উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো মাটির বুকে দুঃসাহসিক প্রহরীর মতো যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ গুলো ,এই ঢেউ খেলানো মায়ের বুক চিরেই বেড়িয়ে গিয়েছে ছোট্ট এক নদী, নাম তার চিন্তাধারা ।
এই নদীর নাকি এক অলৌকিক গুন আছে, তাই হইতো মনের কষ্টে কংসাবতী চোখের জল ফেলছে এই নদীর ধারে অঝরে, মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে সেই তখন থেকে !
সাক্ষী শুধু চিন্তাধারা আর এই প্রহরী গাছ গুলো । দুপুর গড়িয়ে বিকালে, সূর্য্ পূর্ব থেকে গুটিগুটি পায়ে পাড়ি দিয়েছে পশ্চিমে ।
তখনও কান্না থামেনি কংসাবতীর, ঠিক তখনই হটাৎ চিন্তাধারা থেকে ধীরে ধীরে উটে এলো এক অকল্পনীয় বিস্ময়কর দেবী ।তার রূপের নূরে চারিদিকে এক মায়াবী নেশার মত মহ ছড়িয়েছে।
একবার তাকালে যেন আর কোনো উপায় নেই চোখ ফেরানোর , রূপের সম্ভার সে যে, চাক্ষুস রূপ দেবী । ময়ুরের উপর বসে কংসাবতীর সামনে এসে দাঁড়ালো সেই রূপের দেবী ।
- কংসাবতী ... কংসাবতী তোমার কষ্ট যে অসহ্যনীয়,
কংসাবতী একবার চাও আমার দিকে, আমি যে তোমার কষ্ট নিতে এসেছি, কংসাবতী দেবে না তোমার কষ্ট গুলো আমায় !
-আহঃ মাথা তুলেই আবার নামিয়ে নিল, রূপের এমন উজ্জল নুর এক পলকে সহ্য করতে না পেরে ।
এতো রূপ তোমার! এতো সুন্দর তুমি! আমি সহ্য করতে পারছি না তোমাকে ,কে তুমি ?
না না আমি কিছুই জানতে চাই না তুমি যাও ,তুমি যাও !
ঈশ্বর কেনো আমার সাথে এমন করলো , আমাকে যখন কুৎসিতই বানাবে তখন কেনো সবার মাঝে পাঠালো , আমাকে কেউ ভালোবাসে না , আমাকে কেউ পছন্দ করে না,আমার সাথে কেউ মিশতে আসেনা, সবাই আমার থেকে দুরে থাকে ,নিখিল সেও আজ অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।
কিন্তু ও যে আমাকে বলেছিল খুব ভালোবাসে, গায়ের রং কালো তাতে ওর কিছু যাই আসে না, তবে কেন আমার সব কিছু নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেল !
তুমি জানো কি?(কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে অঝোরে কেঁদে চলেছে তখনও কংসাবতী)
মা রোজ কাঁদে অনেক অনেক কাঁদে মাঝে মাঝে অভিমানে আমার দুচোখ যেদিকে চাই সেদিকে চলে যেতে বলে ! আমি আর সর্হ্য় করতে পারি না এই যন্ত্রনা ।
তুমি যাও ...
চলে যাও তুমি ।
তোমার রূপ কেন জানিনা আমার সহ্য হচ্ছে না।
- কংসাবতী তুমি কান্না থামাও । তোমার কান্না সহ্য করতে পারছি না বলেই যে উঠে এসেছি আমি , কান্না থামিয়ে একবার আমার দিকে মুখ তুলে চাও,দেখবে তোমার সব কষ্ট আমি নিয়ে নেব ।
- আমি যে আর ফিরতে চাই ওই সমাজে যেখানে শুধু কষ্ট আর কষ্ট,যেখানে প্রতিটাদিন ঘৃণায় ভরা মানসিক একাকিত্ব অসর্হ্য যন্ত্রনায় কাটে
আমি আর ফিরতে চাই না সেখানে,আচ্ছা তুমি কি আমাকে নিয়ে যাবে ? তুমি যেখানে থাকো সেখানে কি আমাকে নিয়ে যাবে, না না তোমার অনেক রূপ , তুমিও ওদের মতো , তুমিও আমার কষ্ট বুঝবে না ।(মুখ না তুলে বলতে থাকলো এমন করে কংসাবতী)
-আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যে আমার নেই,
তবে আমি তোমার কষ্ট গুলো নিতে পারি, যেটার জন্য এতো সমস্যা তোমার জীবনে সেটাকে আমার করে নিতে পারি,
তুমি কি চাও!
বলো কংসাবতী!
তুমি কি চাও!
সবাই তোমাকে ভালোবাসুক ?
সবাই তোমাকেই যেন চাই? বল তুমি কি চাও?
- (অবাক দৃষ্টি নিয়ে কংসাবতী রূপ দেবীর দিকে মুখ তুলে চাইলো )
সত্যি তুমি পারবে?
আমার জীবনে একটু সুখ দিতে?
সুখের স্পর্শ কেমন? রূপ থাকলে কেমন সুখ পাই মানুষ? তুমি পারবে এইসব দিতে আমাকে? আমি জানতে চাই সুখ কমন হয়?
- একবার বলেই দেখনা! আমি তোমার সব কষ্ট গুঁচিয়ে দিতে পারি , তোমার মুখে হাসি ফোঁটাতে পারি , তোমার গায়ের কালো কষ্ট গুলোকে এক নিমিষে আমার করে নিতে পারি , শুধু তুমি একবার বলেই দেখনা ।
- হ্যাঁ হ্যাঁ.....(চিৎকার করে কংসাবতী বলে উটলো )
হ্যাঁ আমি চাই মরার আগে জীবনে একবার সুখের স্পর্শ পেতে !
হ্যাঁ আমি চাই , আমি চাই !
- তবে তাই হবে,তুমি যা চাও তুমি তাইই পাবে !
কংসাবতী আমার প্রিয় কংসাবতী তুমি তোমার চোখ দুটো বন্ধ করো !
আর শুধু একটা কথা মনে রেখো কখনো তুমি তোমার অতীত কে ভুলে যেও না !
কথা শুনে চোখের জল মুছতে মুছতে কংসাবতী চোখ বন্ধ করলো তারপর রূপ দেবী কংসাবতীর মাথায় হাত রাখলো ধীরে ধীরে !
কংসাবতী মাঠিতে লুঠিয়ে পড়ল ।
মৃত দেহের মতো যেন তার শরীরে আর কোনো শক্তি নেই,দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল কংসাবতী ।
[পরের দিন সকালে ]
এক মিষ্টি সুবাসে মুখরিত চারিপাশ, কত রংবিরঙের পাখি চারিপাশে ভিড় করেছে, তাদের কিচিমিচিতেই ঘুম ভাঙ্গে কংসাবতীর..
-এইসব কি হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না কংসাবতী । চারিদিকে যেন কেউ এক মায়াবী আলো ছড়িয়ে রেখেছে । সে কিছুতেই বুঝতে পারছে !
এতো পাখি কেন ভিড় করেছে তার চারিপাশে, কেন প্রজাপতি তার গায়ে উপর এসে বসছে । আগের দিনের কথা মনে পড়তেই কংসাবতী আবার গুমড়ে কেঁদে উটলো ।
তুমি কোথায় ,,কোথায় তুমি ...... বলেছিলে যে আমার কষ্ট গুলোকে তুমি নিয়ে যাবে, আমাকে সুখ দেবে. কোথায় গেলে তুমি ..
তুমি কোথায় গেলে ? চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কংসাবতী আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।
না , তার কষ্ট কেউই বুঝবে না ।
তার কষ্ট গুলো একান্ত শুধু তারই তাই সবাই পাশে থাকার কথা বলে পরিশেষে কেউ থাকে না । এই পৃথিবীতে তার কাছে এখন সবাই নিষ্টুর ।
কান্না করতে করতে সটান উটে দাঁড়ালো সে , সে বুঝতে পেরেছে এই স্বার্থপর মানুষের মাঝে যতদিন সে থাকবে ততদিন সে কোনদিন এ শান্তি পাবে না ,কোনদিনই সে সুখ পাবে না ।
তাই সে ঠিক করলো আজ এই সবার মাঝ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলবে ।
চিৎকার করে হাউমাউ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলল নদীর দিক....
তার কান্নার আওয়াজে চারিপাশ মুচ্ছিত আজ তার কষ্টে দুমড়ে মুচকে যাচ্ছে তার চারিপাশ ।
এই প্রকৃত ও যেন আজ তার কষ্ট আর কান্না সহ্য করতে পারছে না ।
সাথে সাথে পাখি গুলো প্রজাপতি গুলো ও উন্মাদের মত তার পিছু পিছু ছুটছে ।
কংসাবতীর কান্নার সাথে সাথে পাখি গুলোর আওয়াজ ও যেন আগের থেকে অনেক গুন বেড়ে গেছে, তারা যেন বিচলিত আজ, তারাও যেন অসহ্য যন্ত্রনা চাপা রেখে আছে বুকের মাঝে এতোদিন ।
কংসাবতী মরলে তারাও যেন মরবে আজ , এ যেন এক দেহে অনেক গুলো প্রানের সমারহ !
উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো মাটির মুখে দিশেহারার মতো ছুঁটে চলেছে কংসাবতী চিন্তাধারার দিকে । বার বার মাটিতে আছড়ে আছড়ে পড়ে আবার চোখের জল মুছতে মুছতে উটে ছুঁটে চলে উন্মাদ পাগলের মতো চিন্তাধার দিকে ।
ছুটতে ছুটতে হটাৎ এক পাথরে পা বেঁধে সপাটে কংসাবতী পড়লো চিন্তাধারার তীরে ...
পাথরে বারি খেয়ে তার কপাল থেকে হালকা রক্ত ঝরছে । তার পড়ার সাথে সাথেই হুমড়ি খেয়ে সব পাখি প্রজাপ্রতি গুলোও পড়লো তার দেহের উপর ।
চারিপাশ আজ যেন শুধুই কষ্ট আর কষ্ট, এই গাছ এই আকাশ এই মাটি যেন কেউ ভালো নেই আজ , সবার যেন আজ কংসাবতী মৃতুর সাথে সাথেই মৃতু হবে তাদেরও ।
চারিপাশের এই মায়াবী কষ্ট অসহ্য যন্ত্রনা বেদনা পাখি গুলোর চিৎকার আর তার সাথে কংসাবতীর কান্নার আওয়াজ মিলেমিশে যেন এক যন্ত্রনাময় রূপকথার গল্প বলছে .....
....................................................................................................তারপর ..........................
ছবি : দেবী আফ্রোদিতি
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:১৪