রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের কান্না : আরেকজন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর আগমনের প্রতীক্ষায়....
ফিলিস্তিন! হায়রে ফিলিস্তিন! আমাদের প্রথম কিবলা খ্যাত বাইতুল মুকাদ্দাসকে বুকে ধারণ করা পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন! অসংখ্য নবী-রাসুলের পদধূলিধন্য পুণ্যভূমি ফিলিস্তিন! রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ফিলিস্তিন! হারামাইন শরিফাইন তথা, মক্কাতুল মুকাররমাহ এবং মদিনাতুল মুনাওওয়ারাহ এর পরেই যার শ্রেষ্ঠত্ব! বাইতুল মুকাদ্দাস- যেখানে ১ রাকাআত নামাজ পড়লে ২৫০ মতান্তরে ৫০০ রাকাআতের সওয়াব পাওয়া যায়।
আল আকসা মসজিদের গুরুত্বের কারণঃ
হিজরত পরবর্তী ১৬ কিংবা ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানরা আল আকসা মসজিদের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতেন। পরবর্তীতে মহান আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানদের কেবলা মক্কার দিকে পরিবর্তিত হয়।
রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদুন্নবী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি।
বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবী রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত। এ পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয় বরং এ নাম সব মুসলমানের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের কবর এবং মাজার।
রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐতিহাসিক মেরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা এ বায়তুল মুকাদ্দাসেই প্রথম সফর করেন। কুরআনুল কারিমে সূরা বনি-ইসরাইলে এসেছে
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ -সূরা ইসরা, আয়াত ০১
মেরাজের রাতে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পবিত্র মসজিদে ইমামতি করেন। তার পেছনে অসংখ্য ফেরেশতা ও নবী-রাসুল নামাজ পড়েছিলেন। যে কারণে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ অর্থাৎ, সব নবীর ইমাম ও ‘সায়্যিদুল মুরসালিন’ অর্থাৎ, সব রাসুলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। এই মসজিদ থেকেই বোরাকে আরোহন করে সাত আসমান পেরিয়ে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার সাথে দিদারে মিলিত হতে মিরাজ বা উর্ধ্বভ্রমনে গমন করেন।
ইউনেস্কোর ঘোষনা: আল আকসা মুসলমানদেরঃ
ফিলিস্তিনের আল আকসাকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান বলে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর পাসকৃত ইউনেস্কোর এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের ওপর ইসরাইলের কোনো অধিকার নেই, আল আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান।
মসজিদুল আকসা: পেছনের কথা, ইতিহাসের কিছু কথাঃ
মসজিদুল আকসা বহুকাল ধরে ছিল ইসলামের প্রাণকেন্দ্ররূপে পরিগণিত। হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর খেলাফতের সময় ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন পুরোপুরি মুসলমানদের দখলে আসে। কালের পরিক্রমায় ১০৯৯ সালের ৭ জুন খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে।
সে সময় ১০ হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছিল তারাঃ
১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা পুরো সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেদিন মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল-আকসার ভেতর ও বাহিরের প্রাঙ্গন। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে তারা হত্যা করে। এরপর ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে একটি প্রাসাদে পরিণত করে এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
আল-আকসা দখলের পর মুসলমানদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালাতে থাকে খ্রিস্টানরা। যেমনটা এখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। এমন কঠিন মুহূর্তে মুসলমানদের প্রয়োজন ছিল একজন মুক্তিদূতের। যিনি ইসলামের পবিত্রভূমিকে আবার মুসলমানদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন।
মনে পড়ে গুণী সেই কাঠমিস্ত্রীর কথাঃ
সেই সময় বাগদাদ শহরে এক কাঠমিস্ত্রি থাকতেন। তিনি খুব সুন্দর করে একটি মিম্বার বানালেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সবাই মিম্বারটি দেখার জন্য ছুটে আসত। অনেকে কিনতে চাইতো, কিন্তু কাঠমিস্ত্রির ইচ্ছা ছিল এটা মসজিদুল আকসার জন্য রেখে দেবে। যেদিন মসজিদুল আকসা পুনরায় মুসলমানদের দখলে আসবে সেদিন তার বানানো এই মিম্বারটি মসজিদুল আকসায় দেবেন।
অবশেষে তিনি এলেন, দেখলেন মিম্বারটি এবং সংকল্প করলেনঃ
একদিন কঁচি বয়সের ছোট এক ছেলে তার বাবার সাথে সেই মিম্বারটি দেখতে আসে। তখন ছেলেটি কাঠমিস্ত্রির কথা শুনলেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন একদিন কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন তিনি পূরণ করবেন। প্রিয় পাঠক, জানেন কি, কে ছিলেন এই সাহসী শিশুটি? তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি; যার নেতৃত্বে ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জেরুজালেমসহ সমগ্র ফিলিস্তিন মুসলমানদের দখলে আসে।
চলতে থাকে একের পর এক বিজয়াভিযানঃ
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে মিসর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান সালাহউদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলাইহি জেরুজালেম রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগনান ও তৃতীয় রেমন্ডের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে সালাহউদ্দিনের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে খ্রিস্টান ক্রুসেডার সেনাবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অবশেষে ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর বিজয়ীরবেশে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন।
হজযাত্রীদের ওপর হামলা ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করতো দুষ্ট ইহুদিরাঃ
মসজিদুল আকসা অভিযানের পেছনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। তা হলো, ফিলিস্তিনের হজযাত্রীদের চলাচলের পথ নিরাপদ করা। মুসলমানরা বায়তুল মোকাদ্দাসের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর ১১৮৭ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডার কর্তৃক একদল হজযাত্রীর ওপর হামলা ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে।
আক্রান্ত মুসলিমরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে এই পথের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি লেখেন। অন্যদিকে বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসক বেলিয়ান ডিইবিলিন বায়তুল মোকাদ্দাসে অবস্থানরত মুসলিমদের হত্যা করার হুমকি দেন। মুসলিম হজযাত্রীদের আবেদন এবং খ্রিস্টান শাসকের হুমকির কয়েক মাসের মধ্যে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই অভিযান পরিচালনা করেন এবং হাতিনের যুদ্ধে বায়তুল মোকাদ্দাসের জয় নিশ্চিত করেন। তবে বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের পর তিনি রক্তপাত এড়িয়ে যান। মুসলিম ও অমুসলিমদের সব অধিবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
বাইতুল মুকাদ্দাসের পরবর্তী সময়ের ইতিহাসঃ
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইনতিকালের পরে বাইতুল মোকাদ্দাস আবারও মুসলিমদের হাতছাড়া হয়। তবে ১১ বছর পরে সুলতান নাজমুদ্দিন আইয়ুব ১২৪৪ সালে তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। ১২৪৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলিম শাসকদের অধীনেই ছিল। ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে। ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস নামক এলাকায় তখন ইহুদিরা কৃষিকাজ করতো। ফিলিস্তিনি আরবদের পাশেই ছিল ইহুদিদের বসবাস।
সে সময় মুসলমান এবং ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৩০’র দশকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারলো যে তারা ধীরে ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে। ইতোমধ্যে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে।
তখন ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফিলিস্তিনি আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া হিসেবে পরিচিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম যেভাবেঃ
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। ফিলিস্তিনিরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়।
কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস করতে থাকে। এরপর ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। তাদের গোপন অস্ত্র কারখানাও ছিল। ইহুদিদের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের কোনো নেতৃত্ব ছিল না। ইহুদিরা বুঝতে পেরেছিল যে, নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা তাদের ছেড়ে কথা বলবে না।
সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদিরা। ইহুদিদের আক্রমণে বহু ফিলিস্তিনি আরব তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইহুদি সশস্ত্র বাহিনীর নৃশংসতা আরবদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র দলগুলো ইহুদিদের ওপর কয়েকটি আক্রমণ চালালেও ইহুদিদের জোরালো হামলার মুখে ভেঙে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনিরা।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে, সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। এভাবেই ১৯৪৮ সালে বিশ্ব মোড়লদের চক্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের বিশফোঁড়া অভিশপ্ত ইসরায়েল নামক ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর চলতে থাকে নির্যাতন-নিপীড়ন।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে ‘মসজিদে আকসা’ জোরপূর্বক দখল করে নেয়। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিজয় করা মসজিদুল আকসা হাতছাড়া হয়। এরপর থেকে সেখানকার মুসলিম জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জায়ানবাদী ইসরায়েল একের পর এক মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকা জোরপূর্বক দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে।
মুসলিমরা নিয়তই নির্যাতিতঃ
বর্তমানে মসজিদুল আকসা ও জেরুজালেম নগরী দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে নিচ্ছে। এমনকি মসজিদুল আকসায় শুধু ইসরায়েলের মুসলিম বাসিন্দা ও ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। তাও অনেক বিধিনিষেধের মাধ্যমে। রমজান এলেই যেন ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসী ইহুদিরা বর্বরোচিত হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
মুসলিমদের প্রতিবাদকে বলা হয় 'উগ্রবাদ' এবং 'সন্ত্রাস'ঃ
জায়নবাদী সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের পবিত্রভূমিতে আগুন দেবে। কিন্তু ফিলিস্তিনরা তার প্রতিবাদ করলে নাম দেবে ‘সন্ত্রাস’। শুধু এই কয়েক দিনে গাজায় নিহত হয়েছে ৫২ জন শিশুসহ ১৮১ জন ফিলিস্তিনি। নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ হত্যার জবাবে গাজা থেকে রকেট ছোড়া হলে শহরটার ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ করে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার বলে চালিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে থামছে না ইহুদিদের অবৈধ বসতি স্থাপনঃ
ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে দিনকে দিন। তাদের মূল লক্ষ্য জেরুজালেম থেকে সব ফিলিস্তিনিকে তাড়িয়ে দেয়া। ফিলিস্তিনের বৈধ রাজধানীকে নিজেদের রাজধানী বলে ঘোষণা করা। হয়তো নিজ চোখে না দেখলে কেউ কখনো বিশ্বাস করবে না কী পরিমাণ দমন-পীড়নের মাঝে ফিলিস্তিনিদের রাখা হয় নিজ ভূমিতে!
চলছে নারকীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসঃ
ইসরায়েল সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিরামহীনভাবে চলছে সেই হামলা নির্যাতন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে তার ঘরবাড়ি উড়িয়ে দিচ্ছে। কারও ভিটেমাটি কারও ফসলের জমি কেড়ে নিচ্ছে। যে কজন নিজেদের ভিটেমাটিতে বাস করছেন তাদের বসতবাড়ির চারদিকে বিশাল উঁচু দেয়াল তৈরি করে সেগুলোকে এক রকম বন্দিশালায় পরিণত করে রেখেছে।
আরবদের নৈতিক অধঃপতন ফিলিস্তিন সংকটকে দীর্ঘায়িত করছেঃ
আরব দেশগুলোর মাঝে অনৈক্যের কারণে ইহুদিদের হাতে বারবার মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। আরব বন্ধুত্ব ও মেহমানদারির কথা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের অনেকের বিশ্বাসঘাতক চরিত্র। একের পর এক আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে ফিলিস্তিনের সঙ্গে বেইমানি করছে। হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের আর বাড়াচ্ছে অনৈক্য।
ওআইসি না কি, ‘ওহ আই সি’?
মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ওআইসি বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে এসব ক্ষে্ত্রে ভূমিকা রাখতে। যার ফলে একটি নামসর্বস্ব সংগঠনে পরিণত হয়েছে। অনেকে মজা করে বলে থাকেন- ‘ওহ আই সি’ মানে, আমি দেখছি। তাদের দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। যে ওআইসির জন্মই হয়েছিল মসজিদে আকসা এবং ফিলিস্তিনের জন্য সেই প্রতিষ্ঠানটি গত ৫২ বছরে ফিলিস্তিনের জন্য কিছুই করতে পারলো না। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের আটটি দেশ নিয়ে ডি-এইট নামক সংস্থাটিরও একই অবস্থা। শুধু কিছু মিটিং আর বিবৃতিতে দায় শেষ।
এবারের ইসরায়েলের হামলায় নিহতের সংখ্যাঃ
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাজায় রক্তক্ষয়ী হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২১৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন নারী ও শিশু। হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার ফিলিস্তিনি।
হামলার জবাবে গাজা থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট ছুড়ছে হামাস। ইসরায়েলের ভাষ্য, চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে দুটি শিশু।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা আর আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করা একই কথাঃ
কারণ, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানে বড় বড় পারমাণবিক অস্ত্রধারী আমেরিকা এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে সরাসরি বিবৃতি দিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, 'ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের প্রতি তার (বাইডেন) একনিষ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে। শুধু তুরস্ক আর ইরান চাইলেই ইসরায়েলকে উৎখাত করা সম্ভব নয়।'
বিশ্ব মোড়লদের নির্লজ্জ সমর্থন, অব্যাহত আস্কারা এবং নিরন্তর সহযোগিতা ইসরায়েলকে দিনকে দিন গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধী, ইসরায়েলের খুনি, জাতীয় নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরেও ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা অবৈধ প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু ১৯ মে ২০২১ তার সর্বশেষ অভিব্যক্তিতে জানিয়েছেন যে, ‘ইসরায়েলের নাগরিক, আপনাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত এ অভিযান চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি সংকল্পবদ্ধ।’
যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়লেও ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার নেতানিয়াহুকে ফোন করে সহিংসতা কমানোর কথা বলার কিছুক্ষণ পরই এক ভিডিও বার্তায় তাঁর এ ঘোষণা আসে বলে বিবিসি জানিয়েছে।
টুইটারে পোস্ট করা ভিডিও বার্তায় নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ফোন কলের কথা উল্লেখ করেননি। তবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে বলায় জো বাইডেনের প্রশংসা করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
মুক্তির পথ কি?
অবস্থা দৃষ্টে ফিলিস্তিন সংকটের আশু সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের ততোধিক অবৈধ প্রেসিডেন্ট, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অপরাধী নেতানিয়াহু তার ক্ষমতার মসনদকে জায়েজ করতে নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের পাখির মত হত্যার টার্গেটে পরিণত করে এগিয়ে চলেছেন। তিনি জানেন, তার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক এবং বৈধ কোনো পথ খোলা নেই, সুতরাং, ফিলিস্তিনিদের উপরে জ্বালাও পোড়াও নীতির অগ্নি খেলই একমাত্র তার রক্ষাকবচ হতে পারে এই মুহূর্তে। শত্রু দমনের নামে ফিলিস্তিনিদের উপরে পাইকারি নিধনযজ্ঞ চালিয়ে ইসরায়েলীদের নজর অন্য দিকে ফেরানোর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র এইসময়ে নেতানিয়াহুর হাতে দ্বিতীয়টি আর নেই।
জাতিসংঘ আজ ঠুটো জগন্নাথের ভূমিকায় অবতীর্ণ। নির্মম তামাশায় লিপ্ত। নিরব দর্শকের সারিতে বসে ফিলিস্তিনিদের রক্ত পরখ করে চলেছে। ফিলিস্তিনিদের রক্তের বর্ণ নির্বাচন করে চলেছে। তাদের শিশুদের সারি সারি মৃত দেহ গণনায় মহা ব্যস্ত। তাদের নারীদের, তাদের মায়েদের, তাদের বৃদ্ধদের লাশের পরিসংখ্যান নিয়ে গলদঘর্ম। ইসরায়েলের মুখের উপরে কিছু বলতে নারাজ। কারণ, বিশ্ববাসীর নিকট আজ এ কথা দিবালোকের মত পরিষ্কার যে, জাতিসংঘ মানেই আমেরিকার স্বার্থরক্ষা। জাতিসংঘ মানেই ইঙ্গ মার্কিনিদের অন্যায় অপরাধকে বৈধতা দেয়ার হাতিয়ার। জাতিসংঘ মানেই আমেরিকা এবং তার বশংবদদের হাতের ক্রিড়নক।
সুতরাং, ফিলিস্তিনিদের বাঁচার পথ কি? তাদের উদ্ধারের রাস্তা কি? তাদের মুক্তির উপায় কি?
ফিলিস্তিনিদের বাঁচার একটিমাত্র উপায় রয়েছে। একটি্মাত্র পথ খোলা রয়েছে তাদের সামনে। আর তা হচ্ছে, নতুন করে আবার একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর আগমন; যিনি নিপীড়কের বিষদাঁত ভেঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বাঁচার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, যিনি রক্ত লোলুপ নেতানিয়াহু গংদের উচিত শিক্ষা দিয়ে, তাদেরকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে হিটলারের পাইকারি নিধনযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ইউরোপের পথে প্রান্তে ঘুমানো বাস্তুহারা এসব বিশ্ব টোকাই আর উচ্ছিষ্টদের রক্ত পিপাসা চির দিনের জন্য মিটিয়ে দিতে সক্ষম হবেন পুনরায়। যার নেতৃত্বে পুনরায় একত্রিত হবে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরসহ সকল আরব দেশ। এগিয়ে আসবে অন্যান্য মুসলিম দেশ। এগিয়ে আসবে ন্যায় এবং ইনসাফের ঝান্ডাধারী অপরাপর রাষ্ট্র এবং জাতিপুঞ্জ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে পরাস্ত এবং নাস্তানাবুদ হবে মধ্যপ্রাচ্যের বিঁষফোড়া ইসরায়েল। উচিত শিক্ষা পাবে দখলদার খুনিদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল। শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। শান্তির পরশ ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে। গোটা বিশ্বময়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২১ সকাল ১০:৩৬