somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাঁদহীন আকাশের টানে

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কমল বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । কিছুটা দূরের বাড়িটার বারান্দার রেলিং-এ তিনটা কাক বসে আছে । একটা ছোট বাচ্চা এসে হাত নাড়তেই কাক তিনটা উড়ে গিয়ে বসলো রাস্তার উপরে ঝুলানো একটা তারে । কাক তিনটা ঐ তারে বসার প্রায় সাথে সাথেই দুইটা কাক উড়ে গেল । আর কমল অবাক হয়ে দেখতে লাগলো তৃতীয় কাকটাকে । কাকটা কিছুক্ষণ কেঁপে তার থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে । কমল লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেল । কমল দেখল কাক আর তিনটি নেই । আরও অনেকগুলো কাক ঐ কাকটাকে ঘিরে উড়ছে আর "কা কা" ডাকছে । সেই "কা কা" ডাকে মুহূর্তের মধ্যেই চারদিক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে । আর ঐ উত্তেজনা যেন কমলকেও পেয়ে বসেছে । প্রতিটি "কা কা" ডাক বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কমলের মাথায় । হঠাত মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল ওর , তীক্ষ্ণ ব্যথা । যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে । আর তাকিয়ে থাকতে না পেরে জানালার কাছেই চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো কমল । তারপর নিজের অজান্তেই মেঝেতে শুয়ে পড়লো । জ্ঞান হারাল কমল ।
যখন জ্ঞান ফিরল , কমল তখন বিছানায় শুয়ে আছে । ওর ডানদিকে বিছানা ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে ওর আম্মু আর ডাক্তার আঙ্কেল । ডাক্তার আঙ্কেল কমলকে বললেন ,
- তোমার কি এখনও মাথা ব্যাথা আছে কমল?
কমল মাথা নেড়ে বলল ,
- না আঙ্কেল । কিন্তু আমার কি হয়েছে ?
- আসলে তেমনকিছুই হয়নি তোমার । মাথা ব্যাথা তো একটা সাধারণ রোগ বাবা । কয়েকদিন রেস্টে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে ।
কমল কিছুই বলল না । ও ডাক্তার আঙ্কেলের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল । ডাক্তার আঙ্কেল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,
- আমি এখন যাই বাবা । তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে । ঠিক আছে ?
কমল হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল । ডাক্তার আঙ্কেল মুচকি হেসে চলে গেলেন ।
আজ সতেরো দিন হল এই ঘরের বাইরে পা পড়েনি কমলের । প্রতিটি দিন-রাত কাটে বিছানায় শুয়ে আর বিছানা থেকে দু-কদম দূরত্বে জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে । মাঝে মাঝে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বই পড়ে ও । এভাবে ভালই সময় কেটে যায় । তবুও চৌদ্দ বছর মুক্ত জীবনের স্পর্শে থাকা একটা কিশোরের জন্য সারাদিন একটা ঘরে আবদ্ধ থাকা মোটেই সহজ নয় । আজ ওর মনে হয় , ঝড়-তুফানে বায়ুস্রোতে গাছগুলোর গা ভাসিয়ে দেয়াটা যেন উদ্ভিদকুলের মুক্ত সচল জীবন লাভের জন্য এক বিন্দু প্রয়াস । গাছের মত কমলও যেন ওর বিছানার সঙ্গে এক অদৃশ্য শেকড় সম্পর্কে আটকে আছে । কোনোভাবেই ছিন্ন করা যাচ্ছেনা এই সম্পর্কটা ।
কমল বুঝতে পারে , আর বেশীদিন ও থাকবেনা এই ঘরে । কিছুদিন পরই ওকে সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখে আসা হবে এক অন্ধকার ঘরে । যদিও কেও ওকে এই সম্পর্কে কিছু বলেনি এ সম্পর্কে , তবু বুঝতে পারে ও । মা যখন রান্নাঘরে ক্রন্দন পর্ব শেষ করে চোখমুখ মুছে , খাবার নিয়ে কমলের ঘরে আসে , মায়ের চোখের কোনের এক বিন্দু অশ্রু ওর চোখের আড়াল হয়না । কমল তখন নিজ হাতে ওর পাশে বসা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ,
- কাঁদছ কেন মা ? দেখো , সব ঠিক হয়ে যাবে ।
মা কিছু বলেনা । ছেলের মুখের আশার বাণীতে নিজেকে মনে মনে শক্ত করার চেষ্টা করে মা । কিন্তু যখন ছেলের কোমল , মায়াবী শ্যামা বর্ণের চেহারার দিকে চোখ যায় , মা তখন নিজের মনকে থামিয়ে রাখতে পারলেও , নিজের চোখকে আর থামাতে পারেনা । ঝরতে থাকে অবিরাম জলধারা । ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মা তখন শব্দ করে কাঁদতে থাকে । আর এই কান্না-ই কমলকে জানিয়ে দেয়- কিছুই আর ঠিক হবেনা । সময়ের সাথে ঘনিয়ে আসছে এক রাত্রি । বিশাল সে রাত্রি । অসীম শূন্যতায় , অসীম অন্ধকারাচ্ছন্ন সে রাত্রি । যে রাত্রির শুধু শুরু আছে , শেষ নেই ।
রাত তিনটায় হঠাত ঘুম ভেঙে গেল কমলের । নিচু ভলিউমে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে পাশের বাড়ির শ্যামা আন্টিদের বাসা থেকে ।
" কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে-
আমরা পেয়েছি ভাই মানব জনম।
এ জনম চলে গেলে-
আর পাবো না না না,
আর মিলবে না।
তাই হৃদমাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেবনা। "
গানের কথাগুলো ভালো অনুভূতির সৃষ্টি করে । কমল বিছানা থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । আকাশে হলদে চাঁদ দেখা যাচ্ছে । ওর মনে পড়ে গেল রেশমির কথা । রেশমি বলেছিল ,
- শোন কমল , চাঁদহীন আকাশ কপালে টিপবিহীন রূপবতী নারীর মতই সুন্দর , আমার আপু বলেছে ।
- হ্যা । ঠিক এখন টিপ ছাড়া তোকে যেমন লাগছে তেমন ।
রেশমি অনেক হেসেছিল কমলের এই কথাটা শুনে । রেশমি এখন দিনাজপুরে । আর এক বছর আগের কথা ,রেশমির বাবার বাস দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর ওরা কলোনি ছেড়ে চলে যায় গ্রামের বাড়ি । কমল কখনোই ভাবতে পারেনি রেশমি এতোটা দূরে চলে যাবে । চলে যাবার আগের দিন রেশমি এসেছিলো কমলের কাছে । এসে চুপচাপ কমলের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল । কমল সেদিন কিছুই বলতে পারেনি রেশমিকে । শুধু তাকিয়ে ছিল ওর দিকে । রেশমি কখন কেঁদে ফেলে , এই ভেবেই কমল কিছু বলেনি সেদিন রেশমিকে । কিন্তু কোন কাজ হয়নি । কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই কমলকে অপ্রস্তুত করে রেশমি শব্দ করে কান্না শুরু করে । তারপর কমলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে প্রায় দৌড়িয়ে রেশমি চলে গিয়েছিল সেদিন । এটাই ছিল রেশমির সাথে কমলের শেষ দেখা ।
ভাবতে ভাবতে কমলের মনোযোগ আবার গানের দিকে গেল । এখনও রবীন্দ্রসংগীত বাজছে , তবে আগেরটা না , অন্য আরেকটা । "ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো,তোমার মনেরও মন্দিরে ।" এটা কমলের প্রিয় গান । এই গানটা ওর বাবারও প্রিয় ছিল , কমল ওর মায়ের কাছ থেকে শুনেছে । বাবাকে দেখেনি কমল । ওর জন্মের আগেই ওর বাবা মারা যায় । বাবা ছিলেন নৌবাহিনী কর্মকর্তা । নৌবাহিনীর সাদা পোশাকে ওর বাবার একটা ছবি ঝুলানো আছে ড্রইং রুমে । কমলের মনে হয় , ওর মায়ের মত দুখিনী আর কেও নেই । ও জানেনা কি হয়ছে ওর । তবে এটা জানে ওর জীবনস্রোত অত্যন্ত দ্রুত মৃত্যু অভিমুখে প্রবাহিত হচ্ছে । কমল ওর মায়ের শেষ সম্পদ । কমল না থাকলে কি নিয়ে বাঁচবে মা !
কমল বিছানায় শুয়ে পড়ে । ওর আর ভাবতে ভালো লাগছে না । মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে আবার । বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কমল । চাঁদটা এখন আর দেখা যাচ্ছেনা । হঠাত ওর সামনে পুরো আকাশ জুড়ে রেশমির চেহারা ভেসে উঠল । কমল অবাক হল । চাঁদবিহীন আকাশ আজ সত্যিই তাহলে টিপবিহীন রেশমির রুপ নিল ! কমল অস্থির হয়ে পড়লো । ওর মাথা ব্যাথা বাড়ছে । ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে ব্যাথা । কমলের মনে হল , ও আজই মারা যাবে । কমল ওর মা-কে ডাকতে চাইল । কিন্তু ডাকতে পারছেনা । কোন শব্দ বের হচ্ছেনা কমলের মুখ দিয়ে । কমল শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ডাকতে চাইল । কিন্তু কোন ফল পেলনা । তখন কমল সামনে ওর বাবাকে দেখতে পেল । সাদা পোশাকে বাবা কমলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । তবে এই সাদা পোশাকটা নৌবাহিনীর সাদা পোশাক না । একটা সাধারণ সাদা কাপড় , পেঁচিয়ে রেখেছে কমলের বাবাকে । সেই কাপড়ে মুখটা ছাড়া বাবার শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঢাকা পড়ে আছে । বাবা কমলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
- তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা ? এই দেখো , বাবা এসে পড়েছি তোমাকে নিতে । আর কোন কষ্ট হবেনা তোমার । এসো বাবা , এসো আমার সাথে । আমরা ঐ আকাশে মিলিয়ে যাব ।
কমল দেখল , যেটাকে বাবা আকাশ বলছে সেটা আকাশ না । সেটা রেশমির মুখ । টিপ ছাড়া , ফরসা একটা মুখ । সেই মুখটাও যেন বারবার কাছে ডাকছে কমলকে । "এসো কমল,এসো!কি হল কমল?দেরি করছ কেন?আসবে না তুমি তোমার রেশমির কাছে?
কমল এখন আর ওর আম্মুর কথা মনে করতে চাইল না । ওর বাবার সাথে ও ঐ চাঁদহীন আকাশটায় মিলিয়ে যাবে বলেই ঠিক করলো । তারপর ঘুমিয়ে গেল কমল , চিরতরে ঘুমিয়ে গেল । ওর মা-কে না বলেই ঘুমিয়ে গেল !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×