somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহ, সেলিম! হায়, সেলিম!

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইংরেজ সৈন্যদের কাছে ফুটবলে হাতেখড়ি নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারির।

১৮৭৭ সালে তার কাছ থেকে হেয়ার স্কুলের বাঙালি ছাত্ররা; বয়েজ ক্লাব। ভারতে প্রোথিত হলো ফুটবলের শিকড়। ষোলো বছর পর এলফিনস্টোন জ্যাকসনদের হাত ধরে আলোর মুখ দেখল ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ)। ওই বছরই মাঠে গড়ায় আইএফএ শিল্ড। শুরু থেকে টানা ১৮ বছর আইএফএ শিল্ড শাসন করল ব্রিটিশরা। উনিশতম মৌসুমে এসে উনত্রিশে জুলাই পাল্টে গেল ছক। প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন !

ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কাশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে হারায় শিবদাস ভাদুড়ীর দল। তাও খালি পায়ে খেলে! তখনকার বাঙালির কাছে সেই জয় পলাশীতে হারের প্রতিশোধ! রাজনীতির ময়দানে কংগ্রেস আর স্বদেশী আন্দোলনকারীরা তখন পর্যন্ত যা করে উঠতে পারেনি, খেলার মাঠে ব্রিটিশদের হারিয়ে সেটাই করে দেখিয়েছিল মোহনবাগান।

ফলস্বরূপ, উপমহাদেশে স্থায়ী ভিত পেয়ে যায় ফুটবল। এ জয় নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য গান, গল্প, কবিতা এমনকি উপন্যাস। স্বাধীনতাবোধ জাগরণের সেই সময়টা ছিল ফুটবলেরও প্রেমে পড়ার। মোহাম্মদ আবদুল সেলিম সেই ঘোর লাগা সময়ে পরেরটা বেছে নিয়েছিলেন।

মোহনবাগানের সেই জয়ে পরাধীন ভারতীয়দের মনে এ ধারণা গেঁথে যায়, খেলার মাঠে যেহেতু হারানো গেছে, রাজনীতির মাঠে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়লে স্বাধীনতাও ছিনিয়ে আনা সম্ভব। ফ্যান্টাসির অঙ্কুরোদ্গম ঘটতে চলা কোনো চঞ্চলমতি মনে রাজনীতির এসব মার-প্যাঁচ ঢোকার কথা নয়।

কলকাতার মেটিয়াবুরুজে একটা সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম সেলিমের। মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক জয়ের উত্সবস্রোত ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল সাত বছর বয়সী সেলিমের মনে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চুলোয় ওঠে। শুরু হয় অহর্নিশ ফুটবলচর্চা। সহজাত প্রতিভা থাকায়, অল্প দিনেই কথা বলতে শুরু করে তার জাদুকরি দুটি পা!

কলকাতার ঘরোয়া ফুটবলে তখন তিনটি স্তম্ভ— মোহনবাগান, মোহামেডান স্পোর্টিং ও ইস্টবেঙ্গল। এ তিন ক্লাবের সমর্থকরা ছিলেন ভীষণ সাম্প্রদায়িক প্রকৃতির। সামাজিক শ্রেণী ও ধর্মে বিভাজিত ছিল ক্লাবের সমর্থন।

‘ভদ্দরলোক’খ্যাত সমাজের উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা সমর্থন করতেন মোহনবাগান। মোহামেডান আদর্শগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থাকলেও মুসলিম সমর্থক সিংহভাগ। পূর্ববঙ্গের (এখন বাংলাদেশ) প্রতিনিধিত্ব করত ইস্টবেঙ্গল। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা সেলিমের প্রথম ক্লাব বৌবাজারের চিত্তরঞ্জন।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ‘বি’ দলে খেলেছিলেন ১৯২৬ ও ১৯২৭ পর্যন্ত। সেখানেই একদিন হঠাত্ সেলিমকে আবিষ্কার করেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক পঙ্কজ গুপ্ত। হকির জাদুকর ধ্যাঁন সিংকে ‘চাঁদ’ তকমাটা তারই দেয়া। ধ্যাঁনচাঁদের প্রথম কোচও পঙ্কজ গুপ্ত। শিষ্যকে নিয়ে একবার বলছিলেন, সে একদিন চাঁদের মতো রোশনাই ছড়াবে। বাকিটুকু ইতিহাস।

পাকা জহুরী পঙ্কজ গুপ্তের রত্ন চিনতে এবারো ভুল হলো না। সেলিমকে তিনি তুলে আনেন স্পোর্টিং ইউনিয়নে। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এ ক্লাবে খেলার পর বছরখানেক ইস্টবেঙ্গলে ছিলেন সেলিম। এর পর যোগ দেন কলকাতার খ্যাতিমান ক্রীড়াব্যক্তিত্ব ছোনে মজুমদারের আরিয়ান ক্লাবে। যাযাবরের মতো ঠিকানা পাল্টানোর এ সময় গড়ে ওঠে তার ফুটবল ‘বেসিকস’। এসব ক্লাবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন ইউরোপীয়দের হারানোর মানসিক তাগিদ।

১৯৩৪ সালে প্রথম বড় ক্লাবের মুখ দেখেন সেলিম। যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ১৮৮৭ সালের জুবিলী ক্লাব, যা পরবর্তীতে ক্রিসেন্ট ক্লাব ও হামিদিয়া ক্লাব থেকে ১৮৯১ সালে তৃতীয় ও শেষ দফায় নাম পাল্টে আজ পর্যন্ত মোহামেডান। ১৮৯৮ সালে কলকাতা ফুটবল লিগ চালু হলেও ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমের আগ পর্যন্ত আসরটিতে খেলার সুযোগ পায়নি মোহামেডান।

কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, অভিষেক মৌসুমেই কলকাতা লিগকে প্রথম ‘নেটিভ চ্যাম্পিয়ন’-এর মুখ দেখায় ‘ব্লাক প্যান্থার’রা। তখনকার মোহামেডান ছিল আক্ষরিক অর্থেই ‘কসমোপলিটন’। মাসুম, মহিউদ্দিন ও রহমত ছিলেন বেঙ্গালুরুর। জুম্মা খান এসেছিলেন পশ্চিম সীমান্ত থেকে। ‘দ্য ইনভিন্সিবলস’খ্যাত সেই দলটার বাকিরাও এসেছিলেন ভারতের নানা প্রান্ত থেকে। কাকতালীয় ব্যাপার, কলকাতা লিগে অভিষেক মৌসুমেই মোহামেডানের শিরোপা জয় ছিল, ক্লাবটিতে সেলিমেরও অভিষেক মৌসুম !

এর পর আর সেলিমকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বোরিয়া মজুমদার ও কৌশিক গাঙ্গুলী কর্তৃক যৌথভাবে রচিত গ্রন্থ ‘A social history of Indian football : striving to score-এ মোহামেডানে সেলিমের স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে বলা হয়,

‘সেলিমকে নিয়ে ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবার কলকাতা লিগ জয় করে মোহামেডান। এ জয় অচিরেই পরিণত হয় অভ্যাসে। আক্রমণভাগের পুরোধা হয়ে সেলিম মোহামেডানকে পরের চার বছরও শিরোপা জেতান। অসাধারণ এ প্রতিভা তার নিখুঁত বল নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং, পাস ও লব দিয়ে হাজারো ভক্তের হূদয় কেড়ে নেন। তিনি জানতেন কতটা উঁচুতে পাস দিতে হবে। তার পাসিং দেখতেই আসত মোহামেডান সমর্থকরা।’

১৯৩৬ সালে টানা তৃতীয় দফা কলকাতা লিগ জয়ের পর ছুটিতে ছিলেন মোহামেডান খেলোয়াড়রা। আইএফএ শিল্ডের জন্য শরীর চাঙ্গা করতেই এ অবকাশযাপন। কিন্তু সেটা আর অবকাশ থাকেনি। এ সময় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে ভারতে পা রাখে চাইনিজ অলিম্পিক দল। প্রথম দুটি ম্যাচ ছিল সর্বভারতীয় একাদশের বিপক্ষে, পরেরটি সিভিল ও মিলিটারির সমন্বয়ে গঠিত একাদশ। তিনটি ম্যাচেই ডাক পান সেলিম। এর মধ্যে প্রথম ম্যাচটা ছিল ভারতের মাটিতে আইএফএ আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ।

প্রথম ম্যাচে সর্বভারতীয় একাদশ হারলেও আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন রাইটব্যাক সেলিম। চাইনিজ অলিম্পিক দলের অফিশিয়াল ডা. চি চাও ইয়ং সফর শেষে বিবৃতিতে বলেছিলেন,

‘এটা দুর্ভাগ্য যে তারা জিততে পারেনি। সেলিম-রহিম এবং ভট্টাচার্য, আব্বাস আলাদা মাপের খেলোয়াড় (প্রথম ম্যাচে)। গোটা সফরে তারাই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে আমাদের।’

সেদিন সেলিমের খেলায় ডা. চি চাও ইয়ংয়ের মতো মুগ্ধ হয়েছিলেন আরো একজন।

ব্রিটেনের একটি শিপইয়ার্ডে স্টোরকিপারের কাজ করতেন সেলিমের কাজিন হাশিম। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন তিনি। প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচে ভাইয়ের খেলা দেখে হাশিম তাজ্জব বনে যান। ‘সেলিম ইউরোপে খেলতে সক্ষম’— ভাবনাটা পেয়ে বসে হাশিমকে। ভাইকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজিও করান তিনি। আর তাই দ্বিতীয় প্রদর্শনী ম্যাচের কয়েক দিন আগে সেলিম হঠাত্ করেই লাপাত্তা!

আইএফএ খুজেছে, পুলিশ খুজেছে, প্রদর্শনী ম্যাচে সেলিমকে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞাপনও ছাপা হয় সংবাদপত্রে ; কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম। সেলিম তত দিনে ভারতের মাটি ছেড়েছেন! হাশিমের হাত ধরে কায়রো হয়ে সেলিম তখন লন্ডনগামী জাহাজের যাত্রী।

৪৩ বছর পর সেলিমের নিখোঁজ হওয়ার আসল রহস্য জনসম্মুখে উদ্ঘাটন করে বাংলা সাময়িকী ‘খেলার আসর’। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত তাদের একটি সংখ্যায় লেখা হয়, ‘সেলিম হঠাত্ করেই নিখোঁজ! আসলে সে তখন কায়রোতে তার ভাই হাশিমের সঙ্গে ইংল্যান্ডগামী জাহাজে চেপেছে। চীনাদের বিপক্ষে সেলিমের খেলা দেখে হাশিম তাকে ইউরোপের নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে প্রলুব্ধ করে। হাশিমের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইউরোপ মাত করে দেবে সেলিম।’

ভাইকে ইংল্যান্ডে ধাতস্থ করতে কিছুদিন লন্ডনে ছিলেন হাশিম। সেখান থেকে তাদের পরবর্তী গন্তব্য গ্লাসগো হয়ে সেল্টিক পার্ক। সেল্টিক ফুটবল ক্লাবের ঘরের মাঠ। এখানে সবকিছুই সেলিমের অচেনা। চমকে যাওয়াটা তাই প্রত্যাশিতই ছিল। ভাষাগত, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য তো ছিলই, সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সেল্টিকে সবাই পেশাদার বুটপরিহিত খেলোয়াড়! কিন্তু এতটা পথ এসে ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফিরতে চাননি দুই ভাই। সেল্টিক পার্কে দাঁড়িয়ে ভাইকে হাশিম শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন- পারবি তো? ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় সেলিম।

সেল্টিকের ম্যানেজার তখন উইলি ম্যালে। হাশিম তাকে খুঁজে বের করেন। স্কটিশ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে ক্লাবটি সে সময়েই ১৭ বারের চ্যাম্পিয়ন। এমন একটি ক্লাবের ম্যানেজারকে হাশিম যা বলেছিলেন, সেটা আজো শুনলে হাসবেন যে কেউ, ‘ভারত থেকে জাহাজে করে অসাধারণ এক ফুটবলার এসেছে। দয়া করে একবার তার ট্রায়াল নিয়ে দেখবেন? কিন্তু সমস্যা একটাই— সেলিম খালি পায়ের ফুটবলার।’

খালি পায়ে ফুটবল খেলার সঙ্গে তখনো ইউরোপের পরিচয় ঘটেনি। হাশিমের কথা শুনে উইলি ম্যালে তাই খুব একচোট হেসে নেন। এর পর বিনা বাক্য ব্যয়ে উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করেন। কিন্তু হাশিম নাছোড় বান্দা। শিকারকে সে টোপ গেলাবেই। শেষ পর্যন্ত হাশিমের জিদের কাছে হার মানলেন ম্যালে, কিন্তু একটা শর্তে— তিনজন রেজিস্টার্ড কোচ ও এক হাজার ক্লাব সদস্যের সামনে ট্রায়াল দিতে হবে সেলিমকে। সেল্টিক হেড কোচের এ শর্ত পত্রপাঠ মেনে নেয় দুই ভাই।

ট্রায়ালের দিন ক্লাব সদস্যদের আনাগোনায় গমগম সেল্টিক পার্ক। ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েন সেলিম। অগত্যা কোচেরা তাকে মাঠের এক কোনায় নিয়ে যান, যেন স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রায়াল দিতে পারেন তিনি। কিছুক্ষণ পরই হীরের দ্যুতি! সেলিমের স্কিলে মুগ্ধ তিন কোচ। কিন্তু সেলিম সন্তুষ্ট ছিলেন না।

হাশিমকে ডেকে পাঠান সেলিম। ভাইকে তিনি বলেন, প্রথাবদ্ধ অনুশীলনের বাইরে তার নিজের আবিষ্কৃত তিনটি ‘স্কিল’ কোচদের দেখাতে চান। যে কথা, সেই কাজ এবং সেই তিন স্কিলের মারে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ে তিন কোচের। বুট নয়, সামান্য অ্যাংকলেটে মোড়ানো একজোড়া উপমহাদেশীয় পা থেকে অমন বিধ্বংসী কিছু দেখা, স্কটিশ কোচদের কল্পনার বাইরে ছিল! পরের সপ্তাহে হ্যামিল্টন একসিওসের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ ছিল সেল্টিকের। সেলিমকে সেল্টিকের মূল দলে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন তিন কোচ।

জোড়া গোল করেছিলেন সেলিম। এর মধ্যে একটি পেনাল্টি থেকে, গণমাধ্যমের চোখে সেটা ছিল ‘আনস্টপেবল’। ম্যাচটা ৫-১ গোলে জেতে সেল্টিক। কিন্তু গোল নয়, মাঝমাঠে সেলিমের খেলায় মন্ত্রমুগ্ধ হয় সেল্টিক সমর্থকরা। জন্মগতভাবেই তার ‘টো’ ছিল বেশ চওড়া। এ কারণে বল রিসিভে পারফেকশন ছিল ভীষণ সহজাত। পাসিংয়েও ভীষণ দূরদর্শী। ক্রসগুলো ছিল কলার মতোই বাঁকানো কিন্তু নিখুঁত, যেন তিনি আগেই জানতেন সতীর্থের সামনে কোথায় ফেলতে হবে বল!

২৮ আগস্ট, ১৯৩৬। সেল্টিকের হয়ে এদিন আরো একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন সেলিম। প্রতিপক্ষ দল ছিল গ্যালস্টোন। শুধু সেলিমের খেলা দেখতে এদিন সেল্টিক পার্কে ভিড় জমায় প্রায় সাত হাজার সমর্থক। ভারতীয় ফুটবলার দেখার রোমাঞ্চ পেতে চেয়েছিলেন তারা। সমর্থকদের এ রোমাঞ্চ অচিরেই পরিণত হয় আনন্দে। মাঝমাঠে আবার ঐন্দ্রজালিক খেলা উপহার দেন সেলিম। তার জন্য এ ম্যাচের গেটমানি থেকে ১০০ পাউন্ড বেশি আয় করে সেল্টিক।

গালস্টোনের বিপক্ষে ম্যাচে সেলিমের পারফরম্যান্স প্রসঙ্গে সেল্টিক কিংবদন্তি অ্যালেক্স বেনেট তার ম্যাচ রিপোর্টে লিখেছিলেন, ‘খেলা তখনো বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু দর্শকরা এরই মধ্যে সেলিমের প্রেমে মশগুল। ট্যাকলিংয়ে তেমন একটা আগ্রহ নেই তার। কিন্তু কি পাসিং! যেখানে ইচ্ছা ঠিক সেখানেই নিখুঁত মাপে বলের জোগান এসেছে তার পা থেকে। তার ক্রসিং সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলা যায়— দুর্দান্ত !’

স্কটিশ গণমাধ্যমও লুফে নেয় সেলিমকে। ২৯ আগস্ট তাকে নিয়ে বিশাল প্রতিবেদন ছাপায় স্কটিশ ডেইলি এক্সপ্রেস। শিরোনাম দেয়া হয়— ‘ইন্ডিয়ান জাগলার; নিউ স্টাইল’। প্রতিবেদনে লেখা হয়—

‘গত রাতে পার্কহেডের দর্শকদের সম্মোহিত করে রেখেছিলেন সেলিম। তার দুই পায়ে যেন বজ্রের দ্যুতি ! পায়ে পায়ে বল খেলিয়ে গালস্টোনের এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে সেলিমের দেয়া ফ্লিক দারুণ পজিশনে পেয়ে যান এক স্ট্রাইকার। তাকে শুধু বলটাকে জালে পাঠানোর আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয়। সেলিমকে পেনাল্টি নিতে বলা হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। পেনাল্টি নিতেই তার যত লজ্জা! হাশিমের চোখে তার ভাই অসাধারণ, গত রাতে দর্শকদের রায়ও ঠিক তাই।’

সেল্টিক সমর্থকদের এমন নৈবেদ্যকে খুব বেশি দিন প্রশ্রয় দেননি সেলিম। প্রশ্রয় দেননি জার্মানির একটি ক্লাবকেও। সেল্টিকে থাকতে জার্মানির একটি ক্লাব তাকে ডেকেছিল। সেলিমকে পেশাদার চুক্তির বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিল ক্লাবটি। কিন্তু জন্মভূমি তাকে টেনেছে চুম্বকের মতো। সেই মোহামেডান! সেই চিরায়ত বাংলার মুখ! দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন সেলিম। ২১ সেপ্টেম্বর সেল্টিকের সভাপতি থেকে দারোয়ান— সবার সঙ্গে করমর্দন করে কায়রোগামী জাহাজে ওঠেন সেলিম।

আহা! সেলিম তখন যদি বুঝতে পারতেন, বাঙালির চিরাচরিত আবেগের বশবর্তী হয়ে ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসের কোন অধরা সুযোগকে তিনি হেলায় নস্ট করছেন! ‘হোমসিকনেস’ আর প্রাণের ক্লাব মোহামেডানকে ক্যালকাটা লিগ জেতানোর খিদে তাকে ইউরোপে খেলার মহিমা টের পেতে দেয়নি। হায়! কোথায় ক্যালকাটা লিগ আর কোথায় স্কটিশ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ!

২০০২ সালে ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন সেলিমের ছেলে রশিদ। তার বাবার সম্মানে সেল্টিক একটি চ্যারিটি ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এ ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত মোট অর্থের পাঁচ শতাংশ সেলিমের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন সেল্টিক কর্তারা। সিদ্ধান্তটিকে সেলিমের গত কয়েক মাসের পারফরম্যান্সের পারিশ্রমিক হিসেবেও দেখেছে তারা। সেল্টিকের এ প্রস্তাবে সেলিম রাজি হন।

কিন্তু সে সময় সেল্টিকের গেটমানি থেকে প্রাপ্ত অর্থের পাঁচ শতাংশ ভারতীয় মুদ্রায় কেমন হতে পারে, এ সম্পর্কে সেলিমের কোনো ধারণাই ছিল না। সেই প্রীতি ম্যাচের বিশেষ অতিথি ছিল গ্লাসগোর এতিম শিশুরা। রশিদ জানান, তার বাবা মাঠেই ওয়াদা করেছিলেন প্রাপ্ত অর্থ এতিম শিশুদের তহবিলে দান করবেন। ম্যাচ শেষে সেল্টিক তার হাতে ১ হাজার ৮০০ পাউন্ড নগদ অর্থ তুলে দেয়। সেলিম এ বিশাল অঙ্কের অর্থ দেখে চমকে গেলেও কথার বরখেলাপ করেননি। গোটা অর্থই তিনি দান করেন এতিম শিশুদের তহবিলে। সেলিমের এ মহানুভবতা ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল ব্রিটিশদের মনে।

ভারতে ফিরে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মোহামেডানকে টানা দুই মৌসুম ক্যালকাটা লিগ জেতান তিনি। অ্যাংকলেট তুলে রাখার বেশ কয়েক বছর পর বার্ধক্যজনিত কারণে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন সেলিম। এ সময় বাবার চিকিত্সার্থে সেল্টিকের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন রশিদ। তার ভাষায়, ‘টাকা চাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। মোহাম্মদ আব্দুল সেলিমের স্মৃতি সেল্টিকের হূদয়ে তখনো সজীব ছিল কিনা, শুধু এটুকুই জানতে চেয়েছি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, চিঠি পাঠানোর কয়েক দিন পরই আমি একটি ফিরতি খাম হাতে পাই। এটা ছিল সেল্টিকের পাঠানো চিঠি, যার সঙ্গে ১০০ পাউন্ড মূল্যের একটি ব্যাংক ড্রাফটও ছিল। আমি আজ পর্যন্ত তা ভাঙাইনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংরক্ষণ করব।’

১৯৮০ সালে ৭৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটান সেলিম। কলকাতার তত্কালীন শীর্ষ দৈনিক অমৃতবাজারে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছিল এভাবে—

‘তিরিশের দশকে টানা পাঁচবার কলকাতা লিগ জেতা মোহামেডানের কিংবদন্তি সেই দলের সদস্য মোহাম্মদ সেলিম কলকাতায় বুধবার সকালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। রাইট উইংয়ে খেলা এ ফুটবলার অনেক ক্লাবের সঙ্গেই সংযুুক্ত ছিলেন এবং অবসরের পর খুদেদের কোচিং দিতেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, চার ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে যান।’

সেলিম ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপে খেলা প্রথম ফুটবলার! কোন ভারতীয়কে খেলানো ইউরোপের প্রথম ক্লাবও সেল্টিক! জীবদ্দশায় কখনো স্বীকৃতির পিছু ছোটেননি সেলিম। কিন্তু মৃত্যুর পর তাকে প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দেয়া হয়নি!

এত বড় সত্যটা সবার চোখের সামনেই গোপন করে যায় কলকাতার শীর্ষ দৈনিক। এজন্য তত্কালীন হিন্দু-মুসলিম বৈষম্যকে দুষে থাকেন অনেকেই। কিন্তু সে কথার সত্যতা যাচাইয়ের সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। অনেক পরে এসে প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়েছিলেন সেলিম। সেটাও কেবলই ইতিহাসের পাতায়। কলকাতায় একজন গোস্ট পালের মূর্তি আছে ঠিকই, কিন্তু সামান্য এপিটাফ ছাড়া মহানগরের আর কোথাও সেলিম নেই! যদি একান্তই তার খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয়, সঙ্গে রাখতে পারেন তিরিশের দশকে সেলিমকে নিয়ে এক সেল্টিক ভক্তের লেখা ‘ইন্ডিয়ান জাগলার’ শিরোনামে কবিতার এ কয়েকটি লাইন—

‘‘ Players from all nations

Have represented Celtic on the pitch,

Where their culture is glorified

In wearing a Celtic strip,

And a man from India,

Where traditions are steep,

Stepped onto Parkhead’s hallowed turf

Wearing only bandages on his feet.

Mohammed Salim, to Calcutta,

He was born,

At a time when Nationalist,

Fought the British Crown,

Independence was the cry

Against ‘The Colonial Rule’,

Where matters could have been settled

With a game of football.’’

(বণিক বার্তা ঈদসংখ্যা ২০১৬ এবং খেলাধুলা ওয়েবসাইটে লেখাটি প্রকাশিত)


((সেলিম খালি পায়ে ফুটবল খেলতেন। তার পায়ে ব্যান্ডেজ (অ্যাংকলেট) বেঁধে দিচ্ছেন সেল্টিকের ‘নেপোলিয়ন’ খ্যাত ট্রেনার জিমি ম্যাকমেনেমি। ১৯৩৬ সাল)

( সেল্টিকের অনুশীলনে মোহাম্মদ সেলিম ছবি: সেল্টিক উইকি)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:২৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×