দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরেক স্বাধীনতা দানের ওয়াদা করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান দল বৃটিশের মিসর ত্যাগের দাবীতে আন্দোলন শুরু কের। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে এ দলের সক্রিয় কর্মী সংখ্যা পঁচিশ লক্ষে পৌছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভুতিলীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশী। বৃটিশ ও স্বৈরাচারী মিসর সরকার ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পড়েন এবং এ দলের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ষড়ডন্ত্রে লিপ্ত হন।
ইংরেজী উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের জুলাই মাসে মিসরে সামরিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়।
উনিশ শ’ চুয়ান্ন সালে কর্নেল নাসেরের সরকার ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-“ইখওয়ানুল মুসলিমুন” পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। কারণ, ঐ বছর মিসর সরকার বৃটিশের সাথে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের উপর নির্যাতন শুরু করেন। একটি বানোয়াট হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলকে বেআইন ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাঁকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাঁকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করেন। তাঁর হাতে পায়ে শিকল পরানো হয়। শুধু তাই নয়, সাইয়েদ কুতুবকে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় জেল পর্যন্ত হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। পথে কয়েকবার বেহুঁস হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলতেনঃ ------------ (আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)।
জেলে ঢুকার সাথে সাথেই জেল কর্মচারীগণ তাঁকে মারপিট করতে শুরু করে এবং দু’ঘন্টা পর্যন্ত এ নির্যাতন চলতে থাকে। তারপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরকে তাঁর উপর লেলিয়ে দেয়া হয়। কুকুর তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়ায়। এ প্রাথমিক অভ্যর্থনা জানানোর পর একটানা সাত ঘন্টা ব্যাপী তাঁকে জেরা করা হয়। তাঁর স্বাস্থ্য এসব নির্যাতন সহ্য কর আর যোগ্য ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর সুদৃঢ় ঈমানের বলে পাষাণ থেকে উচ্চারিত হতে থাকেঃ-----------------(আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ )
জেলের অন্ধকার কুঠরী রাতে তালাবদ্ধ করা হতো। আর দিনের বেলা তাঁকে রীতিমত প্যারেড করনো হতো। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বক্ষপীড়া, হৃদপিণ্ডেরদুর্বলতা ও সর্বাঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। তবু তাঁর গায়ে আগুনের ছেঁকা দেয়া হতে থাকে। পুলিশের কুকুর তাঁর শরীরে নখ এ দাঁতের আঁচড় কাটে। তাঁর মাথায় খুব গরম পানি এবং পরক্ষণেই বেশী ঠাণ্ডা পানি ঢালা হতে থাকে। লাথি, কিল, ঘুষি, অশ্লীন ভাষায় গালাগালি ইত্যাদি তো ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার।
উনিশ শ’ পঞ্চান্ন সালের তেরই জুলাই, গণআদালতের বিচারে তাঁকে পনর বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। অসুস্থতার দরূণ তিনি আদালতে হাজির হতে পারেননি। তাঁর এক বছর কারাভোগের পর নাসের সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি সংবাদ পত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করলে তাঁকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্নান হয়ে থাকবে। তিনি বলেনঃ
“আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মযলুমকে যালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাযী নই। আমি আল্লাহ্র দরবারে এমন অবস্থায় হাযির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।”
পরবর্তীকালে তাঁকে যতবার ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি একই কথা বলেছেন: “যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো না।”
উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁরই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।
এক বছর যেতে না যেতেই (?)তাঁকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন। শুধু তিনি নন, তাঁর ভাই মুহাম্মাদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাযারেরও বেশী লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাত শ’ ছিলেন মহিলা।
উনিশ শ’পয়ষট্টি সালে কর্নেল নাসের মস্কো সফরে থাকাকালীন এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর এই ঘোষণার সাথে সাথেই সারা মিসরে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক ধরপকড় শুরু হয়। উনিশ শ’ চৌষট্টির ছাব্বিশে মার্চে জারীকৃত একটি নতুন আইনের বলে প্রেসিডেন্টকে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার,তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি দণ্ডবিধির অধিকার প্রদান করা হয়। তার জন্যে কোন আদালতে প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলেও ঘোষণা করা হয়। কিছুকাল পর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। প্রথমত ঘোষনা করা হয় যে, টেলিভিশনে ঐ বিচারানুষ্টানের দৃশ্য প্রচার করা হবে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ অপরাধ স্বীকার করতে অস্বীকার এবং তাদের প্রতি দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করায় টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর রুদ্ধদার কক্ষে বিচার চলতে থাকে। আসামীদের পক্ষে কোন উকিল ছিল না। অন্য দেশ থেকে আইনজীবীগণ আসামী পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করা হয়। ফরাসী বার এসোসিয়েনের ভূতপূর্ব সভাপতি উইলিয়াম থরপ (Thorp) ও মরোক্কোর দু’জন আইনজীবী আসামী পক্ষ সমর্থনের জন্য রীতিমত আবেদন করেন। কিন্তু তা না মঞ্জুর করা হয়। সুদানের দু’জন আইনজীবী কায়রো পৌছে তথাকার বার এসোসিয়েশনে নাম রেজিষ্ট্রী করে আদালতে হাযির হন। পুলিশ তাঁদের আদালত থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সাইয়েদ কুতুব ও অন্যান্য আসামীগণ উনিশ শ’ ছেষট্টি সালের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইবুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, অপরাধ স্বীকার করার জন্যে তাঁদের উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ট্রাইবুনালের সভাপতি আসামীদের কোন কথার প্রতিই কান দেননি।
ইংরেজী উনিশ শ’ ছেষট্টি সালের আগষ্ট মাসে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দু’জন সাথীকে সামরিক ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ডাদেশ শুনানো হয়। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কিন্তু পঁচিশে আগষ্ট, উনিশ শ’ ছেষট্টি সালে ঐ দন্ডদেশ কার্যকর করা হয়।