আমাদের এখন চারটা গরু আছে। দুইটা গাই, আর দুইটা বাছুর। আগে বলদ আর ষাঢ় গরুও থাকত, যখন আমাদের হালচাষ হত। গরু যেন আমাদের সংসারের অংশ। তাদের মশারি আছে, মশার কয়েল দেয়া হয়। নিয়মিত গোসল করানো হয়। শীতকালে আবার কাথার ব্যবস্থাও আছে। প্রত্যেক বছর নতুন বলদ গরু কেনা হত বয়সী অথবা দূর্বলটাকে বিক্রীর বিনিময়ে। বেশির ভাগ সময়েই কেনা হত কালাইয়ার হাট থেকে, আর মাঝে মাঝে হাজির হাট থেকেও।
যেদিন গরু কেনা হত, সেদিন বাড়ির সবাই নতুন গরুর আগমনের অপেক্ষায় থাকত। রং কেমন হবে, স্বাস্থ্য কেমন হবে এসব নিয়ে চলত কানাঘুষা। অনেক রাতে যখন গরু কিনে আনা হত, তখন লোকমান চাচা আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় থাকতেই জোরে টাক্কা (গরু চড়ানোর জন্য জিহবার সাহায্যে ট্ব-ট্ব শব্দ) দিতেন। শুনতে পেয়ে সবাই বাইরে বেরিয়ে আসতাম নতুন অতিথিকে বরণ করে নেয়ার জন্য। কোনো কোনোটা ঘরে ঢোকার আগেই ভিতরের শক্তিশালীটার সাথে লড়াই শুরু করে দিত। ষাঢ়গুলো হত আরও বেপরোয়া। মনে আছে একটা লাল রংয়ের ষাঢ় বেশ জেদি ছিল। কোরবানির মাঠে নিতে হবে। হাইস্কুলের সামনে বড়খাল পার হতে নেমেই মাটির সাথে লড়াই শুরু করে দিল। সেখান থেকে উঠাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পুরো পথ ওটাকে মানিয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল কঠিন কাজ। সেটি সেদিন সম্ভবত জুলহাস ভাইয়া করেছিল।
১৯৯৯ সালে আমাদের প্রিয় লোকমান চাচা মারা গেলেন। আল্লাহ্ যেন তাকে রহম করেন। তার চলে যাওয়া ছিল পুরোপুরি অনাকাংখিত। আমাদের সংসারের একটা বড় অংশ যেন খালি হয়ে গেল। হালচাষ বাধাগ্রস্ত হল। আব্বা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি তার প্রধান সেনাপতিকে হারিয়ে বেশিদূর এগোতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে হালচাষ বন্ধ করে দিলেন। সাথে সাথে গরুর সংখ্যাও কমে গেল। বলদ, ষাঢ় আর নেই। আব্বা গাই গরু রেখে দিলেন।
এক একটা গাই গরু বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের বাড়িতে থাকত। একবার একটা গাইয়ের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেল, আবার দুধ দেয়ার পরিমানও কমলো। সিদ্বান্ত নেয়া হলো বিক্রী করে দেয়ার। আব্বা খদ্দের পেয়ে বিক্রী করে দিলেন। সন্দেহ ছিলনা যে আব্বা মনবিরুদ্ধ কাজ করেছেন। হাটে নেওয়া লাগেনি, আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরেই ক্রেতাদের বাড়ি। তারা গরু নিতে আসলেন। সবার মন খারাপ। নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা বিদায় না বললেও গরুটি ঠিকই বুঝে নিলো। ওর চোখ দিয়ে পানি বেয়ে পড়তে লাগলো। আব্বা সাথে গিয়ে গরুটিকে দিয়ে আসলেন।
এসেই বারান্দায় বসে পরলেন। মাকে শুধু বললেন, গাইটাকে দিয়ে আসলাম। সবাই বিষন্ন। কি যেন নেই। মা আর দাদি আব্বাকে বললেন গরুটি ফেরত নিয়ে আসতে। আব্বা বললেন, যদি না দেয়? এখনতো ওটা ওদের গরু। দাদি বললেন, সব টাকা নিয়ে যা। আর আমার কথা বলবি। আব্বা মায়ের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে গরুটিকে আনতে গেলেন। লোকগুলো বড় ভাল, তারা আব্বার হাতে দড়ি ধরিয়ে দিলেন। আর গরুটি হাটল ওর চিরচেনা পথে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:১৫