আমার উপবৃত্তির ৪,২০০ টাকা না পাওয়ার করুণ অভিজ্ঞতার গল্প...
টাকার ছড়াছড়ি না হলেও টাকাপ্রাপ্তির মেসেজের ছড়াছড়ি ঠিকই চলছে। গত পরশু অর্থাৎ, ২৫ মার্চ বিকেল ০৫:১৯ এর দিকে মোবাইলে একটি মেসেজ টোনের মত বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিণে তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ, ভুল শুনিনি। একটি মেসেজ এসেছে। হ্যাভ কাম আ নিউ মেসেজ। মেসেজটা পড়ার জন্য ইনবক্সে ঢুকলাম। মেসেজ পাঠ করে তো রীতিমত থ'! বিশাল ব্যাপার! স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর মেসেজ! ভাবলুম কিয়ৎক্ষণ, ভেবে পুলকিতবোধ করলুম এ কারণে যে, শেষমেষ এই অভাজনকে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় সদয় হয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন! তিনি আমাকে শিক্ষার্থী সম্বোধন করেছেন! যাক, তাতে কোন কষ্ট পাইনি! আমার বয়স যা-ই হোক, শিক্ষা তো নিয়মিতই নিচ্ছি! কত কিছু থেকেই তো শিক্ষা নিচ্ছি নিত্য দিন! আর তা ছাড়াও নিজেকে শিক্ষার্থী ভাবতে এখনও কেমন যেন একটা মজাই অনুভব করি কি না! তো, তিনি আমাকে উপবৃত্তির টাকা দিবেন বলে জানিয়েছেন! ৪,২০০ টাকা! ইস! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! চার হাজারেরও উপরে টাকা! Coronavirus (COVID-19) এর কারণে দেয়া হচ্ছে এই টাকাগুলো! অবশেষে তিনি দয়া করে শিক্ষাবোর্ডের একটি মোবাইল নাম্বারও একই মেসেজের সাথে দয়া পরবশ হয়ে যুক্ত করে দিয়েছেন! তার মহানুভবতার তুলনা হয় না! তাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো তখন বুঝতেই পারছিলাম না!
পরক্ষণে নিজেকেই ধিক্কার দিলাম এই কারণে যে, আরে বোকা! শিক্ষামন্ত্রী নিজেই যেহেতু মেসেজটি পাঠিয়েছেন, প্রেরকের ঠিকানায় যেহেতু শিক্ষামন্ত্রীই লেখা, তুমি তো যে নাম্বার থেকে মেসেজটি এসেছে, সেই নাম্বারে একটা কল দিলেই তাকে ধন্যবাদ জানাতে পারো!
অধিক কষ্ট্ কিংবা নিতান্ত বৃহৎ কোনো আনন্দে নিজের মাথার চুল নিজেরই মাঝেমাঝে ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়! এই বুদ্ধিটা হঠাৎ মাথায় উদয় হওয়ায় তখন আমার অবস্থাও কিঞ্চিৎ তেমনই অনুভূত হয়েছিল!
যা-ই হোক, দুরুদুরু বুকে মেসেজ অপশনে গিয়ে সেই মেসেজটিতে আবার প্রবেশ করলুম। ওপেন করলুম মেসেজটি। দেখলুম, মেসেজটি পাঠানো হয়েছে ০১৪০০-৪৯৮৫১৯ নাম্বার হতে। কাঁপা কাঁপা হাতে নাম্বারটি টুকে নিলুম। অতঃপর সাহস করে একটা একটা করে ডিজিট প্রেস করার পরে নাম্বারগুলো সঠিকভাবে মোবাইলের কল অপশনে তোলা হয়েছে কি না, পুনরায় যাচাই করে নিলুম। তখনও মনের মধ্যে ভয়, কি না কি হয়ে যায়! মন্ত্রী মহোদয়কে ফোন দেয়া তো যেমন তেমন বিষয় নয়! মন্ত্রী মিনিস্টারদের ব্যাপার! পান থেকে চুন খসতেই ধন্যবাদের এই প্ল্যান উল্টো কোনো বিপদ ডেকে আনে কি না কে জানে!
ইত্যাকার নানান ভাবনার এক পর্যায়ে মনে মনে বললুম, যা হয় হবে, কল আমি দিবই। এত বড় একটা মানবিক কাজ মন্ত্রী মহোদয় করে যাচ্ছেন, আর তাকে সামান্য একটা ধন্যবাদ দিব না? এটা হতেই পারে না। তো, যেই ভাবনা সেই কাজ, সাহস করে দিয়েই ফেললুম কলটা। গলা পরিষ্কার করে তাই সুন্দর করে সালাম দিলুম।
কিন্তু অপর প্রান্ত হতে সালামের উত্তর না দিয়েই বলা হলো- 'কেন ফোন করেছেন?'
বললুম, জ্বি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে কল দিয়েছিলাম।
বলা হলো, ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই। করোনার এই সময়ে শিক্ষার্থীদের টাকা দেয়া তার দায়িত্ব। আপনার উপবৃত্তির মেসেজ পেয়েছেন?
বললুম, জ্বি, পেয়েছি।
টাকা তো হাতে পাননি এখনও, তাই না?
জ্বি না, পাইনি।
শুনুন, টাকাটা পেতে হলে আপনার একটি বিকাশ নাম্বার দেন।
যে নাম্বার দিয়ে আপনার সাথে কথা বলছি, এটাই আমার বিকাশ নাম্বার, প্লিজ!
তাহলে আপনি অন্য একটি মোবাইল নাম্বার থেকে আমাকে কল দেন।
দুঃখিত! আমার তো মোবাইল একটাই। আমি একটিমাত্র মোবাইল ফোনই ব্যবহার করি।
আরে, আপনার পাশের কারও নাম্বার থেকে কল দেন।
আমার আশেপাশে এই মুহূর্তে এমন কেউ নেই যার মোবাইল থেকে কল দিতে পারি।
আত্মীয় স্বজন কেউ নেই?
দুঃখিত! আত্মীয় স্বজন তো অনেকেই আছেন, কিন্তু এই বিপদের সময়ে তাদের কাউকে পাচ্ছি না। মোবাইল ব্যবহার করতে দিয়ে সহায়তা করার মত কেউই পাশে নেই!
দোকানে যান। বিকাশের দোকানে গিয়ে সেখান থেকে কল দেন।
আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আমার বাসার কাছাকাছি কোনো দোকানপাট নেই। বিকাশের দোকানে যেতে হলে বাজারে যেতে হবে। তা সময়ের ব্যাপার।
এই হা... পুত পাকা প্লেয়ার! অশ্রাব্য এবং কুৎসিত আরও কিছু গালিগালাজ.... এক লহমায়। না থেমেই। আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই।
আমি শেষবারের মত আরেকটুখানি হোচট খেলুম!
আর তখনই, কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলুম! কারণ, বুঝতে পারলুম, ও পাশ থেকে ইতোমধ্যেই কলটি কেটে দেয়া হয়েছে!
স্বয়ং মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের পক্ষ হতে মেসেজপ্রাপ্তির পরেও এইভাবে টাকাটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মনটা কিছুটা বিষন্ন লাগছিল! কেন আত্মীয় স্বজনের মোবাইল থেকে কল দিতে পারলুম না, কেন দোকানে গেলুম না- এইসব ব্যর্থতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল! কিন্তু বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হয়নি! কারণ, নিজেকে ধিক্কার দিলুম, প্রবোদ দিলুম, আরে বোকা! তুমি বুঝতেছো না, তোমার আকল জ্ঞান কম! তুমি টাকাকেই বড় মনে কর? টাকা না পেয়েছো, তাতে কি? মন্ত্রী মহোদয়ের নাম্বারে কথা তো বলতে পেরেছো! এটাও কি তোমার মত একজন অতি সাধারণ প্রজার জন্য কম সৌভাগ্যের বিষয়?
পরক্ষণে একটু স্থিরতা আসার পরে মনে হলো, আসলেই তো তাই! শেষমেষ সেটা মনে করেই অন্তরে তৃপ্তির একটা আবহ অনুভব করতে চেষ্টা করলুম! আর তখনই আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে আমার মত ভাগ্যবান তেমন আর কেউ হয়তো নেই! আনন্দে বগল বাজাতে ইচ্ছে করছিল! মাইকে ঘোষনা দিয়ে সবাইকে শোরগোল করে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছিল রীতিমত! আহ! কী বিশাল সৌভাগ্য আমার! আমি মন্ত্রী মহোদয়ের নাম্বারে কল করে কথা বলেছি!
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক, আমার মোবাইলে প্রেরিত মেসেজটি আপনাদের সুবিধা বিবেচনায় এখানে হুবহু তুলে ধরার লোভটা সামলাতে পারছি না বলে দুঃখিত! কারণ, বলা তো যায় না, আমি অভাগা না হয় না পেলুম, এই নাম্বারে ফোন করে আমার মত হাজারও কিংবা লাখো শিক্ষার্থী টাকা পয়সা যে পাবেন না, তার নিশ্চয়তা কি? তারা পেলেও তো পেতে পারেন! আর না পেলেও মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের নাম্বারে কল দিয়ে কথা তো বলতে পারবেন! এটিও কি কম সৌভাগ্যের! অতএব, দয়া করে মেসেজটি পাঠ করুন, পারলে কল করে টাকাগুলো ধরার চেষ্টা করুন-
প্রিয় শিক্ষার্থী! Coronavirus (COVID-19) এর কারণে তোমাদের উপবৃত্তির ৪,২০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। টাকা গ্রহনের জন্য নিম্নোক্ত শিক্ষাবোর্ডের নম্বরে যোগাযোগ করুন।
মোবাঃ 01825138999 অথবা
গোপন নম্বরঃ ১৯৫৮
শিক্ষামন্ত্রী যোগাযোগের সময় সকাল 930 টা থেকে রাত 9 টা পযন্ত
পোস্টটি পাঠের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২২ বিকাল ৪:২৫