কাপড় গুলো বারান্দায় ছড়িয়ে ঘরে আসতেই জয়িতার ফোন
বেজে উঠল। রিসিভ করা মাত্র শুনতে পেল তূর্যর কণ্ঠ,
"তুমি আর নেই সে তুমি..." শচীনদেব বর্মণের বিখ্যাত গান। চুপ করে শুনলো খানিকক্ষণ। গান থামিয়ে তূর্য বলে উঠল, "শেষটার সুর গলায় উঠছে না, বুঝছো? গুনগুন গুনগুন করো না অসময়... উঁহু, হলো না।
তুমি গাও তো।"
"ধুর, আমি গাইতে পারি নাকি? ঐটা আমার দ্বারা হবেনা।"
জয়িতা বলে।
তূর্যের কণ্ঠে গান গুলো এত অপূর্ব শোনায় যে সে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে। এত সুন্দর গায় কী করে? মনে পড়ে দুজনের
প্রেমের আগে একদিন জয়িতা বাড়ি ফিরছিল। তূর্য ওকে অবাক করে দিয়ে গেয়ে উঠেছিল "পাখি রে তুই দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না।" কেন জানি প্রতিটা রক্তবিন্দুতে গানটা ছড়িয়ে গিয়েছিল ঐদিন জয়িতার। তূর্য বলতে থাকে,
:"একটা গিটার থাকলে বেশ হতো, জানো? টুংটাং করা যেত।"
-"তুমি বাজাতে পারো নাকি?"
:"পারিনা, শিখে নিলাম! সাব্বির
ভাই একটা কিনেছে জানো, অনেক সুন্দর! দাম শুনে মুখ দিয়ে একা একাই বেরিয়ে গেছে, হোয়াট দ্যা ফাজ, ইউ সান অফ আ বিস্কুট"
- এটা কী হল?
: দেখ আমি কিন্তু খারাপ কথা বলিনি,
তুমি তো মানা করো। তাই বলে পনের হাজার দিয়ে একটা গিটার
কেনে কেউ? আমার তিন মাসের খরচ।
- এত্ত দাম?
: হুম, আরো কমেও পাওয়া যায়, আমি ভাবছি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কিনে ফেলব।
জয়িতা মনে মনে ভাবে তূর্যর হাতে একটা গিটার থাকলে কেমন
লাগবে? কালো একটা একুইস্টিক, চিকন রূপার সুতোর মতো তার গুলোতে ওর লম্বা নখ গুলো খেলবে, যেন সুরকেই
সম্মোহন করবে। জয়িতা বলে,
-"তার চেয়ে বাড়ি থেকে ফেরার পথে একতারা নিয়ে এসো, দামে কম পড়বে, ওতেও সুর তোলা যায়।"
:"এই জন্য তুমি গাইলে মনে হয় পেত্নীর গান" অভিমান তূর্যের গলায়।
হেসে ফেলে জয়িতা,
-"আচ্ছা বাবা, এরপরে কিনে ফেল।"
সেইদিনই টিউশনিতে যাবার পথে সাইন্স ল্যাবের দোকান
গুলোতে উঁকি দেয় জয়িতা। একটু খোঁজ নেয়া দরকার। একটা পুরনো গিটার বাজাবে তূর্য এটা মানতে পারেনা।
দোকানদার মহাউত্সাহে এমন নারী ক্রেতা পেয়ে তার পণ্যের
গুনগান শুরু করলো। গিবসন ভালো আপু, দেখেন আপনি! সিগনেচারও নিতে পারেন। সাড়ে পাঁচের মতো পড়বে। গিটারটা জয়িতার নজর এড়ায় না। কালো, তার গুলো ঝকঝকে রূপালি, স্বীয় সৌন্দর্যে যেন অহংকারি হয়ে আছে।এটাই কিনবে, ঠিক করে ফেলে। তূর্যর জন্মদিন আসতে আর ছয়মাস বাকি, কোনভাবে যদি এক হাজার করে জমানো যায়, তাহলেই হবে। মনের
ভিতরে ছোট ভাইটার আবদার গুলোও ভাসতে থাকে, "আপু, এংরি বার্ডের পেনসিল, ডোরেমনের বক্স, কমিকস, পরে মনে হলে বাকি গুলো বলবো!"
একটু সাশ্রয়ী হলেই সম্ভব। রিকশায় না চড়ে একটু হাঁটলাম, টিউশনিতে বাসে গেলাম, সপ্তাহে দুটো দিন না হয় একটু
ভাজি ভর্তাই খেলাম! আপনমনে ভাবতে থাকে।
হলে ফিরে পুরনো শ্যাম্পুর বোতলটারউপরে সূক্ষ্মভাবে কেটে ফেলে জয়িতা,যাতে শুধু টাকা ঢোকানো যায়, বের করা যায় না। মাসের শুরুর এক হাজার টাকা আর সাথে কিছু দশ বিশ টাকার
নোট ঢুকিয়ে দেয় ভিতরে। মনে মনে ভাবে তূর্য যখন গিটার
নিয়ে গাইবে, ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেবে জয়িতা।
চশমা ছাড়া সে খুব একটা ভালো দেখতে পায়না। জয়িতা চায়না ওর চোখের মুগ্ধতা টুকু তূর্য দেখে ফেলুক।
মাস তিনেক হলো। শ্যাম্পুর জারটায় তিন হাজার চারশ টাকা জমেছে।মনে মনে পুলক অনুভব করে জয়িতা, বেশ সঞ্চয়ী হয়েছে সে। আর দুটো মাস ঠিক মতো গেলেই কিনে ফেলতে পারবে গিটার টা। মাঝে মাঝেই দেখে শৈলীর মা টিউশনির টাকা দিতে দশ তারিখ করে ফেলে। এবার তা হতে দেয়া যাবে না। সংকোচের মাথা খেয়ে বলেই ফেলল, "শৈলী, তোমার মা কে একটু বলবে এ মাসে একটু প্রথম সপ্তাহে টাকা টা দিতে?"
"কেন মিস? টাকা সব শেষ করে ফেলেছেন?"
আচমকা প্রশ্ন করে বসে ছাত্রী শৈলী। এত্ত বড় হয়েছে কথা বলার ন্যূনতম ভদ্রতাটুকু শেখেনি। রাগটা আয়ত্তে নিয়ে আসে জয়িতা।
পরে অবশ্য মাসের শুরুতেই টাকা দিয়ে দিয়েছিল।
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর চলে এলো। দশ তারিখে তূর্যর জন্মদিন।টাকাটা গুছিয়ে ফেলেছে জয়িতা ঠিকমত। আজই কিনে রাখবে গিটারটা। ক্লাস থেকে হলে ফিরতে ফিরতে দুপুর
গড়িয়ে গেল। রুমে ঢুকে থমথমে পরিবেশটা বুঝতে একটু
সময় লাগে ওর। সিনিয়র রুমমেট ডাকে,
"জয়িতা দেখ তো তোর সব ঠিকঠাক আছে কিনা, আমার লাল
জামদানিটা নেই।" ঘটনা পুরোই দুর্ঘটনা। ফার্স্ট ইয়ারের নতুন রুমমেট সুমি দরজায় তালা না দিয়ে চলে গিয়েছিল। ভর
দুপুরের নির্জনতায় দক্ষ হাতে কেউ ওদের দেয়াল আলমারির
তালা ভেঙে নৈরাজ্য করে গেছে। জয়িতা দেখে ওর শখের
শাড়ি গুলো ঠিকমতোই আছে। শুধু নেই শ্যাম্পুর পুরনো বোতলটা। যেটা ঝাঁকালে কাগজের শব্দ হতো, লাল কাগজের একের পিছনে তিনটা শূন্য ভাঁজে লুকিয়ে থাকতো, স্ট্রং হেয়ার
লেস ফল লিখা বোতলটা যেন পুরো ধসে পড়ার অট্টহাস্যে উপহাস করে গেল।
সুমিকে গায়ের জোরে থাপ্পড় লাগানোর ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে সংবরণ করে বাইরে গেল ও। একটু শান্ত হওয়া দরকার।
আজ দশ তারিখ। হাতের অবস্থা ভয়াবহ। হাঁটতে হাঁটতে জয়িতা কাঁটাবন গেল। পছন্দ করে একটা কাঁচেরজারে দুটো রঙিন মাছ কিনল, যাওয়ার রিকশা ভাড়া সহ খরচ দুশো ত্রিশ টাকা। তূর্যর প্রিয় রং সবুজ। সবুজ শাড়িটাই ঠিক করল আজ। আসন্ন সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মুখটা নিয়ে বের হলো তূর্যর সাথে দেখা করতে।
রঙিন মাছ দুটো দেখে তূর্যর কি শিশুসুলভ আনন্দ। বারবার ঘুরে ফিরে দেখছে।
"আমার কাছে ঠিকমতো থাকবে তো? জয়ী ওদের নাম দিয়ে দাওনা?"
জয়িতা ওর হাসিটা দেখে ভাবে এত সুন্দর মানুষটার হাসি! আচমকা পাশ থেকে তূর্য এক হাতে জয়িতা কে আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতে দুটো রঙিন মাছ। হাসিমুখে গেয়ে ওঠে, "কোন
দিকে যাই, কোন পথে হারাই? রক্তপ্রবাহে স্লোগান উঠেছে তোমাকে তোমাকে চাই!"
জয়িতা তূর্যর চশমাটা খুলে নেয়, ও চায়না হঠাৎ চোখের পানি টুকু সে দেখে ফেলুক।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




