somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দয়ালু কসাই!

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জনাব আব্দুল কাদির পেশায় একজন কসাই। এটি তাদের বংশগত পেশা বলা চলে। কারন তার দোকান থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই তার বাবার আর শহরের অন্য দিকে গেলেই তার বড় ভাইয়ের কসাইখানা।


বিড়ালগুলো থেকে একটি আমাকে এভাবেই পোজ দিয়েছিল।
সংবাদ সংগ্রহের তাগিতে জনাব কাদির, তার বাবা, এবং ভাইয়ের সাথে আমার অনেক আগে থেকেই পরিচয়। মূলত শহরের স্থানীয় এবং অনেক বছর যাবত এই পেশায় তারা জড়িত থাকায় আমাদের, এই পেশা সংক্রান্ত সব নিউজের জন্য তাদের পরিবার বড় একটি সোর্স হিসেবে কাজ করে।

গত সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমার কলিগ ফোন দিয়ে বললেন, 'আজ রাতে একটা নিউজ আছে। তুমি কি আমার সাথে যাবে?'
তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, আসলে এই নিউজের জন্য সেখানে রাতেই যেতে হবে। দিনে যাওয়ার মত পরিবেশ নেই আর এই ঘটনা প্রতিদিন রাতেই ঘটে থাকে।
সারাদিন ক্লাশ করে রাতে বাসায় না গিয়ে আবার নিউজে যাওয়াটা আসলে বেশ কষ্ট মনে হলেও, এই পেশাকেই যে ভালবাসি।

রাত ৮ টা তখন। আমরা ২টি ক্লান্ত প্রান গিয়ে হাজির হলাম আব্দুল কাদিরের কসাই খানায়। আব্দুল কাদির তখন দোকান পরিস্কার করে দিনের হিসেব করছিলেন।
পরিস্কার দোকানের পাশে থাকা টেবিলের একদিকে একটি প্যাকেট দেখতে পেয়ে আমি বললাম,'কাদির আবি (ভাই) ওটা কি? এটা কেন ভেতরে রাখছেন না?"
আমার কলিগ 'এটাই আজকের নিউজ' বলে মুচকি হাসলেন।

আসলে তখনও আমি নিউজের বিষয়বস্তু বিশদ ভাবে জানি না। আমার কলিগ জানেন। আর আমরা ২ পথ থেকে এসেছি এখানে। এখনও আমাদের মাঝে নিউজের বিষয়বস্তু নিয়ে কথা হয় নাই। সেই সাথে যেহেতু আমি ক্যামেরাম্যান হিসেবেই বেশীর ভাগ সময় কাজ করি, তাই আমি একটু পরে জানলেও হবে। তাড়াহুড়ো নেই।

আব্দুল কাদির দোকান বন্ধ করে সেই প্যাকেটি হাতে নিয়ে আমাদের সহ বের হলেন। আমদের একটি স্থান দেখিয়ে দিলেন আর বললেন, "আপনারা ওখানে আগে গিয়ে দাড়ান। আমি এই মোড় ঘুরে এখানে যাওয়ার পরেই আপনারা ভিডিও শুরু করিয়েন।"

আমি আমার স্থান নিয়ে নিলাম। আশেপাশে অনেক মানুষ হেটে বেড়াচ্ছে। অনেকগুলো গাড়ি পার্কিং করা সেখানে। আর কিছু দেখতে পেলাম না এখনও। অপেক্ষার সাথে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আব্দুল কাদির এবার মোড় ঘুরে এসেই, "চু চু চু" করে বেশ কয়েকবার আওয়াজ দিলেন। আমার চোখ তখন ক্যামেরার স্কিনে। স্কিনে যা দেখলাম তা হল; একটু আগে আমরা সেখানে শুধু মাত্র কিছু মানুষ আর গাড়ী ছাড়া কিছু দেখতে পাই নাই সেখান থেকেই প্রায় শ-খানিক বিড়াল বেড়িয়ে এলো। এসে আব্দুল কাদিরের গায়ে, পায়ে চুম্বন করতে লাগল। আদর করতে লাগল। আমি সত্যি অনেক অবাক হলাম। মাত্র ৫ সেকেন্ড আগেও এখানে সত্যিই কোন বিড়াল দেখি নাই।

এবার আমি বিষয়টা বুঝে ফেললাম। সেই প্যাকেটে ছিল গোশত আর আব্দুল কাদির এসেছেন এই বিড়াল গুলোকে এটা খাওয়াতে। একটু সামনে এগিয়েই একটা স্কুলের ফাঁকা জায়গা। আব্দুল কাদির এখানে এসে দাঁড়ালেন। বিড়ালগুলোও হ্যামিল্যানের সেই বাঁশিওয়ালার পেছনে ছুটে যাওয়ার মত আব্দুল কাদিরের পেছনে পেছনে গিয়ে সেখানে দাঁড়ালেন। কয়েকটি ম্যাও ম্যাও করছিল তখন। আব্দুল কাদির তাদের বললেন, " একটু অপেক্ষা কর, দিচ্ছিতো"।

আব্দুল কাদির প্যাকেট থেকে বের করে সেই গোশত গুলো বিড়াল গুলোকে দিতে শুরু করলেন।
আমি দরকারি ফুটেজ গুলো নিয়ে আমরা তার ইন্টার্ভিউ নিলাম। আমার কলিগের প্রশ্নে জবাবে তার দেয়া উত্তর গুলোই আমি এখানে একসাথে করে লিখছি;

তিনি বলছিলেন,
"আমি ২০১৪ সালে এই কাজ শুরু করি। প্রতিদিন এই বিড়ালদের ৫ কেজি করে গোশত খেতে দেই। এর মধ্যে মুরগীর পাখা, পা এবং অন্যান্য আরো পশুদের থেকে ভাল গোশতও দেই। এই কাজ অনেকটা আমার কাছে একটি ওয়াজিফা (মানুষ মারা যাওয়ার আগে কাউকে কিছু করতে বলে যাওয়া) এর মত এসেছে।
আমাদের এখানে এক আর্মি অফিসার ছিলেন। তার নাম ছিল জস্কুন। উনি চাকরী থেকে অবসর পাওয়ার পর প্রতিদিন রাতে আমার দোকান থেকে ৫ কেজি গোসত কিনে নিয়ে আসতেন। কিন্তু কেন উনি প্রতিদিন রাত ৮ থেকে ৮.৩০ এর মধ্যেই এই গোসত কিনতেন আমি তখনও জানি না। তবে প্রতিদিনই কিনতেন।
একদিন তার পেছনে ছুটে আমি আবিস্কার করলাম যে, উনি এলাকার বিড়ালদের এগুলো খেতে দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন রাত ৮ থেকে ৮.৩০ এর মধ্যে। এটাই এই বিড়াল গুলোর ডিনার টাইম (হাসলেন)।

জস্কুন ভাই, হঠৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। আমি তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। তখন উনি আফসোস করে বলছিলেন, 'আমি মরে গেলে আমার বিড়াল গুলোর যে কি হবে?'
তখন আমি তাকে বললাম, 'জস্কুন ভাই, আমি আপনার এই বিড়াল গুলোকে দেখব। কথা দিলাম।'
কদিন পরে জস্কুন ভাই মারা গেলেন। আর সেই দেয়া কথা রাখতে আমি ২০১৪ সাল থেকে প্রতিদিন রাতে ৮ থেকে ৮.৩০ এর মধ্যে এই বিড়াল গুলোকে গোসত দেই। আর যতদিন বেঁচে আছি এটা আমি করে যাব। আমার চলে যাওয়ার পরেও যদি কেহ এই দায়িত্ব নিতে চায় আমি অনেক আনন্দিত হব।

এই বিড়াল গুলো এখন আমাকে চিনে। আমি এসে ডাক দিলেই আমার পায়ে এসে আদর করে। গায়ে জড়িয়ে পরে। আমার কাছে এটাই পৃথিবীর সেরা সুখগুলোর একটি মনে হয়। আমি যখন শহরের বাহিরে যাই কাউকে এই খাওয়ানোর কাজটি দিয়ে যাই।যাতে এই বিড়াল গুলো না খেয়ে রাতে না ঘুমায়।

এলাকার মানুষেরা আমাকে মাঝে মাঝে এসে বলে, 'আচ্ছা এই সপ্তাহের জন্য বিড়ালগুলোর দায়িত্ব আমি নিলাম। তুমি খাইয়ে দিও। আমি টাকা দিচ্ছি।' আমি তাদের সাহায্যও গ্রহন করি।" আব্দুল কাদির বলছিলেন।

তার শেষ কথা ছিল, "কেহ কিছু দিবে বা না দিবে আমি সেই ভরসা করি না। আমি যতদিন বেঁচে আছি এই বিড়ালগুলো ক্ষুদার্থ থাকবে না।"

আমরা একজন দয়ালু কসাই থেকে পশু প্রেম শিখে তাকে সালাম দিয়ে সেদিনের ফিরে এলাম।।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:১৬
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×