মদ নিষিদ্ধকরণে পর্যায়ক্রমিক নীতি: হিকমতপূর্ণ পদ্ধতির কারণেই ইসলাম মানুষের স্বভাবধর্ম
হিকমতপূর্ণ পদ্ধতির কারণে ইসলাম মানুষের স্বভাবধর্ম। নেশার প্রতি ঝুকে থাকা সে কালে অনেক সংখ্যক মানুষের স্বভাবগত বদভ্যাসে পরিনত হয়েছিল। তৎকালীন সমাজের মানুষের এই স্বভাব বুঝে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা একই সাথে না করে পর্যায়ক্রমে মদকে নিষিদ্ধ করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি ক্লিয়ার হতে পারে, শিশুকে বুকের দুধ ছাড়াতে মা যেমন ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেন, নানান বাহানায় শিশুকে দুধ পান থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা গ্রহন করেন, সর্বাধিক দয়ার আধার মহান পালনকর্তা আল্লাহ রব্বুল আলামীন তেমনি বান্দাকে মদের কঠিন নেশা ছাড়াতে ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেছেন। এর একটি কারণ এই হতে পারে যে, সে সময় আরবরা ছিল ভীষণনভাবে মদে অভ্যস্ত। শুধু আরব নয়, পৃথিবীর অন্যান্যাঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও তখন মদের ব্যাপকতা ছিল ভয়াবহ।
মদ্যপান ছিল সে যুগে আভিজাত্যের প্রতীক। আরব-আজম সর্বত্র ছিল এর ব্যাপক প্রচলন। তাই ইসলাম প্রথমে তার অনুসারীদের মানসিকতা তৈরী করে নিয়েছে। তারপর চূড়ান্তভাবে একে নিষিদ্ধ করেছে। আর এর ফলশ্রুতিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তখন তা বাস্তবায়িত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এজন্য কোন জোর জবরদস্তি কিংবা বলপ্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিংবা প্রয়োজন হয়নি প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপের।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মাদককে চারটি পর্যায়ে হারাম করেছেন। যেমন-
প্রথম পর্যায়:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন যে, তোমরা খেজুর ও আঙ্গুর দ্বারা মাদক তৈরির পাশাপাশি উত্তম খাদ্য বস্তুও তৈরি করে থাক। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا
আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। -সূরা নাহল, আয়াত: ৬৭
এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সরাসরি মাদক হারাম করেননি, তবে জানিয়ে দিলেন, মাদক ভিন্ন জিনিস। আর উত্তম খাদ্যবস্তু ভিন্ন জিনিস। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম ধারণা করে নিলেন যে, মাদক সম্পর্কে কোনো বিধান আল্লাহ তাআলা অচিরেই নাজিল করবেন।
দ্বিতীয় পর্যায়:
এরপর সাহাবায়ে কেরাম যখন মাদক সম্পর্কে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেন তখন আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিলেন যে, মদের মাঝে উপকার ক্ষতি উভয়ই রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণটা বেশি। কুরআনে এসেছে,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا
তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়। -সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৯
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে মাদকের প্রতি কিছুটা ঘৃণার সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল ক্ষতির দিক বিবেচনায় তা বর্জন করলেন। আরেকদল চিন্তা করলেন, যেহেতু কিছুটা উপকার রয়েছে তাই তা গ্রহণে কোনো সমস্যা হবে না।
তৃতীয় পর্যায়:
এ পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছেও যাওয়া যাবে না। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى
হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না। -সূরা নিসা, আয়াত: ৪৩
এই আয়াত নাজিলের পর আরো কিছু সাহাবী মদকে বর্জন করলেন। তবে মদ সরাসরি হারাম না করার কারণে অল্প কিছু সংখ্যক সাহাবী তখনো নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় মদ পান করতেন।
চতুর্থ পর্যায়:
পরিশেষে আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে মদকে চূড়ান্তভাবে হারাম করে দিলেন। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। -সূরা মায়েদা, আয়াত: ৯০
একই সূরার পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শুত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখন ও কি নিবৃত্ত হবে? -সূরা মায়েদা, আয়াত: ৯১
বস্তুতঃ মদ নিষিদ্ধের জন্য পরপর উপরোল্লিখিত চারটি আয়াত নাযিল হয়। সূরা নাহল, আয়াত: ৬৭, বাক্বারাহ ২১৯, নিসা ৪৩ ও সবশেষে মায়েদাহ ৯০-৯১। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, উপরোক্ত প্রতিটি আয়াত নাযিলের মধ্যে নাতিদীর্ঘ বিরতি ছিল এবং মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের অবকাশ ছিল। প্রতিটি আয়াতই একেকটি ঘটনা উপলক্ষে নাযিল হয়। যাতে মানুষ নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাকে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারে। আর হয়েছেও সেটাই। চূড়ান্ত নির্দেশ আসার পূর্বেই পর্যায়ক্রমিক চমকপ্রদ পদ্ধতি থেকে দেখে শিখে এমনিতেই মদ ছেড়ে দেন। বাদ বাকি যারা ছাড়েননি তারাও চতুর্থ পর্যায়ে যখন স্পষ্টভাবে মদের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় তখন তারাও সতস্ফুর্তভাবে মদ ছেড়ে দেন। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
* حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحِيمِ أَبُو يَحْيَى، أَخْبَرَنَا عَفَّانُ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، حَدَّثَنَا ثَابِتٌ، عَنْ أَنَسٍ ـ رضى الله عنه ـ كُنْتُ سَاقِيَ الْقَوْمِ فِي مَنْزِلِ أَبِي طَلْحَةَ، وَكَانَ خَمْرُهُمْ يَوْمَئِذٍ الْفَضِيخَ، فَأَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مُنَادِيًا يُنَادِي " أَلاَ إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ ". قَالَ فَقَالَ لِي أَبُو طَلْحَةَ اخْرُجْ فَأَهْرِقْهَا، فَخَرَجْتُ فَهَرَقْتُهَا، فَجَرَتْ فِي سِكَكِ الْمَدِينَةِ فَقَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ قَدْ قُتِلَ قَوْمٌ وَهْىَ فِي بُطُونِهِمْ. فَأَنْزَلَ اللَّهُ {لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا} الآيَةَ.
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি আবূ তালহার বাড়িতে লোকজনকে শরাব পান করাচ্ছিলাম। সে সময় লোকেরা ফাযীখ শরাব ব্যবহার করতেন। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে আদেশ করলেন, যেন সে এই মর্মে ঘোষনা দেয় যে, সাবধান! শরাব এখন হতে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আবূ তালহা (রাঃ) আমাকে বললেন, বাহিরে যাও এবং সমস্ত শরাব ঢেলে দাও। আমি বাইরে গেলাম এবং সমস্ত শরাব রাস্তায় ঢেলে দিলাম। আনাস (রাঃ) বলেন, সে দিন মদীনার অলিগলিতে শরাবের প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। তখন কেউ কেউ বলল, একদল লোক নিহত হয়েছে, তথচ যাদের পেটে শরাব ছিল। তখন এই আয়াত নাযিল হল :
لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوا وَّآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوا وَّآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوا وَّأَحْسَنُوا ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা পূর্বে যা কিছু পানাহার করেছে তার জন্য তাদের কোন গুনাহ হবে না। -আল-মা-য়িদাহ ৯৩
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৪৬৪ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ১১:৪০