তালেবান সম্পর্কে একটি কথা প্রায় শোনা যে, আর সেটা হলো তালেবান নারী বিদ্বেষী। কিন্তু তালেবান সৃষ্টির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তালেবান তৈরি হয়েছিলো মূলত নারী নিপীড়ন বন্ধ করবার জন্য। আপনি এই ইতিহাস সহজে খুঁজে পাবেন না। আপনাকে এই তথ্য পেতে হলে অনেক পড়তে হবে, খুঁজতে হবে। আমাকেও অনেক খুঁজতে হয়েছে। কারণ নারীদের সম্মান রক্ষায় তালেবানদের ইতিহাস চাপা দেওয়া না গেলে তালেবানদের নারী বিরোধী বা বিদ্বেষী বলে প্রচার চালানো সম্ভব হত না।
তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, তালেবানদের নারী সম্পর্কে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। যা পশ্চিমা ধাঁচের নারী অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা “নারী” প্রশ্নে তালেবানদের স্ট্যান্ড অনেকেই অপছন্দ করতে পারি, সমালোচনাও করতে পারি। আমারও ব্যক্তিগত মতামত আছে। কিন্তু সেজন্য এন্টি-তালেবান ন্যারেটিভ তৈরির জন্য ইতিহাস চাপা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তালেবান সম্পর্কে এটা বলা হয়, তালেবান “আই.এস.আই” –এর তৈরি, কেউ কেউ আবার বলেন “সি.আই.এ” –এর তৈরি। কিন্তু এই যুক্তিও পুরোপুরি সত্য নয়। তালেবান মূলত তৈরি হয়েছিলো স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে। ঠিক যেভাবে সোভিয়েত তৈরি হয়েছিলো, যারা সোভিয়েত বিপ্লব করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় “সংগ্রাম কমিটি” তৈরি হয়েছিলো এলাকায় এলাকায়, ঠিক সেই ভাবেই।
তালেবান তৈরির সময়ে কোন ভিন্ন রাষ্ট্রের বা কোন গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার গল্প অন্তত ইতিহাস সমর্থন করে না। আজকেই দেখুন না, তালেবান কে “Legitimate Political Force” হিসেবে জাতিসংঘ অবধি সমর্থন জানিয়েছে। আপনাদের অনেকেরই তাদের রাজনৈতিক দর্শন বা রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পছন্দ নাও হতে পারে। অনেক সমালোচনাও থাকতে পারে, সত্যি বলতে আমার নিজেরও আছে। কিন্তু জাতিসংঘ যাদের একটি “Legitimate Political Force” হিসেবে সমর্থন দিয়ে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করতে বলেছেন তাই তাদের উত্থানের কারণ জানাটা অ্যাকাডেমিক কারণেও জরুরী নয় কি?
তালেবান তৈরির ইতিহাস আপনি পাবেন “জেমস ফার্গুসন” –এর লেখা “The True Story of the World’s Most Feared Guerrilla Fighters” বইটিতে। আমি সেই বই থেকেই তালেবান গঠনের ইতিহাস আপনাদের জানাবো। যা আপনি অন্য কোথাও সহজে খুঁজে পাবেন না।
১৯৯২ সালে সোভিয়েত সমর্থিত নজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর চার বছর ধরে আফগানিস্তানে চলে এক ভয়াবহ অরাজকতা। কোনো শাসন নেই, আইন নেই, বিচার নেই একেক দিকে একেক যুদ্ধবাজেরা তাদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। চাঁদাবাজি হচ্ছে, ডাকাতি হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ধর্ষণ চলছে। এইবার লর্ডরা কেউ সাবেক মুজাহিদিন, কেউ সাবেক নজিবুল্লাহ সরকারের সামরিক অফিসার, কেউ বা নিছকই দুর্বৃত্ত ডাকাত। এই প্রেক্ষাপটে গল্পের শুরু।
যখন আফগানিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় এই দস্যুদের চেকপোস্ট। তারা চাঁদা তোলে সবার কাছে, জুলুম করে। চাঁদা দিতে কেউ রাজি না হলে তাদেরকে পেটানো হয়, খুন করা হয়, অপহরণ করা হয়। চাঁদা দিতে দিতে একসময় নিঃস্ব হয়ে যায় ব্যবসায়িকরা। ঠিক যেভাবে আমাদের ট্রাকগুলো চাঁদা দিতে দিতে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন, ঠিক সেভাবেই।
পণ্যের দামের কয়েক গুণ দস্যুদের চাঁদা দিতেই চলে যায়। একটা বা দুটো নয়! শত শত চেকপোস্টে তোলা হত চাঁদা। যার অস্ত্র আছে সেও একটা চেকপোস্ট বসিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরুপ বলছি, কান্দাহার থেকে পাকিস্তানের বর্ডার ছিলো ৬৫ মাইল দূরে। আর এই ৬৫ মাইলের মধ্যে চাঁদা তোলার চেকপোস্ট ছিলো প্রায় ৫০টি। কান্দাহের ছিলো সবচেয়ে কুখ্যাত এক ডাকাতের চেকপোস্ট। তার নাম হলো, “সালেহ”।
নামে ফেরেশতা কিন্তু কাজে ঠিক ততখানি শয়তান। এই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি চেকপোস্ট বসিয়েছিলো। সে শুধু চাঁদা-ই তুলতো না, যে নারীকে পছন্দ হত তাকেই তুলে নিয়ে যেত। প্রাণে অবশ্য মারতো না কিন্তু আটকে রেখে ও পালা করে তাদের সম্ভ্রম হানি করতো এই শয়তানেরা। কিন্তু দুই হতভাগ্য তরুণী প্রাণে বাঁচেনি।
হেরাথ থেকে কান্দাহার আসার পথে সালেহের বাহিনীর হাতে তারা পরে। তাদের নরপশুরা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হোন না, তাদেরকে পেটাতে পেটাতে হত্যা করে। তারপরেও তারা ক্ষান্ত হয় না, এই নারীদের উলঙ্গ মৃত দেহ চেকপোস্টের সামনে ফেলে রাখে। খোদা-তায়ালার কাছে ফরিয়াদ জানানো ছাড়া দরিদ্র, প্রতিরোধহীন, গ্রামবাসীর এই নির্মমতা দেখেও কিছুই করার ছিলো না।
এর কয়েকদিন পরেই কান্দাহার শহরে এক যুদ্ধ শুরু হয় তিন যুদ্ধবাজের মধ্যে। একজনের নাম ওস্তাদ আব্দুল হালিম, একজনের নাম হাজী হাম্মেদ, আরেকজনের নাম মোল্লা নকিব। এই তিন ওয়ার লর্ড পাঁচদিন ধরে যুদ্ধ চালায় কান্দাহারে। এই তিনজনের লড়াইয়ে কান্দাহার ধ্বংসস্তূপে রুপান্তরিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় মরদেহ। সারা শহর জুড়ে জ্বলছে আগুন আর উঠছে ধোঁয়া।
৬ষ্ঠ দিন ছিলো শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পরে কান্দাহারের বাসিন্দা একটি গণমিছিল শুরু করেন। হঠাৎ এই গণমিছিলের সামনে এক ট্যাঙ্ক নিয়ে হাজির হোন এক সাবেক মুজাহিদিন। তার নাম বাডু। হেন অপরাধ নেই যা এই বাডু করতো না। সে লুট করতো, চাঁদাবাজি করতো, ধর্ষণ করতো আর খুনের মহোৎসব চালাতো।
কোন উস্কানি ছাড়াই বাডু সেই মিছিলে ট্যাঙ্ক থেকে ফায়ার করে। অনেক মানুষ মারা যান। আমার সংখ্যাটা ঠিক জানা নেই, আহত হয় শত শত জন। কান্দাহার গভীর শোকের চাদরে মুড়ে থাকে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকে।
কিন্তু সেদিন আরেক সাবেক মুজাহিদিন তার চোখে ঘুম নেই। তার নাম মোল্লা আব্দুস সালাম জাইফ। মওলানা জাইফ সোভিয়েতরা চলে যাবার পরে অস্ত্র ত্যাগ করে একটি গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। এর পাশাপাশি একটি ছোট মাদ্রাসা চালাতেন। ঘুমহীন চোখে মওলানা জাইফ কাঁদতে থাকলেন আর ভাবতে থাকলেন কীভাবে এই অসহায় গ্রামবাসীকে সাহায্য করা যায়? বিদ্যৎ চমকের মত তার মাথায় এলো একটি নাম, “মোল্লা ওমর”। আরেক সাবেক মুজাহিদিন। যার সাথে থেকে, কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছেন মোল্লা জাইফ সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে।
সোভিয়েতদের যুদ্ধের সময়ে দুজনেই বোমা বর্ষণে আহত হয়েছিলেন। মোল্লা ওমর সেই যুদ্ধে একটি চোখ হারিয়ে কান্দাহারের পঁচিশ মাইল দূরে সাঙ্গিসারে একটি মাদ্রাসা চালান। মোল্লা জাইফ অস্থির হয়ে মোল্লা ওমরের সাথে দেখা করতে যান পরের দিন। দীর্ঘদিন পরে তার কমরেড কে পেয়ে একে অপরের কুশলাদি বিনিময় করে মোল্লা জাইফ মোল্লা ওমরকে বলেন, “ভাই আমাদের এই গ্রামবাসীকে জুলুম থেকে রক্ষা করতে হবে, এই দূর্দশা সহ্য করা সম্ভব নয়”।
মোল্লা জাইফ মোল্লা ওমরকে বলেন, এই কাজের নেতৃত্ব আপনাকেই দিতে হবে ভাই। মোল্লা ওমর কিছুটা ইতস্তত বোধ করছিলেন কারণ তার স্ত্রী কিছুদিন আগেই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তবুও মোল্লা ওমর কিছু সময় পর সম্মতি দেন। তিনি বলেন, এই কাজটি খুবই ঝুকি সম্পন্ন। আমি আমার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তান ও পরিবারের নিরাপত্তা কে কুরবানি দিচ্ছি। কিন্তু আপনারা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে গেলে আমাকে ত্যাগ করবেন না তো?
মোল্লা জাইফ আর তার সাথে থাকা সবাই শপথ নেন যে, দৃঢ়ভাবে মোল্লা ওমরের নেতৃত্ব মেনে নেবেন আর কখনোই তাকে ত্যাগ করবেন না।
পরদিন মোল্লা জাইফ ও মোল্লা ওমরের ছাত্র এবং সাবেক মুজাহিদিন মিলে একটি মাটির মসজিদে যান। যার নাম ছিলো, সাদা মসজিদ। সেখানে শপথ নিয়ে তারা গঠন করেন তালেবান বাহিনী।
কিন্তু তালেবানদের কোন রসদ ছিলো না। সামান্য কয়েকটা পুরনো অস্ত্র, টাকাও ছিলো না। কিন্তু বিপরীতে যেসব দুর্বৃত্ত রয়েছে তাদের তুলনায় কিছুই না। মওলানা জাইফ তার সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ ১০ হাজার আফগানি মুদ্রা দান করেন তালেবানের তহবিলে। এটাই তাদের প্রথম ফান্ড ছিলো। কিন্তু এই দশ হাজার আফগানি মুদ্রা ঠিক কতটুকু? এই টাকা দিয়ে সে সময়ে কাবুল শহরের একটি রেস্টুরেন্টে দশজনের একটি মাঝারি মানের ডিনার করা সম্ভব ছিলো। তারমানে আমাদের হিসেবে তিন বা সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা।
আর সাথে ছিলো একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আর সেটা হলো রাশাদের ফেলে যাওয়া একটি মটরসাইকেল। তবে তার কোন সাইলেন্সার ছিলো না। মানে বিকট শব্দ হত। ফলে অনেক দূর অবধি থেকে শোনা যেত যে, তালেবানেরা আসছে। এই শব্দের কারণে গ্রামবাসী এই মটরসাইকেলের নাম দেন, “ইসলামের ট্যাঙ্ক”।
এই ট্যাঙ্ক যখন চলতো তখন গ্রামবাসীদের মনে আনন্দ ও খুশী দেখা যেত। এরপর তারা একের পর এক চেকপোস্টে হামলা করেন। ইয়াকুত, বিসমিল্লাহ, পীর মোহাম্মদ ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম।
এই সব চেকপোস্ট গুড়িয়ে দেওয়ায় গ্রামবাসী আশ্বাস তো পায় পাশাপাশি শত শত যুবক অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন তালেবানদের সাথে। এরপর ঐ কুখ্যাত সালেহ, তাকেও তালেবানরা পরপারে পাঠিয়ে দেন। এবং তার মুখে পাপের টাকাগুলো গুজে দেয়।
তারপরের ইতিহাস মোটামুটি সবারই কিছু না কিছু জানা আছে। একবার ভাবুন তো, আপনি যদি এই দরিদ্র গ্রামবাসী হতেন? আপনার বাবা কে যদি ট্যাঙ্কের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হত? তাও জুম্মার নামাজের পরে। আর আপনার বোনেরা যদি দিনের পর দিন এই দুর্বৃত্তের দ্বারা নিগৃহিত হত? আপনি তাহলে ঠিক কি করতেন?
- মেহেদি হাসান(Mehedi Hasan)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২১ ভোর ৪:০০