somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিন্নি কি- কুত্তি কি- প্রহসনী

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



___তিন্নি আত্মহত্যা করেছে, এই খবর পেয়ে আমার কান্না করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি নি।

আমার মনে পড়ে গেল পুরনো কথা। তিন্নি প্রায়ই জানতে চাইত,'আমি চলে গেলে তুই কি করবি?'
'কিছুই করব না।'
'কান্না করবি না আমার কথা ভেবে?'
'না।'
'কেন?'
'তুই অনেক আগেই খরচের খাতায় নাম তুলে ফেলেছিস। তোকে নিয়ে কান্না করে লাভ কি?'

তিন্নি রাগ করত না। আহত চোখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। মনে মনে হয়ত ভাবত, আমি পাষাণ। কিন্তু তিন্নির ভাবনাটা সত্যি ছিল না। আমি ওর জন্যে অনেক কেঁদেছি। গোপনে অনেক চোখের জল ফেলেছি। তিন্নি ছিল একজন রূপ উপজীবিনী। দেহ ভাঙিয়ে টাকা ইনকাম করত।

আশ্চর্য, আমার হাত কাঁপছে! লিখতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ তিন্নি নিজেই বলেছিল, 'আমি মারা গেলে তুই সুন্দর একটা গল্প পাবি। লেখকদের জীবনে নানা জাতের মানুষের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমি তোর জীবনে একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা!'

তিন্নির সাথে আমার পরিচয় কলেজে পড়ার সময়। আমরা একই সেকশনে ছিলাম। আমি লিখতাম কবিতা, তিন্নি করত অভিনয়। মঞ্চ নাটক করত। টিভিসিতে সাইড ক্যারেক্টার পেত। ইচ্ছে ছিল একদিন খুব বড় স্টার হবে। তিন্নির আগুনের মতো রূপ ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ততটা পাকা ছিল না। কেউ সামান্য একটু প্রশংসা করলেই গলে যেত।

মিডিয়া জগতে ব্রেইন ওয়াশ করার মত অনেক রকম থেরাপী আছে। সবচেয়ে কমন একটা থেরাপী হল,"সৌন্দর্যই শক্তি!" তিন্নিকে এই থেরাপী দিয়েই প্রলুব্ধ করা হয়েছিল।

প্রথম দিকে এই নিয়ে তিন্নির সাথে আমার খুব ঝগড়া হত। তিন্নি বলত,' সৌন্দর্যই শক্তি !'
আমি বলতাম,'ভুল চিন্তা।'
'তুই বিশ্বাস করিস না?'
'উহু।'
'চল তোকে প্রমাণ দিয়ে দেখাচ্ছি।'
'কিভাবে প্রমাণ দিবি?'
'আমরা দুজন একটা লোকাল বাসে উঠব। কন্ডাক্টর যখন ভাড়া নিতে আসে বলব টাকা নেই। তুইও বলবি, আমিও বলব।'
'তাতে কি হবে?'
'কন্ডাক্টর তোকে একটা রাম ধমক দিবে। কিন্তু আমাকে ধমক দিবে না। বরং আমার দিকে তাকিয়ে মধুর করে হেসে বলবে, ভাড়া লাগব না আফা--।'

তিন্নির কথা শোনে আমার খুব রাগ হত। করুণাও হত। করুণা হত কারণ আমি ওদের পরিবারের ভেতরের খবরটা জানতাম। তিন্নির বাবা ছিলেন সামান্য একজন সিকিউরিটি গার্ড। অল্পই বেতন পেতেন। কিন্তু মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে হঠাৎ একদিন একটা এক্সিডেন্ট হল। বাবা পঙ্গু হয়ে গেলেন। ছোট ছোট তিনটা ভাই বোনকে নিয়ে তিন্নি পড়ল অথৈ জলে। এই সময় সে পড়ালেখা বাদ দিয়ে পুরাদমে মিডিয়ায় নেমে গেল। বোকা একটা মেয়েকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেল ওরা। ফলাফল যা কাম্য তাই হয়েছে।

কিন্তু এইসব হচ্ছে বাইরের খবর। এই জন্যে তিন্নি সুইসাইড করে নি। সে সুইসাইড করেছে অন্য করণে।

মিডিয়া পাড়ায় দীর্ঘ দিন ঘুরাঘুরি করেও কিছুতেই সে ভালো রোল পাচ্ছিল না। উপরন্তু বিভিন্ন ক্লাবে, ঘরোয়া পার্টিতে ডাক পড়ত দাদাবাবুদের আমোদ গতিশীল করতে। তিন্নিকে যেতে হত। না গেলে টাকা আসবে কোথা থেকে? টাকা না পেলে খাবে কি? ভাই বোনদের পড়ালেখা চলবে কীভাবে?

ততদিনে তিন্নি স্টার হবার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে। কেবল একটা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে।

না, হচ্ছে না। তিন্নিকে নিয়ে গল্প লিখার ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয় নি। নিজের লিখা পড়ে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। অথচ কি বিচিত্র খেলায়ই না নিয়তি এই মেয়েটাকে নিয়ে খেলল!

তিন্নির ছোট বোন মায়া ইদানীং পড়ালেখা শেষ করে একটা ভালো জব করছে। সে তিন্নিকে খুব ঘৃণা করত। তিন্নিকে একদিন 'বাজারে কুত্তি' বলে গালি দিয়েছে। তিন্নি নিজেই এই কথা আমাকে বলেছে। বিপন্ন স্বরে জানতে চেয়েছে,"আমি কি আসলেই একটা বাজারে কুত্তী? তুই আমাকে সান্ত্বনা দিস না প্লিজ, সত্যটা বল!"

কিছুই বলতে পারি নাই আমি। সত্য কিংবা সান্ত্বনার চেয়েও বড় কিছুর আশা নিয়ে এসেছিল হয়ত মেয়েটা। কিন্তু-- এক জীবনে, এক মানুষের সকল আশা পূরণ হয় না।

তিন্নির ছোট ভাই আশিক কলেজে পড়ে। আশিকের বন্ধুরা ইন্টারনেট থেকে কিছু ক্লিপ্স নামায়। সেখানে একটা মেয়ে দেখতে নাকি হুবুহু তিন্নির মতো। আড়ালে আশিকের বন্ধুরা এই নিয়ে হাসাহাসি করে।

পরশুদিন তিন্নি এসেছিল শেষবারের মতো আমার সাথে দেখা করতে।

'চলে যাচ্ছি নিজাম, ভালো থাকিস। এই জীবনে আর হয়ত দেখা হবে না। যদি অন্য একটা জীবন থাকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, যেন সেই জীবনেও তোর মত একটা বন্ধু পাই।'

আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, 'কোথায় যাবি?'

তিন্নি কোন জবাব দেয় নি। কাতর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ।

আমি চাইলেই তিন্নিকে ফেরাতে পারতাম। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে পারতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে হয় নি। কেন ইচ্ছে হয় নি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা জীবন কেটে যাবে।

কিছু কিছু মানুষের জীবন বড় বেশি আনন্দময়। কিছু কিছু মানুষে জীবন বড় কষ্টের ও গ্লানিময়।

© মুহম্মদ নিজাম। বাংলাভূমি
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:৫১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×