঘুমের মধ্যে রেখে।সকাল ছয়টা বাজে, সূর্যের আলো ছড়িয়ে পরেছে চারিধারে, কিন্তু রাস্তায় জনমানবের কর্মব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি।সুনসান নীরবতা,ধিরস্থির পায়ে এসে দাঁড়ালাম তেরত ট্রাম স্টেশনে। স্টেশনের ইলেক্ট্রনিক যাত্রা সূচির বোর্ড বলছে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে ট্রামের জন্য। আমি ছাড়া কোন অপেক্ষমাণ যাত্রী নেই স্টেশনে। সকালের নির্মল বাতাস আর নীরবতা দেহের ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে মনের মধ্যে অন্যরকম এক ফুরফুরে অনুভূতি এনে দিচ্ছে।ছোট্ট স্টেশনের চারপাশে পায়চারি করতে করতে অপেক্ষার সময় শেষ হয়ে গেলো। ট্রাম এসে হাজির হল স্টেশনে।আমাকে তুলে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এতো বড় একটি ট্রামে আমি একমাত্র যাত্রী।দুইটি স্টেশন পার হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক স্টেশন থেকে তিন চারজন করে যাত্রী উঠতে শুরু করলো। প্রায় ত্রিশ মিনিটের ট্রামের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম নন্ত রেল স্টেশনে। আমার ট্রেন ছাড়তে আরও ত্রিশ মিনিট বাকী।স্টেশনে প্রবেশ করে সাতটার পর্ণিকগামী ট্রেনের প্লাটফর্ম খুঁজে বের করলাম।সকালে স্বাভাবিক ভাবেই যাত্রীদের হুড়োহুড়ি কম থাকার কথা কিন্তু এতো বড় ট্রেন স্টেশনের প্লাটফর্ম শূন্য থাকলে একেবারেই বেমানান লাগে।আমরা প্যারিসের জীবনে অভ্যস্ত। প্যারিসের বড় বড় ট্রেন স্টেশনগুলোতে ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি মানুষের কোলাহল লেগেই থাকে।হঠাৎ করে ফ্রান্সের অন্য একটি বড় শহরের এমন চালচিত্র দেখে একটু হোঁচট খেতে হল। তবে নতুন অভিজ্ঞতাও অর্জন হচ্ছে। ভুতুড়ে প্লাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়।যথাসময়ে ট্রেন এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে।ট্রেন কিছু সময় অবস্থান করে পর্ণিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেট কেটেছি। আমার টিকেটের উপর একটি আসন নম্বর ও বগি নম্বর উল্লেখ রয়েছে। আমি সেই অনুযায়ী আমার নির্ধারিত বগিতে উঠে আসন খুঁজে বের করলাম। ট্রেনের মধ্যে বসে মনে মনে ভাবছিলাম, ট্রেনের টিকেট কেটেছি তিনটা এখন দেখি পুরো ট্রেনটাই আমার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে এস এন সি এফ কোম্পানি।ফ্রান্সের দূরবর্তী ট্রেনগুলোতে চলন্ত অবস্থায় এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়া যায়। আমার বগিতে কোন যাত্রী নেই। আমি আসন ছেড়ে অন্য বগিগুলো ঘুরে দেখার জন্য উদ্যত হলাম।দুটো বগি পার হওয়ার পর দেখা মিলল এক তরুণ যাত্রীর।একটি আসনে বসে জানালার মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেখতে উদভ্রান্তের মতো লাগলো। আমাকে দেখে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো। ভাষা ফরাসি ও ইংরেজির কোনটাই নয়। আমি বুঝতে পারলাম না । কারণ এ দুটো ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা আমার জানা নেই। আমি তাকে ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা জানো। তরুণটি আমার কথা কিছু বোঝেনি বলে মনে হল।আমি আর কথা না বাড়িয়ে এই কামরার প্রথম শ্রেণীর একটি আসনে গিয়ে বসলাম।যেহেতু ট্রেনে আমরা এই দুজন ছাড়া কোন যাত্রী নেই তাই আসনের এই শ্রেণী ভেদাভেদ লঙ্ঘন করা আমার কাছে অপরাধ মনে হল না।কিছুক্ষণ পর দুজন টিকেট পরিদর্শক আসলো। ঐ তরুণটির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে লাগলো তারা।সম্ভবত তাদের মধ্যে স্প্যানিশ ভাষায় কথোপকথন হলো, তাদের আচরণ থেকে বুঝলাম তরুণটি বিনাটিকেটের যাত্রী। ভিনদেশে এসে কোন সমস্যায় পড়েছে।পরিদর্শক দুজন আমার দেখার পর অন্য বগিতে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পর একটি নির্জন ছায়াঢাকা স্টেশনে এসে ট্রেন থামল। আমার সহযাত্রী যুবকটি নেমে পড়লো এই স্টেশনে।অজপারা পাড়াগাঁ বলতে আমরা যেমনটি জানি, স্টেশনের চারিপাশের দৃশ্যপট তেমনি। জনমানবহীন এলাকা।এই পর্যন্ত আসতে ট্রেনের জানালা দিয়ে এই অঞ্চলটি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেছি।ধুধু আঙ্গুর ক্ষেত,বনভূমি, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামীণ বাড়ীঘর, কোথাও আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিনার বিশিষ্ট পুরনো ধর্মীয় উপাসনালয়।
এর পর ট্রেন পর্ণিক পর্যন্ত আসতে আরও বেশ কয়েকটি স্টেশনে অল্প সময়ের জন্য অবস্থান করল।কিছু যাত্রীও উঠল সেসব স্টেশন থেকে।পুর অঞ্চলটা জুড়ে নির্মল গ্রামীণ আবহ।এমন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের তৃষ্ণা মেটে।পর্ণিক স্টেশনে নেমে মনে হল দেহ মন নতুন উদ্দাম পেয়েছে।গতরাতের না ঘুমনোর ক্লান্তি একটুও অনুভব হল না।

স্টেশনে নেমে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে ফরাসি ভাষায় শুভ সকাল বলে জিজ্ঞেস করলাম, মসীয়, পর্ণিক সমুদ্র সৈকতে যাবো কিভাবে বলতে পারেন? লোকটি খুব আন্তরিকতার সহিত সহজ করে বুঝিয়ে বললেন। লোকটির নির্দেশনা অনুযায়ী এগুতে লাগলাম।অল্প একটু এগুতেই একটি ব্রিজের দেখা পেলাম।ব্রিজটি পুরনো স্থাপত্য নক্সায় তৈরি।ব্রিজের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে চোখ মেললাম চারিধারে। পুর এলাকার অবয়ব এখানে দাঁড়িয়ে ধারনা করা যায়।সেতুর তলদেশ দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা।ছোট্ট নদীর মতো শান্ত বয়ে চলা।দুই ধারে গড়ে উঠেছে এই ছোট্ট নগরীর দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরা,ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। ছোট ছোট পাহাড়ের কোলঘেঁষে স্থানীয়দের নয়নাভিরাম বাড়িঘর। ব্রিজ থেকে একটু সামনে শত শত প্রমোদ তরী নোঙ্গর করা,পাশেই ছোট্ট একটি পুরনো প্রাসাদ বাড়ী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নদীর কোল ঘেঁষে।এর পরেই আদিগন্ত নীল জলরাশির আভা চোখে ধরা দিলো।সমুদ্রের দিক অনুমান করতে আর সংশয় রইলো না।বুঝে নিলাম সমুদ্র পারে যেতে এই নদীর পার ধরে এগিয়ে যেতে হবে।কিছুক্ষণ ব্রিজটির উপর দাঁড়িয়ে কিছু ল্যান্ডস্কেপ ছবি তুললাম। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ খুব লাগছিল। ব্রিজ থেকে নেমে কিছু দূর এগুতেই পেয়ে গেলাম একটি বুলানজারী(রুটির দোকান)।অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে সকালে নাস্তার রুটি ও পিঠা কিনছে।আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে দুটো কোয়াচ্ছ ও একটি কফি নিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম।কফি পান করার পর শরীরের ক্লান্তি ভাবটা একেবারে চলে গেলো। শরীরে বেশ চাঙা ভাব অভুভব হতে লাগলো।

রুটির দোকান থেকে বেড়িয়ে ক্যানালটির পার ধরে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।কিছু সমুদ্রগামী দর্শনার্থীদেরকে অনুসরণ করে চলে এলাম ছোট্ট প্রাসাদটির কাছে। প্রাসাদ বাড়ীর কোল ঘেঁষা নান্দনিক কাঠের সেতু,ভাঁটার কারণে সেতুর তলদেশ থেকে পানি চলে গেছে। থিকথিকে কাঁদা উপর সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে।সেতুটি পারি দিয়ে চলে এলাম একটি প্রাকৃতিক কংক্রিটের টিলার কাছে।টিলাটির উপরে ওঠার জন্য টিলার পাথরের শরীর কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সিঁড়িটি বেয়ে উঠে এলাম টিলার উপরে।এখানে উঠে দাঁড়াতেই বিশাল আটলান্টিকের জলরাশি ধরা দিলো চোখে।টিলার উপরের কিছুটা জায়গা সমতল করে কিছু বেঞ্চ বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ একটি বেঞ্চে বসে সকালের মুক্ত বাতাস আর সমুদ্রের বিশালতা উপভোগ করলাম।টিলা থেকে গলির মতো একটি রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। এই গলির রাস্তা ধরে কয়েক মিনিট হেঁটে চলে এলাম সমুদ্রের কাছে।আমি ফ্রান্স,স্পেন ও বাংলাদেশের অনেকগুলো সমুদ্র সৈকত দেখেছি কিন্তু ফ্রান্সের পর্ণিক শহরের এই সৈকতটি আমার কাছে অন্যগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হল। কারণ, সাধারণত সমুদ্র সৈকত বলতে বিস্তীর্ণ বেলা ভূমির উপর ঢেউয়ের আঁচতে পড়া , এমনটাই আমরা জানি। কিন্তু এই সমুদ্র সৈকতটিকে মনে হল একটি বিশাল নদীর পাড়।প্রাকৃতিক কংক্রিটের সঙ্গে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল পাড়।পাড়ের পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর,পাশ দিয়ে পিচঢালা রাস্তা।আমি কৌতূহলবশত এই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম।যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততোই এই অঞ্চলটি নতুনরূপে আবিষ্কার হতে লাগলো আমার কাছে।কোথাও চিরচেনা রূপের সমিল খুঁজে পাচ্ছিলাম।

আমার ছেলেবেলা কেটেছে পদ্মা নদীর পাড়ে।ছেলে বেলায় দেখেছি, শুষ্ক মৌসুমে নদী যখন শান্ত থাকতো তখন নদীর পারের কিছুটা দূরে দূরে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা নদীর মধ্যে বাঁশের মাচা তৈরি করতো। আর মাচায় যাওয়ার জন্য তৈরি করতো সেতুর মত করে বাঁশের মাচালী রাস্তা। সেই মাচায় বসে মৎস্য শিকারিরা বড়শী দিয়ে মাছ ধরত।আমাদের সেই ছোট্ট নদী এখন আর নেই,বড় নদীর ভাঙন গিলে ফেলেছে ছোট্ট নদীটাকে। নেই বাঁশের মাচায় বসে মাছ ধরার দৃশ্য।এখন শুধুই গল্প কথা আর স্মৃতি।
এখানে এসে দেখা পেলাম সেই স্মৃতির মাছ ধরার মাচা।আকৃতি ও মাছ ধরার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন।কিছুটা দূরে দূরে স্থাপিত এই মাচা। সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট কাঠের ঘর আর এই ঘরে যাওয়ার জন্য পার থেকে কাঠের পাটাতনে তৈরি রাস্তা। প্রতিটি ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে ভেসাল জাল।সকালের ভাঁটার কারণে তীর থেকে সমুদ্রের পানি অনেক দূরে। তাই এই মাছ ধরার ভেসাল জালগুলো কার্যক্রমহীন রয়েছে।সমুদ্র পারের রাস্তা ধরে হেঁটে প্রায় এক ঘণ্টার পথ পারি দিয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। সমুদ্র পারের গ্রাম, স্থানীয়দের কর্মকাণ্ড আর রাস্তার পাশের বুনোফুল,বুনো ব্ল্যাকবেরি দেখতে দেখতে সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছি প্রায়।

মনে হল এমন সুন্দর একটি জায়গা যদি সুমি ও মিশেল না দেখে তাহলে খুব ভুল করবে। পয়সা খরচ করে ঘুরতে এসে যতটা নতুন জায়গা আবিষ্কার ও নতুনত্বের অভিজ্ঞতা নেয়া যায় ততই লাভ। এটা আমার মতামত কিন্তু সুমির কথা হল ঘুরতে এসে অস্থিরতায় কাটানো যাবেনা, ঘুরতে আসা প্রশান্তির জন্য তাই ধীরে সুস্থে যতটুকও ঘুরে দেখা যায় সেটুকুই যথেষ্ট। তাই আমরা একসাথে কোথাও ঘুরতে গেলে সিদ্ধান্ত নিতে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন,টিকেট কাটার সত্ত্বেও আজ সকালের ট্রেনে আমার সঙ্গে না এসে এখনো বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে।

ঘড়ির কাঁটা দশটার সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবলাম, হয়তো ওরা এখন ঘুম থেকে জেগেছে।
সুমি’র সমুদ্র খুব প্রিয়।পর্ণিক সমুদ্র পাড়ের এই বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য ওকে বর্ণনা করলে হয়তো ওরা চলে আসতে পারে।ফোন করতেই ওপার থেকে ভেসে আসলো সুমি’র ভারি কণ্ঠস্বর। বুঝলাম, এখনো বিছানা ছাড়তে পারেনি। ওকে এখানকার সৌন্দর্য বর্ণনা করতেই আসতে রাজি হয়ে গেলো ।কিন্তু নন্ত থেকে পর্ণিক আসার ট্রেন দুপুর দুটোর পর, আমি ওকে বললাম দেখি কোন ব্লা ব্লা কার অ্যাপে কোন সিট পাওয়া যায় কিনা, আমি খুঁজে জানাচ্ছি। ব্লাব্লা কার অ্যাপে প্রবেশ করেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি কারের আসন ফাঁকা পেলাম। সুমিকে ফোন করে বললাম, সারে এগারোটার দিকে
নন্তের কমার্স এলাকা থেকে একটি কার আসবে সেটি ধরতে পারবে কিনা। ও বলল, হাতে দের ঘণ্টা সময় আছে, ধরতে পারবো আশা করি। ওর কথা মতো ব্লা ব্লা কারের দুটো সিট রিজার্ভ করে কার চালকের মোবাইল নম্বর ওকে এসএমএস করে দিলাম।ফোনে বললাম, পারলে নন্ত থেকে তোমরা ভারী খাবার খেয়ে এসো, আর আমার জন্য একটা স্যান্ডউইচ সঙ্গে করে নিয়ে এসো। তা নাহলে দুপুরের খাওয়ার জন্য নতুন জায়গায় আমাদের রুচির রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করতে সময় নষ্ট করতে হবে।
আর জানিয়ে দিলাম, আসার পর কার থেকে নেমে পর্ণিক ট্রেন স্টেশনে যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে।
ওরা এসে পৌঁছাবে সারে বারোটার দিকে, আমার হাতে আরও আড়াই ঘণ্টা সময়।আমি আর সামনের পথ না বাড়িয়ে আবার পুনরায় সমুদ্র পাড়ের সরু পথ ধরে ধীরে ধীরে রেলস্টেশনের দিকে আসতে লাগলাম।এতোটুক ঘোরাঘুরির মধ্যে এই এলাকার পথঘাট ও জীবনযাপন সম্পর্কে আমার মোটামুটি ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। হাতে সময় আছে তাই তাড়াহুড়া না করে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে সমুদ্রের গর্জনের শব্দ উপভোগ করছিলাম।ভাঁটায় সমুদ্রের তীর থেকে পানি নেমে গেছে।দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে শ্যাওলা রঙয়ের পাথরের উঁচুনিচু বিস্তীর্ণ ভূমি কিছুক্ষণ আগে জেগে উঠেছে।এই উঁচুনিচু পাথরের মাঝে পানি জমে আছে। আবার পাশেই ছোট ছোট লালচে বর্ণের বেলাভূমি ভূমি।

অঞ্চল ভেদে মানুষের জীবনযাপনে বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।যেমন পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন এক রকম, অন্যদিকে সমভূমি বা বনভূমি অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপন অন্যরকম।আবার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন ঐসব অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে।ভৌগোলিক অবস্থানের এই ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে মানুষের পেশা,খাদ্যাভ্যাস,স্বাস্থ্য,শিল্প সংস্কৃতি,খেলাধুলা ইত্যাদি।এখানেও সেই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হল।তাইতো সকালের সমুদ্রের জেগে ওঠা ভূমি সরব হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের নানা কর্মকাণ্ডে।কেউ প্রাতঃভ্রমণ করছে,কেউ গভীর জলে বঁড়শি পেতে বসে আছে মাছ শিকারের আশায়।তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ছোট ছোট খালের মধ্যে আটকা পড়েছে ঝিনুক শামুক অক্টোপাস,আর চিংড়ি মাছ। আর এগুলো সংগ্রহের জন্য অনেকেই পরিবারের ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে করে ঝাঁক বেধে এসেছে এই সমুদ্র সৈকতে।তাদের সকলের হাতে বালতি ও লম্বা হাতলযুক্ত ছাকনি।সেগুলো দিয়ে তারা ছোট ছোট খালের মধ্যে আটকা পড়া ঝিনুক শামুক, অক্টোপাস আর চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করছে উৎসব আনন্দে।

ফরাসিদের খাদ্য তালিকায় ঝিনুক একটি প্রিয় খাবার।রেস্তোরায় বসে একটি ঝিনুকের মেন্যু দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ কিংবা রাতের খাবার সেরে নেয়া যেন ফরাসিদের মধ্যে আভিজাত্য বহন করে।ফরাসি শহুরে মানুষদের এই খাবারটির জন্য বেশ খরচ করতে হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল অর্থাৎ আটলান্টিকের তীরে যাদের বসবাস তাদের কাছে এই প্রিয় খাবারটি অনেকটাই সহজলভ্য।কারণ তারা ঝিনুক শামুক প্রাকৃতিক ভাবে সংগ্রহ করতে পারে।

আমি পর্ণিক ট্রেন স্টেশনে ওদের আসার নির্ধারিত সময়ের প্রায় ত্রিশ মিনিট আগেই পৌছুলাম। এখানে ওদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে না থেকে এ পাশের আবাসিক এলাকাটা ঘুরে দেখতে লাগলাম, আর মাঝে মাঝে সুমিকে ফোন করে জেনে নিচ্ছি ওদের অবস্থান। অনেকটা পাহাড়ি অঞ্চলের মত উঁচুনিচু ভূমির মধ্যে সুশৃঙ্খল ভাবে সাজানো গোছানো স্থানীয়দের বাড়িঘর রাস্তাঘাট।গ্রামটির একপাশে ধুধু সমুদ্র আর একপাশ দিয়ে বয়েগেছে সরু ক্যানাল।সবমিলে দারুণ একটি শৈল্পিক সুন্দর শহুরে ছায়াঢাকা গ্রাম।

বারোটা পঁচিশ মিনিটে ব্লাব্লা কার ওদেরকে এসএনসিএফ গার (ট্রেন স্টেশন) এ নামিয়ে দিয়েছে। আমি দ্রুত স্টেশনে পৌঁছেই ওদের পেয়ে গেলাম।ক্যানালের পাশ দিয়ে আমার চেনা পথে ওদেরকে নিয়ে চলে এলাম সেই কাঠের সেতু পাড়ি দিয়ে ছোট্ট প্রাসাদ বাড়ী সংলগ্ন পাথরের টিলার উপর।এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখে সুমি খুব অভিভূত হল।আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলল, এখানে না আসলে ভ্রমণ আনন্দের অনেক বড় একটা অংশ থেকে বঞ্চিত হতাম।
সুমি ও মিশেলের নন্ত থেকে খেয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু ওরা না খেয়ে তিনজনের তিনটা স্যান্ডউইচ পার্সেল করে নিয়ে এসেছে। দেরী না করে তিনজন প্রকৃতির মাঝে বসে বনভোজনের আনন্দ নিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ পর্ব সেরে নিলাম।

সমুদ্র তীরবর্তী এই এলাকা এখন আমার চেনা, তাই ওদেরকে আশেপাশের এলাকার বর্ণনা করতে করতে সেই সমুদ্রের কূল ঘেঁষা রাস্তা ধরে হাঁটতে দেখতে লাগলাম।বেশকিছুক্ষণ হাঁটার পর একটি কফি বার পেলাম।বারটিতে একজন ফরাসি তরুণী কাজ করছে। গ্রামের মধ্যে বেশ পরিপাটি কফি বার।একটু জিরিয়ে নেবার জন্য আমরা বারটির মধ্যে প্রবেশ করলাম।আমার আর সুমির জন্য দুটো কফি আর মিশেল জন্য একটা আইসক্রিমের অর্ডার করে একটি টেবিলে গিয়ে বসলাম।সকালে এসে এতো ছবি ছবি তুলেছি যে ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ শেষের পথে।তিনজনের কফি আর আইসক্রিমের আড্ডার সাথে সাথে ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জটাও কিছুটা বাড়িয়ে নিলাম বার থেকে।
এখান থেকে বেরিয়ে ওরা আর হাঁটাহাঁটি করতে আগ্রহ দেখাল না। ইচ্ছে ছিল আশেপাশের গ্রামটা ওদেরকে নিয়ে ঘুরে দেখার। কিছুক্ষণ সমুদ্রপারের হাওয়ায় সময় কাটল আমাদের। সিদ্ধান্ত নিলাম দিনের বাকী সময় আমরা সৈকতে কাটাবো। সৈকতে নামার জন্য পাড়ের কিছুটা দূরত্বে দূরত্বে সরু আকৃতির সিঁড়ি তৈরি করে রাখা হয়েছে। পাড় থেকে সৈকত এতো নিচে যে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণে বেঁচে থাকা কঠিন। আমরা কিছুদূর হেঁটে এসে একটি সিঁড়ি বেয়ে সতর্কতার সহিত সৈকতে নেমে এলাম।পাশেই ছোট্ট এক টুকরো বেলাভূমি, বেলাভূমির মধ্যে রঙিন ছাতার ছায়ায় ঢাকা চেয়ার টেবিল পাতা।সেখানে বসে পর্যটক ও স্থানীয়রা আয়েশি সময় পার করছে।পাশেই টং দোকানের মতো ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁ ।এই রেস্তোরাঁ থেকে জল খাবার কিনলে এসব চেয়ার টেবিলে বসে সময় কাটানো যাবে। সকাল থেকে ঘোরাঘুরির কারণে শরীরে কিছুটা ক্লান্তি চেপে বসেছে তাই রেস্তোরাঁ থেকে তিনজনে তিনটি আইসক্রিম কিনে বালুর মধ্যের একটি রঙ্গিন ছাতার চেয়ার টেবিল আমাদের দখলে নিলাম। সৈকতের বেলাভূমি মিশেলের খুব পছন্দ। তাই ও আমাদের সঙ্গে না বসে আইসক্রিম হাতে নিয়েই বালুর মধ্যে ছোটাছুটিতে মেতে উঠলো।
এর পাশেই বালুর মধ্যে ছোট পরিসরে বাচ্চাদের খেলার নানা ইভেন্ট সাজানো হয়েছে। মিশেল সেখানে গিয়েও মনের আনন্দে খেলাধুলা করলো।

বেলা তিনটের দিক থেকে সূর্যের তাপের সঙ্গে সমুদ্রের জোয়ারের পানিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করলো।বেলাভূমির পাশে পাথরের ভূমির উপর দীর্ঘদিনের জমাটবদ্ধ অগণিত ঝিনুক শামুকের খোলস ভিন্ন রকমের সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। আমরা এই ছোট্ট বালুকা বেলা থেকে বিদায় নিয়ে তীরের এই পাথুরে ভূমি ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম দারুণ এক প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকায়।বালু,ঝিনুক শামুক আর ছোট ছোট পাথর খণ্ডের মিশ্রিত এক খণ্ড সৈকত। সামনে আদিগন্ত আটলান্টিক, পেছেন বিশাল প্রাচীরের মত পাথরের পাড়,আর এক পাশে পাথরের ঢালু পাড়ের ভাজে ভাজে সবুজ বৃক্ষরাজী।অন্যদিকে সমুদ্র কূলের বড় বড় পাথর খণ্ডের উপর বিশাল ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর রকমের শব্দ সৃষ্টি করে চলছে অবিরত। মনে হচ্ছিলো সদ্য যৌবন পাওয়া জোয়ারের শক্তিশালী ঢেউগুলো যেন মুহূর্তেই সবকিছু গ্রাস করে সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।আমরা তিনজন কূলে বসে পাথরের সঙ্গে ঢেউয়ের এই সংঘর্ষ খুব উপভোগ করছিলাম।
আমাদের মত অনেক পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন বালুর মধ্যে বসে আটলান্টিকের এই বিপুল তরঙ্গের খেলা উপভোগ করছে, কেউবা পানিতে নেমে তরঙ্গের সঙ্গে ডুবসাঁতারে মেতে উঠেছে।

আমার সমুদ্র স্নান ভালো লাগেনা। তাই গোছলের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সঙ্গে আনি নাই ।সুমি সাঁতার জানেনা, তাই নোনা জলে গা ভেজানোর প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকলেও ও ভয়ে গভীর পানিতে নামে না। কিন্তু সমুদ্রতীরে গেলেই আমাকে পানিতে নামার জন্য তাড়া দেয়। ও সঙ্গে করে তোয়ালে নিয়ে এসেছে। এবারো ও আমাকে পানিতে নামাতে বলছে মিশেলকে সঙ্গে করে। ওর জোরাজোরিতে আমার আর তীরে বসে থাকা হল না, মিশেলও পানিতে নামতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো, তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে নোনা জলে নামতেই হল। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে মিশেলকে কোলে করে পানিতে নেমে ডুবে গোছল করলাম কিছুক্ষণ। এই ঢেউয়ের মধ্যে মিশেল আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।তাই মিশেলকে সুমির কাছে দিয়ে আমি সমুদ্রের গভীর জলে সাঁতার কেটে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম।সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সাঁতার কাটার আনন্দ ভিন্ন রকমের। অনিচ্ছার সত্ত্বেও সুমির পিড়াপিড়িতে এই স্নানের মধ্যদিয়ে আমাদের সমুদ্র বিলাস পরিপূর্ণতায় ভরে উঠল।

আমরা আরও কিছুক্ষণ তীরে বসে সময় কাটানোর পর পাড়ের সুউচ্চ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। আমরা নন্তে ফিরবো ব্লাব্লা কারে। সন্ধ্যা ছয়টার সময় এসএনসিএফ গারের সামনে থেকে একজন মহিলা কার চালক আমাদেরকে তুলে নেবে। আমাদের হাতে প্রায় দের ঘণ্টা সময় রয়েছে, তাই ধীরস্থির ভাবে আশেপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখছিলাম। সমুদ্রের বিশাল পাড় ঘেঁষা কিছু বাড়িঘর কিছুক্ষণের ভাবনার জন্ম দিলো।
বাড়ীগুলো মূলত স্থায়ী বসবাসের জন্য নয়। তা দেখেই কিছুটা অনুমান করা যায়।অধিকাংশ বাড়ী দুইতলা বিশিষ্ট পুরান আমলের নক্সায় গড়া।রাস্তা থেকে প্রত্যেকটা বাড়ীর পেছনে অর্থাৎ সমুদ্রের সম্মুখে কিছুটা জায়গা রয়েছে বেড়া দিয়ে ঘেরা।সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা ছোট্ট উঠানগুলোর মধ্যে দুই তিনতে করে আরাম কেদারা পাতা রয়েছে। কিন্তু একটা বাড়ীর উঠানেও এমন কারও দেখা মিলল না যে কিনা আরাম কেদারায় বসে সমুদ্রের হাওয়া শরীর জুড়াচ্ছে,আয়েস করছে।এই বাড়ীগুলো মূলত ধনিদের অবকাশ যাপনের বাড়ী।লক্ষ লক্ষ ইউরো খরচ করে বাড়ীগুলো কিনে রেখেছে কোন এক অবসরের দিনগুলোতে অবকাশ কাটানোর জন্য।হয়তোবা এই টাকা উৎপাদনকারী ধনি মানুষগুলো টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে বছরে একদিনের জন্যও এই বাড়ীতে অবকাশ কাটানোর সময় করে উঠতে পারেনি।অথচ আমরা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো কত উৎসাহ আনন্দে নিয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে যাচ্ছি আমাদের ছোট্ট নীড়ে। এই জগতের নিয়ম খুবই অদ্ভুত! অনেকের টাকা আছে কিন্তু সময় নেই,ইচ্ছে নেই প্রকৃতি কাছে আসার।আবার অনেকের প্রবল ইচ্ছে এবং সময় থাকার স্বত্ত্বেও অর্থের টানপোড়নে আজীবনেও হয়ে ওঠেনা এমন স্বপ্নের প্রকৃতির কাছে আসার সুযোগ।

সমুদ্রের তীর ঘেঁষা এসব বাড়ীগুলো মূলত একপ্রকার ব্যবসার পণ্য।এসব অবকাশ যাপনের বাড়ীগুলো প্রতিনিয়ত কেনাবেচা হয় এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে এই সমুদ্রবর্তী পর্ণিক শহরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বাড়ী কেনাবেচা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান।এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস অনেকটা দোকানের মত।জনসমাগম রাস্তার ধারে অন্যান্য সাধারণ দোকানের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের ছোট্টখাটো অফিস।এক থেকে দুইজন কর্মী একটি ডেস্কে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে। অফিসের প্রবেশর সামনের দেয়াল স্বচ্ছ কাঁচে আবৃত।ভেতর থেকে এই কাঁচের দেয়াল জুড়ে লাগিয়ে রাখা হয় বাড়ীগুলোর ছবি এবং বিক্রয়মূল্য।রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসব দৃষ্টিনন্দন বাড়ীগুলোর ছবি কিন্তু ছবির এক কোণে লিখে রাখা বাড়ীর মূল্য দেখলে আমাদের মত অতিসাধারণ মানুষদের মুহূর্তেই আঁতকে উঠতে হয়।অথচ এক শ্রেণীর মানুষের কাছে এমন বাড়ী কেনা যেন মোয়া কিনে খাওয়ার মত ব্যাপার।

আমরা আবার সেই প্রাসাদ বাড়ীর পাশদিয়ে ফিরছিলাম।প্রাসাদ সংলগ্ন ক্যানালটি এখন পানিতে
টইটুম্বুর। সকালে যে প্রমোদ তরিগুলোকে কাঁদার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম সেই তরিগুলো এখন পানির উপর দোল খাচ্ছে। ক্যানালটির মাঝে রাজার প্রকৃতির বিশাল আকৃতির একটি পুতুল বেঁধে রাখা হয়েছে।এটিও সকালে কাঁদার মধ্যে এক কোণে পড়ে ছিল কিন্তু এখন জোয়ারের পানি পেয়ে সত্যিকারের শক্তিশালী রাজার মত বুক উঁচু করে সিংহাসন আরোহণ করে বসে আছে। এই রাজার প্রতিকৃতির পুতুলটি মিশেলের খুব পছন্দ হয়েছে। ও পুতুলটিকে ফরাসি ভাষায় একটি নাম দিলো, রোয়া দো বাতো অর্থাৎ জাহাজের রাজা। কারণ পুতুলটির চারপাশ ঘিরে অসংখ্য প্রমোদতরি বেধে রাখা হয়েছে।

গতকালের ছা-নাজায়ার শহরের ক্রেপের স্বাদ এখনো আমাদের মুখে লেগে আছে, তাই পর্ণিক সমুদ্র তীর থেকে ফেরার পথে একটি ক্রেপরী রেস্তোরাঁ খুজছিলাম কিন্তু চোখে মিলছিল না।আমরা এসএনসিএফ গারের কাছে চলে এসেছি আমাদের ব্লাব্লা কার ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই।তাই আশেপাশের এলাকাটা শেষ মুহূর্তে ঘুরে দেখছিলাম।ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম একটি ভ্রাম্যমাণ ক্রেপরী রেস্তোরাঁ।এখান থেকে আমাদের এবং মিশেলের জন্য কয়েকটি ক্রেপ কিনলাম ।কিন্তু, স্বাদ ছা-নাজায়ার বন্দরের ক্রেপের মত অতটা সুস্বাদু নয়।কিন্তু ক্ষুধার কারণে ক্রেপগুলো ঐ মুহূর্তে অমৃত হয়ে উঠলো।

সন্ধ্যা ছয়টার সময় থেকে পর্ণিক ট্রেন স্টেশনের প্রবেশ মুখের সামনে আমাদের রিজার্ভ করা কারের জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু দশ মিনিট পার হয়ে গেলেও কার চালকের দেখা মিলল না।একটু শঙ্কিত হয়ে চালকের নম্বরে ফোন দিলাম কিন্তু বার বার রিং হয়ে কল কেটে গেলো।এখান থেকে নন্তে যাওয়ার শেষ ট্রেন ছেড়ে গেছে বিকাল পাঁচটায়।অচেনা জায়গায় নিয়মের বাইরে কিছু হলেই আমার মধ্যে শঙ্কাটা দারুণভাবে চেপে বসে পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে।আরও দশ মিনিট পর পুনরায় কল দিলাম এবারও রিং হতে হতে কল কেটে গেলো।এমন পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে সুমির কপালের চিন্তার ভাজটাও ফুটে উঠেছে। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে নন্ত পৌছুতে হবে।এসব এলাকায়
সন্ধ্যা নেমে এলে একমাত্র ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া অন্যভাবে যাতায়াত কঠিন হয়ে যায়। বাস, ট্রেন থাকে না, সহজে ট্যাক্সি পাওয়া যায়না। কার চালকের কোন কারণে দেরী হতেই পারে কিন্তু ফোন করে জানিয়ে দিলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম, তার উপর বারবার ফোন দেবার পর কোন উত্তর না পেয়ে ভেতরে বিরক্তি এবং বিতৃষ্ণা ভর করে বসেছে। একেবারে আশা না ছেড়ে চালকের জন্য আর সময় অপেক্ষার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছি।পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর একজন পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব বয়সের এক মহিলা আমাদের সামনে এসে বলল আপনারা নন্তে যাবেন তাইনা।আমি বললাম, আপনি মাদাম যোছেফিন । মহিলা বলল, হ্যাঁ, দুঃখিত দেরী হওয়ার জন্য। মিটিংয়ে থাকার কারণে আপনার ফোন ধরতে পারিনি, এজন্য ক্ষমা করবেন। ঐ মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো, ঈশান কোণে গভীর ঘনীভূত হওয়া কালো মেঘ মূর্তেই উড়ে গিয়ে ধবল আকাশে রূপ নিলো।মহিলা তার গাড়ি দেখিয়ে আমাদেরকে উঠে বসতে বললেন। আমরা তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলাম। মহিলাও আর দেরী না করে মুহূর্তেই গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মূল রাস্তায় চলে এলো।পথে চলতে চলতে আমাদের একে ওপরের পরিচয় হল, গল্প হল সঙ্গে চলল বেলা শেষের প্রকৃতির সৌন্দর্য অবগাহন।আমাদের কার চালক মাদাম যোছেফিনের প্যারিস সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হল, প্যারিস একটি নোংরা শহর। সে কয়েকবার প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে প্যারিসের রাস্তাঘাটে সে ময়লা পড়ে থাকতে দেখেছে। প্যারিস সম্পর্কে যোছেফিনের অভিযোগ একেবারে অসত্য নয়।তবে,আমরা সব সময় প্যারিসে থাকি, আমাদের কাছে প্যারিসকে কখনোই নোংরা শহর মনে হয়না।সমস্যাটা হল, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত। যোছেফিন নন্ত শহরের স্থায়ী বাসিন্দা।এই অঞ্চলে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও কর্মজীবন। তাই তার চিন্তায় বদ্ধমূল ছিল, নন্ত শহরের মতই হয়তো ফ্রান্সের অন্যান্য শহরের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হঠাৎ করে যখন প্যারিসে এসে কোথাও কাগজের টুকরো বা সিগারেটের শেষ অংশ পড়ে থাকতে দেখেছে তখন সে অবাক হয়েছে।কারণ তার শহরে সে এমন দৃশ্য দেখে সে অভ্যস্ত নয়।ফ্রান্সের অনন্যা শহরগুলোতে প্যারিসের তুলনায় অনেক কম মানুষের বসবাস,তাদের অধিকাংশই স্থানীয় ফরাসি।ফরাসি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে না,ডাস্টবিন না পাওয়া না পাওয়া পর্যন্ত যে কোন প্রকার ময়লার পকেটে বহন করতে থাকে।যেমন নিজের ব্যবহার করা টিস্যু পেপার।ফ্রান্সে যত্রতত্র থুথু ফেলা,প্রসাব করা আইনগত ভাবে নিষেধ। কখনো পুলিশের সামনে পরলে অবশ্যই জরিমানা গুনতে হবে। কিন্তু জরিমানা ভয়ে নয় ,এই নিম্ন রুচির কাজগুলো না করা ফরাসিদের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই রয়েছে।কখন হাঁচি আসলে সেটাও মুখটা চেপে ধরে নিঃশব্দে করার চেষ্টা করে, যাতে অন্য কেউ তার দ্বারা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় না পড়ে এবং শব্দ দূষণে সে যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়। কিন্তু ফ্রাসে শুধু ফরাসিরাই বসবাস করে না,এই দেশে সারা পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। আর এই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের দুই তৃতীয়াংশের অংশের বসবাস এই প্যারিস ও প্যারিসের পার্শ্ববর্তী শহর জুড়ে।তাই আফ্রিকা ও এশিয়ার দরিদ্র ও শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীদের দ্বারা যত্রতত্র ময়লা ফেলা,চুরি ছিনতাই,নেশা জাতীয় দ্রব্য বিক্রয়ের মত কিছু আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলে সংগঠিত হয়, তবে তা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই অসঙ্গতি উল্লেখ করার মত নয়।

যোছেফিন খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ। পর্ণিক শহরের একটি চারতারা হোটেলে চাকুরী করে। পেশাগত প্রয়োজনে প্রতিদিন প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কাজে আসে, আবার কাজ শেষে ব্লাব্লা কারে দেয়া বিজ্ঞাপনে আমাদের মত কাউকে পেলে গেলে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গল্প গল্প করতে বাসায় ফেরেন।

গল্প করতে করতে প্রায় এক ঘণ্টার যাত্রা পথ শেষ করে আমরা চলে এলাম নন্ত শহরে। যোছেফিন ও আমাদের একে অপরের এই একঘণ্টার যাত্রা সময়ের কথা বার্তায় মনে হচ্ছিলো আমরা পূর্ব পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়।অনেক সময় দেখা যায় আপন আত্মীয় সম্পর্কের কাউকে সারা জীবনে এক মুহূর্তের জন্য আপন মানুষ বলে অনুভব হয় না, অথচ এক মিনিটের পরিচয়ের কোন মানুষ কখনো কখনো অতি আত্মার মানুষ হয়ে অনুভূতির দরজায় নাড়া দেয়। অদ্ভুত মানুষের অনুভূতি, অদ্ভুত মানুষের মন।
পেই দো লা লোয়ার'য়ে চারদিন। পর্ব - ৩ ( ছা-নাজায়ার)
পেই দে লোয়ার’য়ে চারদিন। পর্ব - ২
পেই দে লোয়ার’য়ে Pay des loir চার দিন। পর্ব - ১
সাম্য সম্মান সুন্দর ধরিত্রী
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×