ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে দাফনকালীন প্রচলিত ঘটনাটির সত্যতা কতটুকু...
একটা ঘটনা অনেককে বলতে শোনা যায় যে, হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে দাফন করার সময় নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় সাহাবি হযরত আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু সদ্য খননকৃত কবরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, হে কবর! তুমি কি জানো, তোমার উদরে কাকে রাখা হচ্ছে? ইনি হচ্ছেন জান্নাতের নারীদের সর্দারনি মা ফাতিমাতুজ্জাহরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা।
নিরব নিস্তব্ধ চিরচেনা মাটির ঘর। মানুষের শেষ ঠিকানা। কবর কোনো কথা বলে না।
আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু পুনরায় কবরকে সম্বোধন করে বললেন, হে কবর! তুমি কি জানো, তোমার উদরে কাকে রেখে যাচ্ছি? ইনি হচ্ছেন খলিফাতুল মুমিনীন আলী কাররামাল্লাহু অযহাহু রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর স্ত্রী এবং জান্নাতের যুবকদের সর্দার হাসান হুসাইন রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমার গর্ভধারিণী মা ফাতিমাতুজ্জাহরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা।
নিরবতার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় সাহাবির এই কথাগুলোও। এবারও কোনো কথা বলে না কবর।
আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু পুনর্বার কবরকে ডেকে বললেন, হে কবর! তুমি কি জানো, তোমার পেটে কাকে রেখে যাচ্ছি? ইনি হচ্ছেন সাইয়্যিদুল মুরছালীন রহমাতুল্লিল আলামীন প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কলিজার টুকরা নয়নের মনি প্রিয়তম কন্যা মা ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা। সাবধান! কবর, তুমি তার সাথে উত্তম আচরণ করবে।
এ কথা বলার সাথে সাথে...। নিরবতার দেয়াল ভেঙ্গে কথা বলে উঠলো মাটি! কবরের মাটি!
কবর থেকে আওয়াজ এল, আমি জান্নাতের নারীদের সর্দারনিকে চিনি না, আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর স্ত্রী কিংবা হাসান হুসাইন রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমার গর্ভধারিণীকে চিনি না, রহমাতুল্লিল আলামীনের কন্যাকেও চিনি না। আমি প্রত্যেকের সাথে তার আমল অনুযায়ী আচরণ করি। আমল যদি ভালো হয় তার সাথে অবশ্যই আমার উত্তম আচরণ হবে। আর আমল যদি খারাপ হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে আমার কঠোর এবং নিকৃষ্ট আচরণে ক্ষত বিক্ষত হবে।
ঘটনাটি বেশ মজার। শ্রুতি মধুরও। বিশ্বাস করার মত। সমাজে বেশ প্রচলিত। এ ঘটনা শুনে চোখের পানিও ফেলতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এটি আদৌ সত্য নয়। স্রেফ লোকমুখে প্রচলিত বানানো একটি ঘটনা এটি। হাদীস-আছার ও নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থে এ ঘটনার কোনো অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং, দলিল-প্রমাণহীন এ কথাগুলো বর্ণনা করা জায়েয হবে না। এ থেকে বিরত থাকা জরুরি।
উল্লেখ্য, আখেরাতের হিসাব-কিতাবের বিষয়টি যে ঈমান ও আমলের ভিত্তিতেই হবে তা দ্বীনের একটি সর্বজনবিদিত শিক্ষা, যা মুসলমান মাত্রেরই জানা রয়েছে। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম কবরকে সম্বোধন করে উপরোক্ত কথা বলতে পারেন এই কল্পনাও মূর্খতা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায়ই প্রিয়তম কন্যা ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে বলে গেছেন, হে ফাতিমা! জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কেননা, আমি উপকার-অপকারের মালিক নই। -সহীহ মুসলিম ২/১১৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩১৮৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই সুস্পষ্ট শিক্ষার পরেও সাহাবীগণ কবরকে লক্ষ্য করে উপরোক্ত কথা কীভাবে বলতে পারেন? সঙ্গত কারণে খুব সহজেই বুঝা সম্ভব যে, এটি মুখরোচক এবং হৃদয়াগ্রাহী ভঙ্গিতে বানানো একটি কাহিনী মাত্র।
কবর, হাশর এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবন অর্থাৎ, আখেরাতের ওয়াজ করার জন্য যথেষ্ট পরিমানে দলিল প্রমান আমাদের সামনে বিদ্যমান।
কবরের আযাব বিষয়ে কুরআন এবং হাদিসের ভাষ্যঃ
কবরের আযাব সত্য। এ বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। কবরের জীবনকে বলা হয়, বরজখি জীবন। আর বরজখ হচ্ছে দুই জীবন- অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টিকারী। মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে বরজখ বলে। এই বরজখের জীবন প্রত্যেককেই অতিবাহিত করতে হবে, চাই মৃতদেহ দাফন করা হোক, ভস্মিভূত করা হোক, পানিতে ডুবে যাক, কোনো প্রাণী মৃতদেহ খেয়ে ফেলুক অথবা অন্য কোনোভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।
কোনো ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন সে বরজখে প্রবেশ করে এবং পুনরুত্থান পর্যন্ত সেখানে তাকে থাকতে হবে। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘এর পর যখন তাদের কারো মৃত্যু আসবে, তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে ফিরিয়ে দাও। যাতে আমি যেগুলো রেখে এসেছি, সেগুলোর ব্যাপারে নেক আমল করতে পারি। কখনো নয়। এটি একটি কথার কথা, সে তা বলবে। আর মানুষের পশ্চাতে রয়েছে বরজখ—পুনরুত্থান পর্যন্ত।’ -সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৯৯-১০০
কবরের আজাব অনিবার্য সত্যঃ
আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন-‘তাদের সকাল-সন্ধ্যা জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হয়। যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন বলা হবে, তোমরা ফেরাউনের সম্প্রদায়কে কঠিন শাস্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দাও।’ -সুরা : মুমিন (গাফির), আয়াত : ৪৬
অর্থাৎ কবরে থাকাকালীন প্রতিদিনই সকাল-বিকাল তাদের জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হয়। এরপর যখন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, তখন তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘অচিরেই আমি (আল্লাহ) তাদের দুইবার আজাব দেব। তারপর তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ভয়াবহ আজাবের দিকে।’ -সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০১
এক হাদিস থেকে কবরের আজাব সম্পর্কে জানা যায়, বর্ণিত হয়েছে, ‘কাফের ও মুনাফেককে যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বলা হবে যে এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী জানো? সে বলবে, আমি জানি না। লোকজন যা বলে থাকে, আমিও তা-ই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি উপলব্ধি করোনি, পাঠও করোনি। এরপর তাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হবে। তখন সে বিকট শব্দে চিৎকার করবে, যা মানব-দানব ছাড়া আশপাশের সব কিছু শুনতে পাবে।’ -বুখারি, হাদিস : ১৩৩৮
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন, ‘যদি এই ভয় না থাকত যে তোমরা মৃতকে দাফন করবে না, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, যাতে তিনি কবরের যে আজাব আমি শুনতে পাই, তা যেন তোমাদের শুনিয়ে দেন।’ -মুসলিম, হাদিস : ৭৩৯২
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই এ দোয়া করতেন—‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাই।’ -বুখারি, হাদিস : ২৮২২
এসব হাদিস থেকে কবরের আজাবের সত্যতা প্রমাণিত হয়।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, কবরের আজাব ও সেখানকার সুখ সম্পর্কে হাদিসগুলো মুতাওয়াতির। আমার কাছে এ বিষয়ে ৫০-এর অধিক হাদিস রয়েছে। এক হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেন, এই কবর দুটিতে আজাব হচ্ছে। বড় কোনো পাপের কারণে তাদের শাস্তি হচ্ছে না। একজন তো প্রস্রাব থেকে নিজেকে বাঁচাত না। আর অন্যজন চোগলখুরি করে বেড়াত।’ -বুখারি ও মুসলিম
তাই কোরআন ও হাদিসের আলোকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা খুবই সহজ যে পাপীদের জন্য কবর তথা বরজখি জীবন থেকে আজাব শুরু হয়ে যায়, যেভাবে নেককারদের জন্য কবর তথা বরজখি জীবন থেকে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত প্রদান করা হয়।
নসিহত হতে হবে প্রমানভিত্তিকঃ
অতএব, কুরআনুল কারিম এবং সহিহ হাদিসের আলোকে সঠিক প্রমানাদি দ্বারা নসিহতমূলক কথা মানুষকে শোনাতে হবে। বানোয়াট মুখরোচক এমন আকর্ষনীয় মিথ্যে এবং অস্তিত্বহীন ঘটনার অবতারণা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এতে বরং সাওয়াবের পরিবর্তে গোনাহে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ ধরণের প্রতিটি দলিলবিহীন কথা থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন, হোক তা যতই আকর্ষনীয় এবং চিত্তাকর্ষক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের প্রতিটি বিষয়ের সত্য এবং সঠিকতা অনুধাবন ও উপলব্ধি করে তার উপরে অটল এবং অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২১ দুপুর ২:১২