আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন তখন হঠাৎ দেখলেন একটি মোটরসাইকেল রাস্তা খারাপ হওয়ায় পিছলে পড়ে গেছে। আপনার থেকে সামান্য একটু দূরে। ধরে নিচ্ছি, যিনি পড়ে গেছেন তিনি বেশ সাবধানেই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন কিন্তু রাস্তা অধিক খারাপ হবার জন্য হোক বা অজানা রাস্তার গর্ত হোক, তার কিন্তু এখন আপনার সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আপনি মনে মনে ভাবছেন যে, এই রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড় দেখছি। যেহেতু মোটরসাইকেলের ড্রাইভার বাজে ভাবে জখম হতে পারেন বা সম্ভাবনা আছে সেহেতু আমাকে বাকিদের প্রতিক্রিয়া দেখে তাকে সাহায্য করতে হবে।
মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের অনেকের মনে এমনিতেই বিরুপ প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান সেক্ষেত্রে আপনি অন্য কোন যানবাহন নিয়ে পুরো বিষয়টি কল্পনা করতে পারেন। এখন যিনি মোটরসাইকেলের নিচে পড়ে আছেন (ড্রাইভার) তাকে সবাই ‘হা’ করে দেখছেন এবং দূর্ভাগ্যবশত সবাই আপনার মত করেই ভাবছেন। হতে পারে কিছু মানুষ আপনাকে চেনেন বা জানেন। তাই তারা চাইছেন যে, আপনি কি করেন বা করবেন সেটা দেখেই তারা তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করবেন। এই চিন্তার ‘সময়কাল/ব্যাপ্তি’ ঐ আহত ব্যক্তির অবস্থা নিহত হওয়ায় পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রায় ক্ষেত্রে মানুষ এগিয়ে আসেন না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া কিন্তু সত্যিই উক্ত ব্যক্তির জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আমি যদি সমস্যা সৃষ্টি হত না এমন ঘটনাও উল্লেখ করি তাহলেও মানুষের মধ্যে একইরকম প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর এই মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাকে বলা হয়, ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট/প্রভাব (Bystander Effect)’। মানুষের এই মানসিক প্রবণতা প্রথম ব্যাপক আলোচনার টেবিলে আসে ১৯৬৪ সালে কিটি জেনোভেসের হত্যাকাণ্ডের পর। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক। তার হত্যাকাণ্ডের সময় চিৎকার চেঁচামেচি করার কারণে বহু প্রত্যক্ষদর্শী দেখেও না দেখার ভান করেন এবং সবার সামনে তিনি নিহত হোন।
আমি ভুল হতে পারি তবে আমার ধারণা বাংলাদেশে ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট (Bystander Effect)’ এর ব্যাপকতা এরচেয়েও বেশি। বিশ্বজিৎ হত্যার সময় আমরা দেখতে পাই মাত্র কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীর আক্রোশে পড়ে কুপিয়ে হত্যার বিষয়টি। এই ভিডিওটি আজও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম সহ নিউজ পোর্টালে বিদ্যমান। মানে হলো, ভিডিও ধারণ করার লোক পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলো, তাও একাধিক এঙ্গেলে! কিন্তু অন্তত একজন বিশ্বজিৎ কে বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন না। এই দৃশ্য একজন বাংলাদেশী হিসেবে প্রথমবার আমাকে ছোটো-খাটো ট্রমায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
এরপর ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট (Bystander Effect)’ এর আরো ভয়াবহ রুপ আমাদের সামনে আসতে শুরু করে। কিশোর গ্যাং ও নয়ন বন্ডের জনসম্মুখে একাধিক হত্যাকাণ্ড আমাকে শুধু শিহরিত করে নি, রীতিমতো ট্রমায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ, একটি অপ্রকাশিত ফুটেজে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গণহত্যা কে দেখতে পাই। এখানে অপ্রকাশিত ফুটেজ সহ একাধিক প্রকাশিত ফুটেজে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা আমরা জাতি হিসেবে কি ভয়ানক পরিমাণ ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট (Bystander Effect)’ দ্বারা প্রভাবিত।
আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়, জেলে লেখক মুশতাক আহমেদ কে ইলেক্ট্রিক শক্ দিয়ে হত্যার কথা। অথচ, তিনি ছিলেন হাই-সিকিউরিটি কারাগারে বন্দী। এখানে বাংলাদেশ সরকারের জবাবদিহিতার জন্য কলামিস্ট, ব্লগার, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অতি লঘু মানের ছিলো। মানছি, দুই-একজন কথা বলেছিলেন কিন্তু তা দিয়ে চাপ তৈরি করা সম্ভব হয় নাই। আমি নিজেও একজন ব্লগার হিসেবে প্রতিবাদ করার জন্য ভয় করেছিলাম। কারণ রুই-কাতলাদের ভূমিকা বোধহয় আমিও দেখছিলাম। তাঁরা যেহেতু চুপ আছেন সেহেতু একধরনের ‘Conformity’ আমার কাছে ছিলো যে, আমাকেও চুপ থাকতে হবে যা ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট (Bystander Effect)’ এর যথার্থ প্রতিফলন ছিলো।
আজকের এই প্রবন্ধ এখানেই শেষ করছি একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে,
এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না। যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে।
– আলবার্ট আইনস্টাইন
Also Read It On: বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট (Bystander Effect): কেন আমরা সাহায্য করতে পিছিয়ে যাই?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ২:০৬