somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওভারকোট

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ওভারকোট
লেখকঃসৈয়দ আহসান কবীর । পড়ে ভাল ললাগলোো তাাই শেয়ার করলাম।



ওভারকোট পরা লোকটি অনেকক্ষণ পিছু নিয়েছে। এত ঠাণ্ডা পড়েনি যে ওভারকোট পরতে হবে। তারপরও পরেছে। মাথায় ঝাকড়া চুল, মুখ গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা। ছিপছিপে গড়নের মাঝ বয়সী লোকটিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না কোনও মতলব আছে কি-না। নওরীন খুব চিন্তায় পড়ে।

ক্যাম্পাসে ফাহিমের সাথে শেয়ার করবে ভেবেছিল। কিন্তু ওর মেজাজ খুব চড়া। হুটহাট রেগে যায়। তাই শেয়ার করেনি। মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেই হয়। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না।

লোকটি কেমন যেন রহস্যময়। সাথে আর কেউ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল নওরীন। কোনও গং মেম্বার হলে মোবাইলে দু-একবার কথা বলতে দেখা যেত। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। শুধুই দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে লোকটি।

সকালে বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিল তখন লোকটিকে প্রথম দেখে নওরীন। ওভারকোট পরা লোকটি বাস স্টপেজের পাশের একটি টি-স্টল থেকে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে চা খাচ্ছিল। বাসে না ওঠা পর্যন্ত তাকিয়ে ছিল। আমলে নেয়নি সে। বাস থেকে নেমে সোজা কলেজ ক্যাফেটরিয়ায়, তারপর লাইব্রেরি ঘুরে ফাহিমকে সাথে নিয়ে সোজা ফটিকের টি-স্টলে। ক্যাম্পাসের এই একটি জায়গা ওর খুব ফেবারিট। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ তুলতেই লোকটিকে দেখতে পেল। আশ্চর্য হয়নি সে। এখানেও কাজ থাকতে পারে লোকটির। কিন্তু নীলক্ষেতে বই কেনার সময় আবারও দেখতে পেয়ে সন্দেহের জাল ছড়িয়ে পড়ল নওরীনের মনে। তারপর থেকে ফিরে ফিরে দেখছিল। লোকটি তার পেছনে আছেই। নওরীনের সন্দেহ লোকটির কাছে স্পষ্ট। কিন্তু কোনও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে না। সিগারেট টানতে টানতে ধীর গতিতে এগুচ্ছে।

কাজ সেরে ফাহিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল নওরীন। হঠাৎ লোকটিকে নিয়ে চিন্তা ঢুকল। কী চায় সে।

বেলা বারোটা। সূর্যের দেখা নেই। হালকা কুয়াশা, তেমন ঠাণ্ডাও নেই। লোকজন শীতের হালকা পোশাকে দিব্বি হেঁটে চলছে। কিন্তু লোকটি নির্বিকার। ওভারকোট নিয়ে তার কোনও মাথা ব্যথা নেই।

বাসের চিন্তা ছেড়ে রিক্সা নিল নওরিন। খানিকটা এগুনোর পর ফিরে দেখল ওভারকোট আসছে অন্য রিক্সায়। সমান তালে ধোঁয়া উড়ছে। ঠাণ্ডা ধিরস্থির চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত দার্শনিক গোছের মানুষ যেমন হয়।

৫ নম্বর রোডে এসে রিক্সা থামল। সামান্তার সাথে পরবর্তী এসায়েন্টমেন্টের আলোচনা আছে। শেষ বাসাটা ওদের। বাসার সামনে নামলেই পারত। কিন্তু আগেই রিক্সা ছেড়ে দিল। লোকটি হয়ত কিছু বলতে চাইছে। যদি সে রকম কিছু হয়, সুযোগ নিতে পারেন তিনি। দুর্ঘটনার কথাও ভেবেছে নওরিন। কিন্তু সৌম্য চেহারার এই লোকটি তেমন নয় মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে হাঁটছে নওরিন। নাহ! লোকটি এগুচ্ছে, কিন্তু যা ভেবেছিল তা ঘটল না।

আধঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নওরিন পত্রিকা অফিসের দিকে পা বাড়াল। বিকেলে ওখানে সাব এডিটিংয়ের কাজ করে। আজ আগেই অফিসে এলো। গেইট দিয়ে ঢোকার আগে আড় চোখে দেখে নিল সে। মোড়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে নির্বিকারে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে লোকটি।

এ সময়ে অফিসে সায়েম ছাড়া কেউ থাকে না। সায়েম ক্লাসে ফোরে পড়ে। পড়ার পাশাপাশি অফিসের ফায়ফরমায়েস খাটে। নওরীনই কাজটি জুটিয়ে দিয়েছিল।

চেয়ারে বসে বারবার লোকটির চেহারা ভেসে উঠছে। কী চায় লোকটি?

মায়ের একমাত্র মেয়ে নওরীন। অভাবের মাঝেও মধ্যবিত্তদের সন্তানের মত করেই মা তাকে বড় করে তুলেছে। বাবাকে দেখেনি কখনও। ছোট থেকেই বাবা কী জিনিস তা জানতে পারেনি। বাবা সম্বন্ধে মা কোনও উত্তর দেয় না। একদিন জিজ্ঞেস করায় মা কেঁদে ফেলেছিলেন। তারপর আর কখনও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি নওরীনের। কৈশোরে কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হলে মা বলেছিলেন, ‘তোমার বাবাও বেশ আবৃত্তি করতেন, লিখতেনও।’ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বলেছিলেন, ‘তখন বুঝিনি।’

কথাটার মানে সে সময় না বুঝলেও এখন বেশ অনুধাবন করতে পারে নওরীন। হয়ত মায়ের কারণেই তাদের মাঝে কোনও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি নওরীন। তবে বাবার প্রতি একটি চাপা ক্ষোভ কাজ করে তার, ‘যা-ই হোক না কেন আমি তো তার মেয়ে একটি বারের জন্য হলেও’...

নাহ! কাজে মন বসছে না। কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ইচ্ছা করছে না। চা খেলে হতো। সায়েমকে মোড়ের চায়ের দোকান থেকে আদা চা আনতে বলল নওরীন। অফিসের রং চা ভালো লাগে না।

ফিরে এলো সায়েম। হাতে একটা নীল খাম। বলল, ‘আফা একডা ব্যাডাই আফনেরে দিতে কইছে। আমার পকেটোর সিল দেইখ্যা জিগাইল এই আফিসে কাম করি কিনা। তারপরে কী জ্যান লেইখ্যা হাত্তে দিয়া কইল আফনেরে দিয়া দিতো’...

প্রায় ছোঁ মেরে খামটি নিল নওরীন। বেশ চমৎকার হাতের লেখা খামের ওপর জ্বলজ্বল করছে। প্রেরকের নাম নেই। শুধু লেখা, ‘কিছু বলার ছিল।’ খামটি খুলতেই সিগারেটের কাগজে লেখা, ‘নিকোটিনের থাবা থেকে টেনে নেওয়ার কেউ কাছে নেই আমার। তবে সিসার গ্যাস চেম্বারে রচিত হচ্ছে স্বপ্নছায়া। জানি তোমার সম্মানে সম্মানিত হবে জাতি। তোমার চলার পথে আকাশের তারা হতে আজ আমার কোনও বাধা নেই।’

শেষের ঠিক আগের কথাটি নওরীনের খুব পরিচিত। দ্বিতীয় জন্মদিনে স্থানীয় একটি পত্রিকায় তার বাবা তাকে উইশ করতে লিখেছিল। বারো বছর বয়সে কে যেন তাদের বাসায় কুরিয়ারে পুরাতন পত্রিকাটি পাঠিয়েছিলেন। মা পড়ে অনেক কেঁদেছিলেন।

মুহূর্তেই ছুটে যায় নওরীন। টি-স্টল ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। শেষ বিকেলের পথে মেঘ হয়ে ভেসে যাচ্ছে একটি রিক্সা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×