somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুবাদের কথা...

০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুদান বিমান বাহিনীর ক্রোধের জায়গাটা ঠিক স্পষ্ট নয়। ঘাসের পর্ণ কুটির? মেয়েদের হাইস্কুল? দুটোরই অবস্থান তো পাশাপাশি। নাকি ‘ফক্সহোল’ অর্থাত্ শিয়ালের গর্ত?

ব্রিটিশ সামরিক টার্ম বলছে, ওটা আসলে ‘পরিখা’। শত্রুপক্ষের বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে গর্তে লুকিয়ে যুদ্ধ করার পদ্ধতি। নুবা পর্বতমালার আদিবাসীদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র মানেই বর্শা। বিজলি বাতি, ঘড়ি, গাড়ি এমনকি বাইসাইকেল— তাদের কাছে অন্য পৃথিবী! টেলিফোনে কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। নুবাদের সঙ্গে একুশ শতকের প্রথম অর্থবহ সংযোগটা চার বছর আগে ফেব্রুয়ারির রাতে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ঘাসের কুটিরে ঘুমোচ্ছিল তারা। হঠাত্ ফাইটারের শোঁ শোঁ আওয়াজ, কান ফাটানো বোমাবর্ষণের শব্দ। কুটিরগুলোয় আগুন ধরে যায়। পরিখায় লুকিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও ব্যাপারটা পরিণত হয়েছে অভ্যাসে! কারণ নুবা পর্বতমালায় বিমান হামলা এখন রোজকার বিষয়।

এলাকাটি সুদান সরকারের বিপক্ষে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করা ‘সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট নর্থ’ (এসপিএলএমএন) এর ঘাঁটি। নুবা পর্বতমালায় শুধু এ সামরিক সংগঠনটির শাসন চলে। তাদের প্রতিহত করতে এলাকাটির চারপাশ ঘিরে রেখেছে সুদান সেনাবাহিনী। যেকোনো ধরনের রসদ সরবরাহ বন্ধ। মাথার ওপর অবিরাম বোমা ফেলছে সুদান বিমান বাহিনীর সুখোই ফাইটার। কিন্তু বেশির ভাগ বোমারই শেষ ঠিকানা নুবা জনগোষ্ঠীর ঘাসের কুটির! বিদ্রোহীদের জানমালের ক্ষতি হয় সামান্যই। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের নির্দেশেই এ নরক গুলজার। নুবা পর্বতমালার গা থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন করতে পারলে বিদ্রোহ করার তো কেউ থাকছে না! ওদিকে বিদ্রোহীরা ভাঙবে, কিন্তু মচকানোর পাত্র নয়। এদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দড়ি টানাটানির যুদ্ধে নুবা জনগোষ্ঠীর ভূমিকা শুধু নিহত হওয়া ! এটাই বুঝি যুদ্ধের সবচেয়ে নির্মম রসিকতা?

প্রায় ৯০ মাইলের মতো দীর্ঘ এ পার্বত্য এলাকাটিতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। আন্তর্জাতিক এইড সাপোর্ট, গণমাধ্যম, ডিপ্লোম্যাটদের নুবা অঞ্চল সফরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সুদান সরকারের। কিন্তু দুবার পুলিত্জার জয়ী নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী নিকোলাস ক্রিস্টফ ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। বিদ্রোহীদের সীমানা চৌকি ফাঁকি দেন ভিসা ছাড়াই! তার কলম আর ক্যামেরায় উঠে আসে ওসমান শান্তা আর হামিদা ওসমান নামের দুই হতভাগা।

একদিন রাতে বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে পরিখায় আশ্রয় নেয় ওসমানের পরিবার। বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায় কুটিরগুলোয়। বোমার আঘাতে ঘরেই নিহত হয় ওসমানের কাজিন আমুসা শান্তা। কুটিরের ঘাসের আগুন এসে পড়ে পরিখায়। সুদানের এ অঞ্চলের পরিখাগুলো বেশ গভীর। বোমার স্প্লিন্টার থেকে বাঁচতেই এ ব্যবস্থা। কিন্তু গভীর সে পরিখায় লেলিহান আগুন থামাতে পারেননি ওসমান। তার চোখের সামনেই পুড়ে অঙ্গার হয় দুই সন্তান ডায়না আর বশির। হাতে শোক পালনের সময় ছিল না। বাকি তিন সন্তান আর ওদের তিন কাজিনকে নিয়ে বিপদ মাথায় করে ওসমানকে ছুটতে হয় হাসপাতালে। গোটা বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা হয়তো নুবা জনগোষ্ঠীর অজানা, কিন্তু সভ্য মানুষরা যে হাসপাতালগামী গাড়িকে লক্ষ্য করেও বোমা ছুড়তে পারে, সেটা ওসমানের জানার বাকি নেই।

হামিদা ওসমানও তার দুই বছরের সন্তান সাফারিনাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পরিখায়। চারপাশে মুহুর্মুহু বোমা পতনের শব্দ। সন্তানকে নিরাপদে রাখতে হামিদা উপুড় হয়ে শরীরটাকে ব্যবহার করে বর্ম হিসেবে। বুকে আগলানো মানিকরতন। হঠাত্ কান ফাটানো দুটো শব্দ। মারাত্মক আহত অবস্থায় জ্ঞান ফেরে হামিদার। স্প্লিন্টারবিদ্ধ জখমি হাত-পা। সাফারিনার কথা মনে পড়তেই হামিদা আবিষ্কার করে স্প্লিন্টারের আঘাতে তার জাদুমণির মস্তিষ্কের একটি অংশ উড়ে গেছে!

চার বছর ধরে বোমা ফেলা হচ্ছে নুবা পর্বতমালায়। এ বছর পরিমাণটা বেশি। মনিটরিং প্রতিষ্ঠান নুবা রিপোর্টস অনুযায়ী, শুধু গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১ হাজার ৭৬৪টি বোমা ফেলা হয়েছে নুবাদের অঞ্চলে। তিন মাস ব্যবধানের হিসাবে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ।

প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে হাসপাতাল মাত্র একটি। ৪৩৫ বেডের হাসপাতাল মাদার অব মার্সি। সেখানকার সবেধন নীলমণি ডাক্তার টম ক্যাটেনা। ৫১ বছর বয়সী আমস্টারডামের ক্যাথলিক মিশনারি। ডাক্তার টম ক্যাটেনাই ক্রিস্টফকে জানান, ওসমানের সন্তানদের পোড়ার মাত্রাটা মারাত্মক পর্যায়ের। চিকিত্সা সেবার পরিমাণ যত্সামান্য। এর মধ্যেই ডাক্তার ক্যাটেনাকে কখনো সার্জন, কখনো দাইয়ের ভূমিকা নিতে হয়! টেলিফোন সুবিধাবিহীন একটি এলাকা, সেখানে ভাঙাচোরা এক্সরে মেশিন আর কয়েকটা ওষুধের শিশি-বোতল নিয়ে চলমান ধ্বংসযজ্ঞের বিপক্ষে আট বছর ধরে লড়ছেন ক্যাটেনা একা! বছরে একবার ম্যালেরিয়ায় অচেতন থাকার সময়টুকু ব্যতীত দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অন-কল ডিউটিতে একমাত্র স্থায়ী ফিজিশিয়ান তিনি! মাসিক বেতন ৩৫০ ডলার। স্বাস্থ্য বীমা অনিয়মিত হলেও অবসর নেয়ার বয়সের গাছ-পাথর নেই। সেবার ইচ্ছেটাই বড় কথা! প্রেমিকাকে ছেড়ে এ ইচ্ছে মুঠোবন্দি করতে হয় ক্যাটেনাকে। তার বদলে মিলেছে ‘পরশ পাথর’—বিদ্রোহীগোষ্ঠীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুরাস আলবিনো কুকুর মতে, ‘নুবা পর্বতমালার কেউ কখনই ডাক্তার ক্যাটেনার নামটা ভুলতে পারবে না। সবাই প্রার্থনা করে তার যেন মৃত্যু না ঘটে’! সেখানকার এক মুসলিম গোষ্ঠীর প্রধান হুসেইন নালুকরির মন্তব্যটা চোখ ছানাবড়া করে দেয়া মতো, ‘সে তো যিশু খ্রিস্ট।’ ব্যাখ্যাও দেন হুসেইন নালুকরি, ‘যিশু পীড়িতের সেবা করতেন। তার স্পর্শে দৃষ্টি ফিরে পেত অন্ধ, পঙ্গুরা উঠে দাঁড়াত। ডাক্তার ক্যাটেনা এ কাজগুলো প্রতিদিন করছেন।’

সাফারিনা হত্যার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পাননি ক্রিস্টফ। তার বিশ্বাস, সুদান সরকার জেনেশুনেই এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। সে পথে গ্রাম কিংবা স্কুল ঘর পড়লেও ক্ষতি নেই। এটাই নুবাদের জীবনের নির্মম বাস্তবতা। নিকোলাস ক্রিস্টফ এ বাস্তবতার সন্ধানেই নুবা পর্বতমালায় এর আগে আরো তিনবার পা রেখেছেন ! সে গল্প, তোলা রইলো আরেক দিনের জন্য ।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×