somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

কবি কা‘ব বিন আশরাফ হত্যার ঘটনা প্রথমে নাড়া দিয়েছিল আমাকেও! কিন্তু ........ (قَتْلُ كَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ):

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবিঃ অন্তর্জাল।

কবি কা‘ব বিন আশরাফ হত্যার ঘটনা প্রথমে নাড়া দিয়েছিল আমাকেও! কিন্তু ........ (قَتْلُ كَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ):

সত্যি কথা বলতে কি, কা‘ব বিন আশরাফ হত্যার ঘটনাটি পড়তে গিয়ে প্রথমে থমকে গিয়েছিলাম আমিও। কিছুটা নাড়া দিয়েছিল আমাকেও! কবি ও কবিতার প্রতি জন্ম জন্মান্তরের অদেখা ভালোবাসার টান বলে এমনটা অনুভূত হয়েছিল কি না জানি না। কা'ব বিন আশরাফ কবি ছিলেন বলে তার প্রতি আলাদা একটা টান ছিল এটা সত্য। সকল কবিদের জন্যই কেন যেন এটা থাকে। সবার কথা বলতে পারবো না, অন্ততঃ আমার আছে। বিরুদ্ধ নীতি আদর্শের কবিদের প্রতিও রয়েছে। বিপরীত মত এবং পথের কবিদের প্রতিও রয়েছে। এই টান আসলে অন্য জিনিষ। এটা কিসের টান- ব্যাখ্যা করে বুঝানো কিছুটা কঠিন বটে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা সবকিছুর উর্ধ্বে একজন কবি থাকেন সকল মানুষের। কবি সাহিত্যিকদের নির্দিষ্ট ভূ-ভাগের সীমাবদ্ধতার মাঝে বেধে রাখা যায় না। উচিতও নয়। কবিরা সার্বজনিন। সকলের সম্পদ তারা। তাবত পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের প্রতিটি ঘর তাদের আবাস। একটি সুন্দর কবিতা, তা যে ভাষারই হোক - বিশ্বের সকল কালের, সকল জাতির এবং সকল মানুষের। হুমায়ুন আজাদের অনেক লেখার সাথে একমত হতে না পারলেও তার কিছু লেখা, কিছু কথা মনে দাগ কাটে। তিনি ভিন্ন মতের তাতে কি? তার সৃষ্টিশীলতা যদি তাকে কাছে টেনে নিতে বাধ্য করে, সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে কার্পন্য করা নিছকই দীনতা। কবির ভিন্নমত যদি শুধু মতভিন্নতার ভেতরেই সীমিত থাকে তাহলে তা নিয়ে শোরগোল তোলার মত তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু কবির কবিসত্বার আড়ালে যদি লুকিয়ে থাকে ভিন্ন কোনো কুৎসিত চেহারা, দেশ-জাতি-মানবতার জন্য ক্ষতির কারণ এবং উপকরণ তাহলে তাকে উপেক্ষা করা যায় কিভাবে? যেমনটা লুকানো ছিল কবি কা'ব বিন আশরাফের সুদর্শন চেহারার অন্তরালে।

হ্যা, কা'বকে পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে দেখতে পাই যে, কবি কা'বের সুদর্শন চেহারার অন্তরালে লুকানো রয়েছে ভয়ঙ্কর এক বিশ্বাসঘাতক মানবতাবিরোধী দুর্বৃত্তের মুখাবয়ব; যিনি কি না নিজ মাতৃভূমি, স্বজাতি এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত, সতিসাধ্বী মুসলিম নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও কলঙ্ক রটানোর মত নিকৃষ্ট ঘৃণ্য অপকর্ম যার নিত্য নৈমিত্তিক কাজের অনুষঙ্গ, এমনকি আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুনের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের সহযোগী এবং পরামর্শদাতাও স্বয়ং তিনি! তার চরিত্রের অন্ধকার এই দিকগুলো অবলোকন করার পর থেকে তার প্রতি আমার সাধারণ অনুভব অনুভূতিতে ভাটা পড়ে। হৃদ্যতার সেই টানটা আর খুঁজে পাই না। আমাদের উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটিয়ে জাতিকে ২০০ বছরের জন্য ধূর্ত বৃটিশ বেনিয়াদের গোলামীর জিঞ্জিরে বন্দি করে রাখার কারণে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের পাওনা যেমন একরাশ ঘৃণা, মুনাফিক দুর্বৃত্ত কা'বের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ভাববার সুযোগ দেখি না- এ ভাব ও ভাবনায় যদি আমার কোনো বিচ্যুতি থেকে থাকে, সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা ব্যতিত করার কিছুই নেই।

দরদ প্রদর্শনের আড়ালে উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছুঃ

এ কালে অনেক দরদী(!) ব্যক্তিকে দেখা যায়, তারা কবি কা'ব বিন আশরাফের হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন দিকে টেনে নিয়ে তার প্রতি হৃদয়ে উথলে ওঠা অনেক সহানুভূতি প্রদর্শন করতে চান। আসলে গরু কুরবানি দেয়াকে যারা জীবের প্রতি নৃশংসতার তকমা দিয়ে ইসলাম ধর্মের একটি আবশ্যকীয় বিধানের দিকে অন্যায় অঙুলি নির্দেশ করতে অভ্যস্ত; এই কা'ব বিন আশরাফের মত ধুরন্দর প্রকৃতির দুর্বৃত্তের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনকারীদেরকেও মূলতঃ একই খুড়ে মাথা মুড়ানো বলেই অনুমিত হয়। 'কুরবানি দেয়া'কে 'পশুর প্রতি নৃশংসতা' বললেও 'পশুর প্রতি দরদ নয়' বরং 'ইসলাম ধর্মের প্রতি জন্ম জন্মান্তরের লালিত বিদ্বেষে'র প্রকাশ ঘটানোই যে তাদের আসল উদ্দেশ্য - এটা যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে দুর্বৃত্ত কা'ব বিন আশরাফের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনেরও মূল বিষয় যে একই সূত্রে গাথা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

এই ছদ্মবেশী মায়াকান্নার ধ্বজাধারীগণ কা'ব বিন আশরাফের দুর্বৃত্তায়নকে ঢেকে রেখে তাকে মহান বানাতে সচেষ্ট। পক্ষান্তরে দয়ার সাগর আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করার অপপ্রয়াসে তারা লিপ্ত যে, তিনি কা'বের ক্ষেত্রে অন্যায় হত্যার অনুমোদন প্রদান করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করুন। বিশ্বজাহানে ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক, রহমাতুল্লিল আলামীন, জগতবাসীর প্রতি অপরিসীম দয়া এবং অফুরন্ত ভালোবাসার কারণে যিনি নিজের জানের দুশমনদের ক্ষমা করে দিতেন অকাতরে, যিনি তায়েফবাসী দুষ্ট লোকদের সীমাহীন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণে-পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত ও গুরুতর আহত হয়ে বারবার বেহুশ হওয়ার মত নিতান্ত নাজুক পরিস্থিতিতেও, জিবরাইল আলাইহিস সালামের একান্ত নিবেদন সত্ত্বেও তাদের সামান্য শাস্তি প্রদানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি, শাস্তিদানের প্রস্তাবে সম্মতি দেননি; এমনই কোমল, ক্ষমাশীল এবং বিশ্বমানবতার জন্য দয়ায় পূর্ণ দরদে পূর্ণ যার অন্তর, সামান্য পরিমান প্রতিশোধপরায়ন হয়ে তাদের জন্য ধ্বংসের দুআ না করে বরং সেই বেদনাবিদুর দিনটিতে রক্তাক্ত-আহত-ক্লান্ত-অবসন্ন অবয়বে অশ্রুসিক্ত নয়নে কম্পমান দু'টি হাত উঁচু করে মগ্ন হয়েছিলেন তায়েফবাসীর ক্ষমা এবং হেদায়েত প্রার্থনায়, মক্কা বিজয়ের দিন কুরাইশ নেতৃবৃন্দসহ মক্কার বিখ্যাত সব শত্রুদের সাধারণ ক্ষমার নজিরবিহীন ঘোষনা দিয়ে মানবতার ইতিহাসকে পাল্টে দিলেন যিনি, কুরআনের ভাষায়- 'রহমাতুল্লিল আলামীন', তথা, 'জগতসমূহের জন্য দয়া' - সেই রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি এমন ঘৃণ্য অপবাদ প্রদানের ধৃষ্টতা প্রদর্শনের চেষ্টা যারা করছেন, মুখে তারা যতই মানবতার শ্লোগান তুলে থাকুন না কেন, সত্যিকারের মানবতাবাদের ধারেকাছেও নেই তারা। সম্মানিত প্রিয় পাঠকের কাছে সবিনয় প্রশ্ন রাখছি, এই সাধারণ বিষয়টি বোধগম্য হতে অনেক বেশি বিদ্ধান হওয়ার প্রয়োজন আছে কি? বুঝেশুনে, সত্যকে গোপন করে, পার্থিব ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে যারা প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে বিষোদগারের বিষবাষ্প ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত তাদের জন্য আমরা শুধু হেদায়েতের প্রার্থনাই করতে চাই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা তাদেরকে হেদায়েতের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।

জ্বি, হেদায়েত প্রার্থনা করতে করতেই চলুন, ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত কা'ব বিন আশরাফের সাথে সামান্য পরিচিত হয়ে আসিঃ

কা‘ব বিন আশরাফ। মদিনার প্রসিদ্ধ ইহুদী নেতা। কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত। কাব্যে তার পারদর্শিতা। ইহুদীদের মধ্যে এমনই এক ব্যক্তি তিনি, যিনি ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করতেন। তিনি নাবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াতেন। ‘বনু তাঈ’ গোত্রের শাখা 'বনু নাবাহান' এর সাথে তার পিতা সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। আর তার মাতা 'বনু নাযীর' গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কা‘ব বিন আশরাফ ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি পুঁজিপতিও ছিলেন। আরবে তার সৌন্দর্য্যের খ্যাতি ছিল। মদীনার দক্ষিণে বনু নাযীর গোত্রের আবাদী ভূমির পেছনের দিকে ছিল তার বসবাসের সুরম্য দূর্গ।

ইসলাম এবং ইসলামের নবীর প্রতি তিনি যে কি পরিমান শত্রুতা পোষন করতেন তা অনুমান করা যায় মুসলমানদের সাথে তার শত্রুতামূলক বিভিন্ন কথা, কাজ ও আচরণে। ইসলামের বিরুদ্ধে তার অব্যাহত ষড়যন্ত্র, মুসলিম সতীসাধ্বী নারীদের নামে মিথ্যে অপবাদ প্রদান করে তাদের নামে কুৎসা রটনা, আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার প্রকাশ্য হুমকিসহ তার ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষের কিছু নমুনা উপস্থাপন করছি-

বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় তিনি মেনে নিতে পারেননিঃ

উদাহরণতঃ বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় লাভ এবং নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের নিহত হওয়ার প্রথম খবর শুনে তিনি অকস্মাৎ বলে ওঠেন- ‘সত্যিই কি ঘটনা এটাই? এরা ছিল আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং জনগণের বাদশাহ। যদি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে হত্যা করে থাকে তবে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ ওর উপরিভাগ হতে উত্তম হবে; অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম হবে।'

ধরা পড়ে যায় কা'বের গোপন চিঠিঃ

ইবনে ইসহাকের বর্ণনা উদ্ধৃত করে কা'বকে হত্যা করার পেছনে কারণ হিসেবে উইকিপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাবের প্রেরিত একটি চিঠি বদর যুদ্ধের পর মক্কায় পৌঁছেছিলো এবং তা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে কুয়াইশদেরকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল। সে চিঠির বিষয় ফাঁস হয়ে গেলে কা'বের গোপন ষড়যন্ত্র সম্মন্ধে মুসলিমরা নিশ্চিত হন। বিস্তারিত- Click This Link

বিশ্বাসঘাতকতার আরেক নাম কা'বঃ

অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে ক্ষমা করার বিধান পৃথিবীর কোথাও নেই। মক্কাবাসীদের সাথে মদিনার চুক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি মদিনাবাসী লোক হয়ে মদিনার বিরুদ্ধে মক্কার কুরাইশদেরকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায়ে উষ্কানি দিয়ে আসছিলেন। তার এই বিশ্বাসঘাতকতা নজিরবিহীন। যে কোনো দেশ, রাষ্ট্র ও জনপদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এই ধরণের বিশ্বাসঘাতককে উচিত শিক্ষা দেয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের স্বার্থ বিরোধী লিখিত চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হন কা'বঃ

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র দাবি করে যে, কাবকে হত্যা করার কারণ ছিল যে, তিনি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার জন্য একদল ইহুদির সঙ্গে গোপন পরিকল্পনা করেছিলেন। বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা যারুল্লাহ যামাখাশারি, আল-তাবারসি, আল-রাযি এবং আল-বায়দাভির মত পরবর্তী ভাষ্যকারদের কাছ থেকে আরেকটি পৃথক মত পাওয়া যায় যে, কাবকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাবের চুক্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে কাব তার মক্কা সফরের সময় কুরাইশ এবং চল্লিশজন ইহুদির মধ্যে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সন্ধিচুক্তিতে আবু সুফিয়ানের সাথে সাক্ষর করেন। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

অধ্যাপক ইউরি রবিনের ভাষ্যমতে, প্রাথমিক উৎসগুলোতে কুরাইশ এবং ইবনে আশরাফের মাঝে স্বাক্ষরিত একটি মুসলিমবিরোধী সন্ধির অস্তিত্বের বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যেতে পারে। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিস্তারিত- Click This Link

পৃথিবী থেকে মুসলিমদের অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনিঃ

পরে যখন তিনি নিশ্চিতরূপে জানতে পারলেন যে, বদরের যুদ্ধের ফলাফলের যে খবর তিনি শুনেছেন তা সত্য, তখন আল্লাহর এ দুশমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলিমদের নিন্দা এবং ইসলামের শত্রুদের প্রশংসা করতে শুরু করলেন এবং তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন। কিন্তু এতেও তার বিদ্বেষবহ্ণি প্রশমিত না হওয়ায় তিনি পৃথিবী থেকে মুসলিমদের অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলার গভীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি পথ খুঁজতে থাকেন।

যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে তিনি ছুটে গেলেন সুদূর মক্কায়ঃ

অবশেষে অন্য কোনো উপয়ান্তর না পেয়ে তিনি মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগ দেয়াকেই অধিক উপযুক্ত মনে করলেন। তার ধারণা ছিল, একমাত্র কুরাইশদের বৃহত শক্তিই নতুন ধর্মবিশ্বাস ইসলাম এবং এর অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে। তাই তিনি কুরাইশদের সাথে হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে অশ্বে আরোহণ করে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর মক্কায় উপনীত হলেন এবং মুত্তালিব ইবনু আবী অদাআ সাহমীর অতিথি হলেন। তারপর তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সামনে নিজের কাব্যপ্রতিভার প্রকাশ ঘটালেন। তিনি কুরাইশদের মর্যাদাবোধ তুলে ধরে তাদের উত্তেজিত করতে, তাদের প্রতিশোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তাদেরকে নাবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে উৎসাহিত করতে কবিতা বলে বলে ঐ কুরাইশ নেতাদের জন্য বিলাপ করতে লাগলেন যাদের বদর প্রান্তরে হত্যা করার পর কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।

কা’ব বিন আশরাফের দুর্গ সংলগ্ন কূপ, ছবিঃ Click This Link থেকে সংগৃহীত।

তিনি যে মিথ্যাবাদী এবং শঠ তার প্রমানঃ

মক্কায় তার অবস্থানকালে আবূ সুফিয়ান ও মুশরিকরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নিকট আমাদের দ্বীন বেশী পছন্দনীয়, না মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বীন? আর উভয় দলের মধ্যে কোন্ দলটি বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত?’

উত্তরে কা‘ব বিন আশরাফ বললেন- ‘তোমরাই তাদের চেয়ে বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত এবং উত্তম।'

তার এই মিথ্যাচারের অপনোদনেই আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত নাযিল করেন-

‏(‏أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِّنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاء أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيْلاً‏)‏ ‏[‏ النساء‏:‏ 51‏]‏‏.‏

‘যাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে, সেই লোকেদের প্রতি তুমি কি লক্ষ্য করনি, তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে, তারা মু’মিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে।’ -আন-নিসা ৪ : ৫১

মদিনায় প্রত্যাবর্তন এবং সতিসাধ্বী মুসলিম নারীদের চরিত্রহননঃ

কিছু দিন মক্কায় অবস্থান করে মক্কাবাসী কুরাইশ নেতৃবৃন্দের অন্তরে যুদ্ধের লেলিহান আগুনের শিখা প্রজ্বলিত করে দিয়ে, মদিনার মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে গমন করলে তাদেরকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করার আশ্বাস দিয়ে কা‘ব ফিরে এলেন মাদিনায়। কিন্তু মদিনায় ফিরে এসেও তিনি যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। ইসলাম ও মুসলিমদের তার কোনোভাবেই সহ্য হচ্ছিল না। এ পর্যায়ে নব উদ্যমে তিনি ভিন্ন এক ন্যাক্কারজনক কাজে হাত বাড়ালেন। সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুমগণের স্ত্রীদের ব্যাপারে বাজে কবিতা বলতে শুরু করলেন এবং কটুক্তির মাধ্যমে তাঁদেরকে ভীষণ কষ্ট দিতে থাকলেন।

আল্লাহর এই দুশমনকে হত্যার ঘটনাঃ

তার ধারাবাহিক এসব জঘন্য অপকর্ম, সতিসাধ্বী মুসলিম নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও কলঙ্ক রটানো, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে মক্কার কুরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে তাদেরকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে পরামর্শ প্রদানসহ সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলা এবং রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নানাবিধভাবে দুর্ব্যবহারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করায় এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

من لى بكعب إبن الأشرف فإنه قد أذى الله و رسوله

অর্থ: 'কে এমন আছে? যে কাব ইবনে আশরাফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে! কেননা সে আল্লাহ এবং তার রাসূলকে কষ্ট দিচ্ছে।'

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু, আব্বাদ বিন বিশর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু, হারিস বিন আউস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু, আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু যার আরেক নাম সিলকান বিন সালামাহ এবং যিনি ছিলেন কা’বের দুধ ভাই, তিনি এবং আবূ আবস বিন হিবর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এ অভিযানে পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে আসেন। ক্ষুদ্র এ বাহিনীর নেতা ছিলেন মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু। সূত্রঃ Click This Link

কা‘ব বিন আশরাফের হত্যার ব্যাপারে যেসব বর্ণনা রয়েছে তার সারমর্ম হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বললেন, ‘কা‘ব বিন আশরাফকে কে হত্যা করতে পারে? সে আল্লাহ এবং তার রাসূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিয়েছে।’

তখন মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু উঠে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি প্রস্তুত আছি। আমি তাকে হত্যা করব এটা কি আপনি চান?’

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ’।

তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দিচ্ছেন কি?’

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি বলতে পার।’

এরপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু কা‘ব ইবনু আশরাফের নিকট গমন করলেন এবং তাকে বললেন, ‘এ ব্যক্তি অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে সাদাকাহ চাচ্ছে এবং প্রকৃত কথা হচ্ছে সে আমাদেরকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

একথা শুনে কা‘ব বলল, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের আরো বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘আমরা যখন তার অনুসারী হয়েই গেছি তখন হঠাৎ করে এখনই তার সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত মনে করছি না। পরিণামে কী হয় দেখাই যাক। আচ্ছা, আমি আপনার কাছে এক অসাক বা দু’ অসাক (এক অসাক =১৫০ কেজি) খাদ্য শস্যের আবেদন করছি।’

কা‘ব বলল ‘আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘আপনি কী জিনিস বন্ধক রাখা পছন্দ করেন?’

কা‘ব উত্তর দিলো, ‘তোমাদের নারীদেরকে আমার নিকট বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘আপনি আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুদর্শন পুরুষ, সুতরাং, আমরা আমাদের নারীদেরকে কিরূপে আপনার নিকট বন্ধক রাখতে পারি?’

সে বলল, ‘তাহলে তোমাদের পুত্রদেরকে বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘আমরা আমাদের পুত্রদেরকে কী করে বন্ধক রাখতে পারি? এরূপ করলে তাদেরকে গালি দেয়া হবে যে, এক অসাক বা দু অসাক খাদ্যের বিনিময়ে তাদেরকে বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটা আমাদের জন্যে খুবই লজ্জার কথা হবে। আমরা অবশ্য আপনার কাছে অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।’

এরপর দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু অস্ত্র নিয়ে তার কাছে আসবেন। এদিকে আবূ নায়িলাও রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু অগ্রসর হলেন অর্থাৎ কা‘ব বিন আশরাফের কাছে আসলেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন দিকের কবিতা শোনা ও শোনানোর কাজ চললো। তারপর আবূ নায়িলা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘ভাই বিন আশরাফ! আমি এক প্রয়োজনে এসেছি। এটা আপনাকে আমি বলতি চাচ্ছি এই শর্তে যে, আপনি কারো কাছে এটা প্রকাশ করবেন না।’

কা‘ব বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাই করব।’

আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘এ ব্যক্তির অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর আগমন তো আমাদের জন্যে পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা আরব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের পথ ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবার পরিজন ধ্বংস হতে চলেছে। সন্তান-সন্ততির কষ্টে আমরা চৌচির হচ্ছি।’

এরপর তিনি ঐ ধরণেরই কিছু আলাপ আলোচনা করলেন, যেমনটা মুহাম্মাদ বিন মাসলামা করেছিলেন। কথোপকথনের সময় আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এ কথাও বলেছিলেন যে, আমার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব রয়েছে যাদের চিন্তাধারা ঠিক আমারই মত। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। আপনি তাদের হাতেও কিছু বিক্রি করুন এবং তাদের উপর অনুগ্রহ করুন।’

মুহাম্মাদ বিন মাসালামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু নিজ নিজ কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হন। কেননা, ঐ কথোপকথনের পরে অস্ত্রশস্ত্র বন্ধু বান্ধবসহ এ দুজনের আগমনের কারণে কা‘ব বিন আশরাফের সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা নয়।

জোছনাস্নাত রাতে কা'ব বিন আশরাফের পরকাল যাত্রাঃ

হিজরি ৩য় সনের রবিউল আওয়াল মাসের ১৪ তারিখ জোছনাস্নাত এক রাতে এ ক্ষুদ্র বাহিনী রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নিকট একত্রিত হন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকীয়ে গারকাদ অর্থাৎ, জান্নাতুল বাকী কবরস্থান পর্যন্ত তাঁদের অনুসরণ করেন। তারপর বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! এদেরকে সাহায্য করুন।’

তারপর তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপর বাড়িতে তিনি সালাত ও মুনাজাতে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

এদিকে এ বাহিনী কা‘ব বিন আশরাফের দুর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পর আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু উচ্চৈঃস্বরে ডাক দেন। ডাক শুনে কা‘ব তাদের নিকট আসার জন্যে ঘর হতে বের হতে উদ্ধত হলে তার স্ত্রী তাকে বললেন, ‘এ সময় কোথায় যাচ্ছেন? আমি এ ডাকের ভেতরে এমন শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যেন তা হতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।’

স্ত্রীর এ কথা শুনে কা‘ব বলল, ‘এটা তো আমার ভাই মুহাম্মাদ বিন মাসলামা এবং দুধ ভাই আবূ নায়িলাহ। সম্ভ্রান্ত লোককে যদি তরবারী যুদ্ধের দিকে আহবান করা হয় তবে সে ডাকেও সে সাড়া দেয়।’

এরপর তিনি বাইরে এলেন। তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছিল এবং তার মাথায় যেন খোশবুর ঢেউ খেলছিল।

আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সঙ্গীদেরকে বলে রেখেছিলেন যে, ‘যখন তিনি আসবেন তখন আমি তার চুল ধরে শুঁকবো। যখন তোমরা দেখবে যে, আমি তার মাথা ধরে তাকে ক্ষমতার মধ্যে পেয়ে গেছি তখন ঐ সুযোগে তোমরা তাকে হত্যা করবে।’

সুতরাং, যখন কা‘ব এলেন তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা ও গল্পগুজব চললো। তারপর আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘বিন আশরাফ! আজুয ঘাঁটি পর্যন্ত চলুন। সেখানে আজ রাতে কথাবার্তা বলাবলি হবে।

তিনি বললেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে চলো।’ তারপর তাদের সাথে তিনি চললেন।

পথিমধ্যে আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তাকে বললেন, ‘আজকের মতো এমন উত্তম সুগন্ধি আপনাকে ইতোপূর্বে ব্যবহার করতে দেখিনি।’

একথা শুনে কা'বের বক্ষ গর্বে ফুলে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমার পাশে আরবের সর্বাপেক্ষা অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী মহিলা রয়েছে।’

আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘আপনার মাথাটি একটু শুঁকবো, এ অনুমতি আছে কি?’

তিনি উত্তরে বললেন ‘হ্যা, হ্যাঁ’।

আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তখন কা‘বের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর তিনি নিজেও তার মাথা শুঁকলেন এবং সঙ্গীদেরকেও শুঁকালেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকতে পারি কি?’

কা‘ব উত্তর দিল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কোন আপত্তি নেই।’

আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু আবার শুঁকলেন। সুতরাং, তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন।

আরো কিছুদূর চলার পর আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু পুনরায় বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকবো কি?’

এবারও কা‘ব উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, শুঁকতে পারো।

এবার আবূ নায়িলাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তার মাথায় হাত রেখে ভালভাবে মাথা ধরে নিলেন এবং সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘আল্লাহর এ দুশমনকে হত্যা করে ফেল।’

ইতোমধ্যেই তার উপর কয়েকটি তরবারী পতিত হলো, কিন্তু কাজ হলো না। এ দেখে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু নিজের কোদাল ব্যবহার করে তার দুনিয়ার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিলেন। আক্রমণের সময় কা'ব এত জোরে চিৎকার করেছিলেন যে, চতুর্দিকে তার চিৎকারের শব্দ পৌঁছে গিয়েছিল এবং আশপাশে এমন কোন দূর্গ বাকী ছিল না যেখানে বিপদ সংকেত স্বরূপ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়নি। কিন্তু এতদসত্বেও মুসলিমদের ক্ষুদ্র এ বাহিনী কোনোরূপ বাধার সম্মুখিন না হয়ে সফলতার সাথে অভিযান সমাপ্ত করে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন।

কা’ব বিন আশরাফের দুর্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘর, ছবিঃ Click This Link থেকে সংগৃহীত।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘আফলাহাতিল উজূহু’

কা‘বকে আক্রমণ করার সময় হারিস ইবনু আউস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে তাঁর কোন এক সাথীর তরবারীর কোণার আঘাত লেগেছিল। ফলে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর দেহ হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। কা‘বকে হত্যা করে ফেরার সময় যখন এ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী হররায়ে আরীয নামক স্থানে পৌঁছেন তখন দেখেন যে, হারিস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু অনুপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং, তারা সেখানে থেমে যান। অল্পক্ষণ পরে হারিস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুও সঙ্গীদের পদচিহ্ণ ধরে সেখানে পৌঁছে যান। সেখান হতে তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে নেন এবং বাকীয়ে গারকাদে পৌঁছে এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি দেন যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও তা শুনতে পান। তিনি বুঝে নেন যে, কা‘ব নিহত হয়েছে। সুতরাং, তিনিও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তারপর যখন এ মুসলিম বাহিনী তাঁর খিদমতে উপস্থিত হন তখন তিনি বলেন, ‘আফলাহাতিল উজূহু’ অর্থাৎ এ চেহারাগুলো সফল থাকুক।

তখন তারা বললেন, ‘অ অজুহুকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার চোহরাও সফলতা লাভ করুক। আর সাথে সাথেই তাঁরা তাগূতের (কা‘বের) কর্তিত মস্তক তাঁর সামনে রেখে দেন। তিনি তখন আল্লাহ পাকের প্রশংসা করেন এবং হারিস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু -এর ক্ষত স্থানে স্বীয় পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরোগ্য লাভ করেন এবং পরে আর কখনো তিনি কষ্ট অনুভব করেন নি। -এ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫১-৫৭ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৪১-৪২৫ পৃঃ, ২য় খন্ড ৫৭৭ পৃঃ, সুনানে আবূ দাউদ আউনুল মা’বূদ সহ দ্রষ্টব্য ২য় খন্ড ৪২-৪৩ পৃঃ এবং যা’দুল মাআ’দ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ, এ সব হাদীস গ্রন্থ হতে গৃহীত হয়েছে।

কা'ব হত্যার ফলাফলঃ

এদিকে ইহুদীরা যখন কা‘ব বিন আশরাফের হত্যার খবর জানতে পারে তখন তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি ও ত্রাসের ঢেউ খেলে যায়। তারা বুঝতে পারে যে, রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অনুধাবন করবেন যে, শান্তি বিনষ্টকারী, গন্ডগোল ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এবং প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কোন ফল হচ্ছে না, তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এ জন্যেই তারা এই বিশ্বাসঘাতককে হত্যার প্রতিবাদে কোন কিছু করার সাহস করেননি, যদিও তাদের এ যুগের উত্তরসূরীদের কেউ কেউ আগপাছ না ভেবে ইতিহাসের সত্যকে ঢেকে রেখে হাহাকার রব তুলে শোরগোল করতে চান মাঝে মাঝেই, বস্তুতঃ কা'বের খুনের ঘটনার পরে মদিনা এবং আশপাশ অঞ্চলের বাদবাকি ইহুদিদের মধ্যে যারা তার পথে হাটছিলেন, তাকে অনুসরণ করছিলেন তারাও একে একে সকলে মুনাফিকির এই পথ থেকে ফিরে আসেন। তারা অঙ্গীকার পূরণের স্বীকৃতি দান করেন এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণের দুঃসাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেন।

এভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের দুশমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এবং রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দুশমন দুর্বৃত্ত কা'ব বিন আশরাফকে উচিত শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের সম্ভাবনা বিদূরিত করতে সক্ষম হলেন। এর ফলে মুসলিমরা মদিনার অভ্যন্তরীণ গোলযোগ হতেও সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন; যে গোলযোগের শঙ্কা বহু দিন থেকে তাঁদেরকে চিন্তিত, শঙ্কিত ও উদ্বেগাকুল করে রেখেছিল এবং যার নেতৃত্বে ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত দুর্বৃত্ত কা'ব বিন আশরাফ।

কা'ব বিন আশরাফের দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, ছবিঃ Click This Link থেকে সংগৃহীত।

নিবন্ধটি প্রণয়নে প্রয়োজনীয় তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে হাদিস এবং সীরাতের নির্ভরযোগ্য যেসব কিতাব ও সূত্র থেকেঃ

০১। সহীহ বুখারী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৪১, ৪২৫,
০২। সহীহ বুখারী ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৭,
০৩। সুনানে আবূ দাউদ ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪২, ৪৩,
০৪। যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৯১,
০৫। সিরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১, ৫৭।
০৬। আর রাহীকুল মাখতুম (বঙ্গানুবাদ), মূলঃ আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরি, অনুবাদকঃ খাদিজা আকতার রেজায়ী, আল কোরআন একাডেমি লন্ডন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ২৪৮ - ২৫১
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২৭
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×