somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মি. বিকেল
আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

শেষ লেনদেন: স্বপ্নের দাম কি মৃত্যুর চেয়েও বেশি?

১১ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শেষ লেনদেন: স্বপ্নের দাম কি মৃত্যুর চেয়েও বেশি?
(Death of a Salesman by Arthur Miller - Book Review)

যদি কেউ মৃত্যুর পর টের পেত তার জানাজায় মানে শেষকৃত্যে মাত্র পাঁচ জন মানুষ উপস্থিত হয়েছে। তার স্ত্রী, তার দুই সন্তান, একজন বন্ধু ও তার ছেলে। তখন তার কেমন লাগবে?

এই কথাগুলো কতই নিষ্ঠুর তাই না! শুনতেই খারাপ লাগছে। আমি আসলে নাট্যকার আর্থার মিলারের ‘Death of a Salesman’ নাটকের কথা বলছিলাম। এই নাটকের প্রধান চরিত্র উইলি লোমান একজন সাধারণ বিক্রয়কর্মী। কিন্তু তার চোখে অনেক স্বপ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেড়ে ওঠা উপ-ভোগবাদী ‘আমেরিকান ড্রিমস্‌’ পূরণে তিনি তার পুরো জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

এক অর্থে এই পুঁজিবাদী সমাজে আমরা সবাই বিক্রয়কর্মী। আমরা সবাই নিজেদের কিছু না কিছু বিক্রয় করে থাকি। আমরা বিক্রি হতে চাই। আমরা চাই আমাদের একটি আক্ষরিক মূল্য থাকুক। ভালো পোশাক-আশাক পরে একজন ভদ্রলোকও আশা করেন, ঐ পোশাকে তিনি হয়তো বেশি স্বাগত হবেন। কিন্তু উইলি লোমান রিপ্রেজেন্ট করে আমাদের চারপাশে যারা দোকান থেকে দোকানে, এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় এবং এক শহর থেকে আরেক শহরে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বিক্রয় করছেন।

বিক্রয়কর্মী হিসেবে উইলি লোমানের রেকর্ড ভালো ছিলো না। ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে ঘুরতে থাকা এই নাটকে উইলি লোমান বারবার ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে দেখেন, তিনি ১০০ ডলার টার্গেট পূরণ করতে পারছেন না, টার্গেট কমিয়ে ৫০ ডলার করার অনুরোধ করছেন, মালিক/ম্যানেজার হাওয়ার্ড তাকে বরখাস্ত করছেন ‘Wagner Company’ থেকে। তিনি মাস শেষে বাড়িতে এসে তার স্ত্রী লিন্ডা লোমান কে জানান, তিন হাজার মাইল ঘুরে ঘুরে সপ্তাহ শেষে তার কমিশন মাত্র ৭ ডলার। বিক্রয় প্রায় শূন্যের কাছকাছি। হয়তো চাকুরী থাকবে না।

আবার লিন্ডা লোমান স্ত্রী হিসেবে খুবই অনুগত ও সহিষ্ণু। তিনি উইলি লোমানের একজন অবিচল সমর্থক। উইলি যখন মিথ্যে বলে, স্বপ্ন দেখে, ঘরে ঘন ঘন মেজাজ হারায়, লিন্ডা তখনও তাঁর পাশে দাঁড়ায়। নাটকের শুরুতে উইলি বলে, “I’m tired to the death,” লিন্ডা তাঁর জুতো খুলে দেয়, কফি গরম করে দেত কিন্তু কোনো প্রশ্ন নয়, শুধুই আগলে রাখে।

এমনকি উইলির কমিশন কমে যাওয়ার পরও লিন্ডা বাড়ির কিস্তি, ফ্রিজের কিস্তি, ওয়াশিং মেশিনের কিস্তি… প্রায় সবটাই কিছুটা সেলাই-বুনন, কিছুটা ধার-দেনা করে (উইলির একমাত্র বন্ধু চার্লির থেকে) সামলান। নাটকে এক পর্যায়ে দেখা যায়, তিনি নিজেই ঘরের পর্দা সেলাই করছেন, কারণ নতুন পর্দা ক্রয়ের সামর্থ্য তাদের আর নাই।

কিন্তু এতকিছুর পরেও লিন্ডা তার সন্তান বিফ কে বলতেন, “Your father is the dearest man in the world to me.”। অবশ্য এরমানে এই নয় যে, লিন্ডা লোমান স্ত্রী হিসেবে গাধী ছিলেন। তিনি জানতেন, তার স্বামীর স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। তিনি এটাও বুঝতেন, একজন বিক্রয়কর্মীর পক্ষে জীবনে অনেককিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু স্বামীর প্রতি তিনি কখনোই বিরুক্ত হতেন না।

উইলির দুই ছেলে, বিফ ও হ্যাপি। উইলি হ্যাপি কে পাত্তা দেয় না বা হ্যাপির মধ্যে বিফ কে দ্যাখে। এতে করে হ্যাপি মনে অনেক কষ্ট পায়। উইলি মনে করে একসময়ের ফুটবল স্টার এবং স্কলারশিপ পাওয়া বিফ-ই পারবে মহান মানুষ হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু বিফ-এর চুরি করার অভ্যাস সামনে এসে যায়। যেমন: খামারে ঘোড়া চুরি, ফ্লোরিডায় সুটকেস চুরি।

আর বিফ হাই-স্কুল ফাইনালে বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে বোস্টনে যায়। হোটেলের ঐ রুমের দরজা খুলতেই নিজের বাবার পরকীয়া সামনে আসে এবং তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা হারায়। সে দেখে তার বাবা ঐ মহিলাকে তার মায়ের হাতে বোনা ‘সিল্ক স্টকিং’ উপহার দিয়েছে। কিন্তু এখানে এই পরকীয়ার রহস্য হলো, উইকি লোমান তার বিক্রয় বাড়াতে চাইছিলো ঐ মহিলার মাধ্যমে যাতে করে চাকুরিচ্যুত না হতে হয়। আর এই চাকুরীর মাধ্যমেই তাদের সংসার চলছিলো।

উইলির একমাত্র বন্ধু এবং একইসাথে প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন চার্লি। চার্লি কে নিয়ে উইলি উপহাস ও ঠাট্টা করেন। কারণ চার্লি উইলির মতে, একজন সফল ব্যক্তি। কিন্তু দিনশেষে বন্ধু চার্লির কাছে থেকে টাকা ঋণ না নিলে উইলির সংসার চলে না। আর একারণেই চার্লি একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করলেও উইলি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে চার্লিকে দেখা যায় নিখাদ ভালো একজন বন্ধু হিসেবে। বিশেষ করে শেষকৃত্যে উইলির মৃত্যুতে চার্লি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

বেন, উইলির মৃত বড় ভাই, কিন্তু উইলির কল্পনায় তিনি বারবার ফিরে আসে। বেন আফ্রিকা-আলাস্কায় স্বল্প সময়ে লাভবান হয়েছিলো। তাই উইলি বারবার স্বপ্ন দেখেন যে, “আমি যদি ওর (বড় ভাই বেন) মতো ওখানে যেতাম।” আর সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লিটল হাওয়ার্ড হলো হাওয়ার্ড ওয়াগনার এর ছেলে। একসময় উইলি লিটল হাওয়ার্ড এর ডায়াপার পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিয়েছেন। বড় হয়ে এই লিটল হাওয়ার্ড বা ‘হাওয়ার্ড’ উইলিকে চাকুরিচ্যুত করেন।

সারাজীবন উইলি বিশ্বাস করেছে, “Be liked and you will never want.” কিন্তু শেষে এসে দেখলো, জনপ্রিয়তা দিয়ে ঘর ভাড়া দেওয়া যায় না, কিস্তি মেটানো যায় না। তাই তার দেখা স্বপ্নের প্রতিটি ইট আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে, আর সে নিজেকে এসবের জন্য দায়ী মনে করে। নিজের ‘অপূর্ণতা’র জন্য, নিজের ‘অযোগ্যতা’র জন্য।

তার মনে পড়ে লিন্ডা একবার বলেছিল, “We’re free and clear after the house.” উইলি ভাবল, যদি সে মরে যায়, ২০ হাজার ডলারের লাইফ ইন্স্যুরেন্স ছেলেদের ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করবে; মৃত্যুও যেন একটা ‘লেনদেন’। তার কাছে মৃত্যু শুধু মুক্তি নয়, শেষ বিক্রি। নিজের দেহ বিক্রি করে ছেলেদের ভবিষ্যৎ কিনে দেওয়া।

যে মানুষটা সারাজীবন ‘well-liked’ হতে চেয়েছে, শেষে দেখে তার শেষকৃত্যে পাঁচজনের বেশি মানুষ আসবে না। সেই ভাবনাটাই তাকে পথের শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়: “A man is not a piece of fruit; you can’t eat the orange and throw the peel away.” সে নিজেকে সেই ফেলনা খোসা ভাবতে শুরু করে।

সবগুলো কারণ একসঙ্গে তাকে ঘিরে ফেলে। অর্থ, পেশা, পারিবারিক ব্যর্থতা, অপরাধবোধ, স্বপ্নের ধস। তারপর সেই একটিই পথ, যেখানে সে ভাবে, মৃত্যুই তার শেষ ‘গুড ডিল’।

ছবি: vidIQ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:১৩
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×