somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পহেলা বৈশাখ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৮:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কালচার ওয়ার বা সংস্কৃতির যুদ্ধ বাংলা মুলুকে পুরোদমেই শুরু হয়েছে। এটা বরং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন/সাম্রাজ্যবাদ, কালচার ওয়ার থেকেও বিপদজনক। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামের অযৌক্তিক এবং চরম কুসংস্কারে পরিপূর্ণ পৌত্তলিক ভাবাচার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন/সাম্রাজ্যবাদ বৈ কিছুই না। সাংস্কৃতিক এই বেনিয়া গোষ্ঠী ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদিদের জাতভাই, জেনে হোক, বা না জেনে হোক।

অত্যন্ত বিতিকিচ্ছিরি মুখোশ আর মূর্তির সাথে পৌত্তলিকতার নানা উপসংগকে রকমারি রঙ মাখিয়ে নববর্ষের উৎসবের মধ্যে এসব কুসংস্কারকে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সবাইরে বলতেছে "এই নাও, এই তোমার বাঙালিত্ব, বাঙালি হতে হলে এই পৌত্তলিকতারে মানতে হবে, নাহয় তুমি পুরাপুরি বাঙালি হতে পারবানা"। আদতে মূর্তিকে নিয়ে শোভাযাত্রা করা, মূ্তির মধ্যে শুভ আর অশুভের দ্বৈততা খুঁজে পাওয়া আর পুরোদমে মূর্তিপূজা করার মধ্যে বড় পার্থক্য নাই, যা আছে তা প্রায়োগিক পার্থক্য, ভাবগত পার্থক্য না।

অথচ এরকম জোরাজোরি করে পৌত্তলিকতা আনয়ন এবং সবার উপর চাপিয়ে দেওয়া বাঙালিত্বের চিহ্নকে দূষিত করে। তবে পৌত্তলিকতা আনয়নের এই সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু নতুন না। সংস্কৃতির সাথে নানারকম মূর্তি নিয়ে আদিেখ্যেতার কি সম্পর্ক আছে বুঝা কিছুটা কঠিন হলেও এ বুঝার জন্য আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা মুসলমানদের কিন্তু বাঙালি মনে করে না, শুধু হিন্দুদের বাঙালি মনে করে। বাঙালি হতে হলে আপনাকে হিন্দু হতে হবে, সেই তাদের বয়ান। আর এ বয়ান শুধু সাধারন লোকের মাঝে চালু সেটা না, এ বয়ান শিক্ষিত মানুষের মাঝে প্রচলিত, ভালমতে প্রাতিষ্ঠানিকিকরন হয়েছে এর। আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গের ম্যাগাজিন বা পত্রিকাগুলো দেখেন, সেখানে দুর্গাপূজাকে "বাঙালির" "সার্বজনীন" অনুষ্ঠান বলে চালানো হয়, দূর্গামা সকল বাঙালির সার্বজনীন মা। মানে হিন্দু না হলে আপনি বাঙালি হবেনই না।

বাংলাদেশে সংস্কৃতির বরকন্দাজ যারা আছে, তারা মূলত পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পৌত্তলিকতাকেই বাঙালিত্ব মনে করে। এজন্যই বাংলা নববর্ষে তারা পৌত্তলিকতাকে পুরোদমে প্রবেশ করাতে চায়। দেশের নব্বুই শতাংশের কাছাকাছি লোকের বিশ্বাসকে পায়ে ঠেলে যদি পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের সংজ্ঞানুসারে আমাদের সবাইকে বাঙালি হতে হয়, এবং সে বাঙালিত্বের জন্য কুসংস্কার আর পৌত্তলিকতার চর্চা বাধ্যতামূলক হয়, তবে সেটা শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বৈ কিছুই না। এবং এ আগ্রাসন পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতই, পশ্চিম পাকিস্তানের জায়গায় পশ্চিম বাংলার পৌত্তলিক আগ্রাসন।

পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ এবং বড় আকারের জাতিগত নিধনের ইতিহাস যদি পড়েন, সেখানে দেখবেন এসবের প্রথম পর্যায় হল পরিচয়কে অবৈধকরন/ডিলেজিটিমাইজ করা, পরের পর্যায় ডিহিউম্যানাইজেশান (বিমানবিকিকরন), এবং শেষ পর্যায় হল নিধন। পৌত্তলিকতার চিহ্নকে বাঙালিত্ব যাচাইয়ের কষ্টিপাথর বানানো হল মুসলমান বাঙালিদের বাঙালিত্বকে ডিলেজিটিমাইজেশানের প্রক্রিয়া, তাই এ পর্যায় যাতে এর পরের স্টেপে না যেতে পারে সেজন্য সবাইকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে এখনই প্রতিহত করতে হবে। উল্লেখ্য এই প্রতিহত করার রূপ অহিংস হতে হবে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে শুধুমাত্র অহিংস কাউন্টার কালচারের ন্যারেটিভ খাড়া করেই প্রতিহত করা যায়।

কিন্তু কিভাবে প্রতিহত করবেন এই সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসনকে? বাংলা নববর্ষকে পরিত্যাগ করে? না, সেটা হবে চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মত। আমরা বাঙালি এবং মুসলমান বাঙালি, এবং হিন্দু বাঙালির মত সমানভাবে বাঙালি, কমও না, বেশিও না। বাংলাদেশে যারা হিন্দু বাঙালি আছে, তারাও সমানভাবে বাঙালি। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় চিহ্নকে আমরা সম্মান করি, এবং তারা চাইলে বাংলা নববর্ষে সেসব চিহ্ন ব্যবহারও করতে পারে, আমাদের আপত্তি নাই। তবে সেটা সার্বজনীন হবে না, সেটা শুধুমাত্র তাদের ধর্মের আচার হবে। তেমনি মুসলমানরা যদি চায় তারাও নিজেদের মত করে বাংলা নববর্ষে নিজেদের ধর্মীয় চিহ্ন আনতে পারে, সেটাও সার্বজনীন হবে না।

যেটাকে আমরা সার্বজনীন বলব সেটা ধর্মীয় চিহ্নবিহীন হতে হবে, তাই সার্বজনীন নববর্ষের উৎসবকে পৌত্তলিকতা মুক্ত করাই এখন আমাদের কাজ। আমরা সার্বজনীন বাংলা নববর্ষের সমান ওনারশিপ/মালিকানা নিব এবং সেটা সম্পূর্ণভাবে মুসলমান থেকেই। এ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাড়ানোর প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল এটাকে সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসন হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া, এবং সে আলোকেই এ আগ্রাসনকে দেখা। অনেকে এটাকে ইসলাম বনাম তথাকথিত আত্মস্বীকৃত "মুক্তমনা" ডাইকটমিতে দেখতে চায়, সেটা এই বিতর্কের একটা দিক হলেও তার চেয়েও বড় দিক হল এটা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসন, সে ন্যারেটিভের আলোকে এটাকে দেখাটাই জরুরী। এই ন্যারেটিভের আলোকে দেখার মধ্যে এই সাম্রাজ্যবাদের সমাধান লুকিয়ে আছে। সোস্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ/আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়া আমাদের নিজেদের বাঙালিত্বের উপর পূর্ণাংগ দাবি প্রতিষ্ঠা করার দ্বিতীয় পদক্ষেপ।

পরবর্তী পদক্ষেপ হল নববর্ষের সার্বজনীন চিহ্ণ আনয়নের জন্য বাংলা নববর্ষের "সার্বজনীন" উৎসব থেকে পৌত্তলিকতাকে বিদায় জানাতে হবে। আমাদেরকে বাঙালিত্বের উপর আমাদের হক দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এবং আমরা বাঙালি হব আমাদের নিজস্ব পন্থায়, সেটা সংস্কৃতির বরকন্দাজরা ঠিক করে দেবেনা। আমরা নিজেরা বাঙালিত্বের বিকল্প ন্যারেটিভ খাড়া করব, সেটাতে পৌত্তলিকত্বের নামগন্ধ থাকবেনা। সেটা তখনই হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থে সার্বজনীন। ঢাকায় চারুকলায় যে শোভাযাত্রা বের হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা এ পদক্ষেপের অংশ, কেননা এটা সাম্রাজ্যবাদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সবচয়ে বড় চিহ্ন। এ চিহ্নের প্রবক্তারা বলে বেড়ান তাদের শোভাযাত্রার মত পৌত্তলিকতা আর মূর্তি নিয়ে আদিখ্যেতা নাকি সার্বজনীন বাঙালিত্ব। এ ভুল এবং সাম্রাজ্যবাদি বয়ানকে প্রতি পদে প্রশ্ন করতে হবে। শোভাযাত্রার কমিটিতে কারা আছে তাদের সাথে কথা বলা, তাদেরকে প্রশ্ন করা কেন তারা পৌত্তলিকতারে সার্বজনীন বলে সাম্রাজ্যবাদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে জায়েজ করছে। তারা যদি না শুধরায়, তাহলে যারা এই শোভাযাত্রার ফান্ড করে তাদেরকে বয়কট করা। শোভাযাত্রার ফান্ডিংয়ে কারা আছে সেটা খুঁজে বের করুন, কোন কোম্পানি থাকলে তাদেরকে জানান যে যদি এর ফান্ডিং বন্ধ না করে তাহলে আমরা তাদের পণ্য বয়কট করব। পেটে লাথি পড়লে কুত্তার লেজও সোজা হয়ে যায়, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদি এবং তাদের ক্রীড়নকরাও হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৮:০৮
১৫টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×