somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

কুরবানী: ইতিহাস, গুরুত্ব ও শিক্ষা - একটি হৃদয়স্পর্শী আলোচনা

০২ রা জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
কুরবানী: ইতিহাস, গুরুত্ব ও শিক্ষা - একটি হৃদয়স্পর্শী আলোচনা

বাইতুল্লাহিল হারাম, মক্কাতুল মোকাররমাহ, ছবিটি এআই -এর সহায়তায় তৈরি।

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيدنا محمد وآله وصحبه أجمعين

প্রিয় মুমিন মুসলিম ভাইয়েরা,

ঈদুল আযহার পবিত্র এই দিনটি আমাদের জন্য শুধু আনন্দের দিন নয়, বরং এটি আমাদের হৃদয়ে গভীর শিক্ষা ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত নিয়ে আসে। কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং বিশেষ ইবাদত। এটি হযরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে চলে আসছে, তবে বিভিন্ন নবীর শরীয়তে এর পদ্ধতি এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে কুরবানির যে রূপ আমরা দেখি, তার মূল সূত্র রয়েছে ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’তে, এজন্যই একে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ বলা হয়। আজ আমরা হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সেই অমর ঘটনা স্মরণ করব, যা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং আল্লাহর প্রতি ত্যাগ ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।

কুরবানির ইতিহাস: হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর ত্যাগের গল্প

কুরবানির ইতিহাস আমাদেরকে নিয়ে যায় হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে। তিনি ছিলেন আল্লাহর খলীল, যিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে আল্লাহর আদেশ পালনে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এলো যখন তিনি বৃদ্ধ বয়সে একটি সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় আল্লাহর কাছে কাতর হয়ে প্রার্থনা করছিলেন। কুরআনে তাঁর এই দুআর কথা এসেছে:

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

অর্থ: “হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন।” -সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০০

যত দিন যাচ্ছিল, তাঁর হৃদয়ে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হচ্ছিল। অবশেষে আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করলেন এবং তাঁকে একজন সহনশীল পুত্র দান করলেন, যার নাম রাখা হলো ইসমাঈল। এই সন্তানের জন্মে ইবরাহিম (আ.)-এর হৃদয় আনন্দে ভরে গেল। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন:

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۖ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ

অর্থ: “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দুআ শ্রবণকারী।” -সূরা ইবরাহীম, আয়াত ৩৯

কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে আরেকটি কঠিন নির্দেশ এলো। তাঁকে তাঁর স্ত্রী হাজারা (আ.) এবং ছোট্ট ইসমাঈল (আ.)-কে সুদূর মক্কায় রেখে আসতে হবে, যেখানে তখন কোনো জনবসতি বা জীবনোপকরণ ছিল না। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করলেন এবং তাঁদেরকে মক্কায় রেখে এলেন। ইসমাঈল (আ.) ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করলেন। তিনি যখন বাবার সাথে ছোটাছুটি করার বয়সে পৌঁছলেন, তখন ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য এলো সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।

তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর একমাত্র কলিজার টুকরো ইসমাঈল (আ.)-কে তিনি যবেহ করছেন। নবীদের স্বপ্ন ওহীর মতো হয়, তাই এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আদেশ। কল্পনা করুন, একজন পিতার হৃদয় কতটা কাঁপতে শুরু করবে! তিনি যে সন্তানের জন্য বছরের পর বছর দুআ করেছেন, যাকে তিনি বৃদ্ধ বয়সে পেয়েছেন, সেই সন্তানকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করতে হবে। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) ছিলেন আল্লাহর খলীল। তিনি আল্লাহর আদেশের কাছে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকেও সমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে স্বপ্নের কথা জানালেন এবং তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন। কুরআনে এসেছে:

يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ

অর্থ: “হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন বল, তোমার মতামত কী?” -সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০২

ইসমাঈল (আ.), যিনি ছিলেন একজন ভাবী নবী এবং ইবরাহিম (আ.)-এর যোগ্য পুত্র, তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন:

يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

অর্থ: “হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।” -সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০২

প্রিয় উপস্থিতি, এই কথাগুলোর গভীরতা কতখানি! একজন শিশু, যিনি সবেমাত্র চলাফেরার বয়সে উপনীত হয়েছেন, যিনি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ে ছিলেন, তিনি তার পিতার হাতে নিজেকে সমর্পণ করলেন—কেন? কারণ তার মনে ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট বিশ্বাস। তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে বিষয়টি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করলেন এবং ‘ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ বলে বিনয়ের চরম দৃষ্টান্ত দিলেন।

যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে রাজি হলেন, তখন এলো পরীক্ষার আসল পর্ব। ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে যবেহ করার জন্য কাত করে শুইয়ে দিলেন। সাধারণত যবেহের সময় চিত করে শুইয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন, যাতে ছুরি চালানোর সময় পুত্রের মায়াবি মুখ তার দৃষ্টিগোচর না হয়। কারণ, পুত্রের মুখ দেখলে তাঁর পিতৃহৃদয় টলে যেতে পারে। এই কঠিন দৃশ্যটি একটিবার কল্পনা করুন—একজন পিতা তার একমাত্র সন্তানকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করতে প্রস্তুত, আর সেই সন্তান আল্লাহর আদেশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে শান্তভাবে শুয়ে আছে।

কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁদের এই আনুগত্য ও সমর্পণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁদের উপর রহমত বর্ষণ করলেন। কুরআনে বলা হয়েছে:

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ ۝ وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ ۝ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ۝ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ ۝ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

অর্থ: “অতঃপর যখন তারা উভয়ে আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নের আদেশ পূর্ণ করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয় এটি ছিল একটি স্পষ্ট পরীক্ষা।’ আর আমরা তাকে একটি মহান কুরবানি দ্বারা ফিদিয়া দিলাম।” -সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৭

আল্লাহ তাআলা তাঁদের আনুগত্য দেখে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন, এবং ইবরাহিম (আ.) তা যবেহ করলেন। এই ঘটনা কুরবানির মূল সূত্র হয়ে রইল, যা আমরা আজ ঈদুল আযহায় পালন করি।

কুরবানির ধারাবাহিকতা: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ঐতিহ্যকে অব্যাহত রেখেছেন। তিনি মদিনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছর ঈদুল আযহার দিনে কুরবানি করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন:

أَقَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلَّ سَنَةٍ

অর্থ: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন।” -জামে তিরমিজি, হাদিস ১৫০৭

রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর দুটি পশু কুরবানি করতেন—একটি নিজের জন্য এবং অপরটি তাঁর উম্মাহর পক্ষ থেকে। তিনি বলতেন:

اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ

অর্থ: “হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকেই এবং তোমার জন্যই।” এই কথায় তিনি তাঁর বিনয় ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭৯৫

হযরত মিখনাফ ইবনে সুলাইম (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আরাফায় দাঁড়িয়ে বলেছেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ، عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةٌ

অর্থ: “হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরের উপর প্রতি বছর কুরবানি আবশ্যক।” এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কুরবানি সামর্থ্যবানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। -জামে তিরমিজি, হাদিস ১৫১৮

কুরবানির গুরুত্ব: কুরআন ও হাদিসের আলোকে

কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

অর্থ: “সুতরাং আপনার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন।” -সূরা আল-কাউসার, আয়াত ২

এই আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মাহকে নামাজ ও কুরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে।

একটি হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবীজির কাছে দ্বীন সম্পর্কে জানতে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় নবীজি তাকে ডেকে বললেন:

أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللَّهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمَّةِ

অর্থ: “আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’র আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মাহর জন্য ঈদ বানিয়েছেন।” -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৬৫৭৫

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন:

إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، فَمَنْ فَعَلَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমরা আমাদের এই দিনে (ঈদুল আজহার দিন) যা দিয়ে শুরু করি, তা হলো আমরা প্রথমে সালাত (ঈদের নামাজ) আদায় করি, এরপর ফিরে গিয়ে কুরবানি করি। অতএব, যে ব্যক্তি এইভাবে করে, সে আমাদের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করেছে।” -সহিহ বুখারী ৫৫৬৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬১

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কুরবানি শরীয়তের বিধান মোতাবেক করতে হবে, অন্যথায় তা কেবল গোশত খাওয়ার আয়োজন হয়ে যাবে।

কুরবানির শিক্ষা: আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আনুগত্য

কুরবানির মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা, যা আমাদের জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উল্লেখ করা হলো:

১. তাওহীদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করা

কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো আল্লাহর প্রতি তাওহীদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করা। কুরবানি আমাদের শেখায় যে, ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া কেউ বা কিছু ইবাদতের উপযুক্ত নয়। কুরআনে এসেছে:

قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِّلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۚ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ۝ قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ۝ لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

অর্থ: “আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করেছেন, যা বিশুদ্ধ দ্বীন, ইবরাহীমের মিল্লাত, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই।” -সূরা আল-আনআম, আয়াত ১৬১-১৬৩

রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানির সময় তাওহীদের এই ঘোষণা উচ্চারণ করতেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি কুরবানির সময় বলতেন:

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ، عَلَى مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

অর্থ: “আমি আমার মুখ তাঁর অভিমুখী করলাম, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭৯৫

২. আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ

কুরবানি আমাদের শেখায় আল্লাহর সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে তাঁর একমাত্র সন্তানকে যবেহ করতে রাজি হয়েছিলেন। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর আদেশ সবার উপরে। আমাদের জীবনে আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

৩. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন

কুরবানির আসল উদ্দেশ্য হলো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ

অর্থ: “আল্লাহর কাছে এদের গোশত বা রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলো তোমাদের জন্য দীন করেছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর তাকবির ঘোষণা করো এ জন্য যে তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন।” -সূরা আল-হজ্জ, আয়াত ৩৭

এই আয়াত আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আল্লাহর কাছে আমাদের কুরবানির গোশত বা রক্ত পৌঁছে না, তিনি দেখেন আমাদের হৃদয়ে তাকওয়া ও নিয়ত আছে কি না। যদি আমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করি, তাহলে তিনি তা কবুল করবেন। কিন্তু যদি নামদাম বা লৌকিকতার জন্য করি, তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না।

মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানির ঘটনায়ও এই শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র যখন কুরবানি পেশ করলেন, তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অপরজনের হলো না। যার কুরবানি কবুল হলো, তিনি বললেন:

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

অর্থ: “আল্লাহ তো মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন।” -সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭

৪. বিনয় ও কৃতজ্ঞতা

কুরবানি আমাদের শেখায়, যেকোনো নেক কাজে অহংকার না করা, আত্মমুগ্ধতার শিকার না হওয়া। ইসমাঈল (আ.) তাঁর পিতার কাছে বলেছিলেন, “ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।” এই কথায় তাঁর বিনয় ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। রাসূলুল্লাহ (সা.)ও কুরবানির সময় বলতেন, “হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকেই এবং তোমার জন্যই।” এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সবকিছু আল্লাহর দান, তিনিই তাওফিক দিয়েছেন।

৫. সন্তানকে আল্লাহর অনুগত করা

কুরবানি আমাদের শিক্ষা দেয় সন্তানকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য শিক্ষা দেওয়া। ইবরাহিম (আ.) সবসময় এমন সন্তানের জন্য দুআ করতেন, যে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ অনুগত হবে। ইসমাঈল (আ.) সেই শিক্ষার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদেরও সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা না করে।

উপসংহার: কুরবানির শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রয়োগ

প্রিয় মুসল্লিবৃন্দ, আজকের এই পবিত্র দিনে আমরা যখন কুরবানি করব, তখন আমাদের হৃদয়ে এই শিক্ষাগুলো ধারণ করি। আমরা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করি, আমাদের হৃদয় থেকে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ করি। কুরবানির গোশত যখন আমরা দরিদ্র ও অভাবীদের মাঝে বণ্টন করব, তখন তাদের মুখে হাসি দেখে আমাদের চোখ ভিজে উঠবে।

আসুন, আমরা আজ একটি প্রতিজ্ঞা করি—আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করব। আমরা আমাদের অহংকার, ঈর্ষা ও পাপকে কুরবানি করব। আল্লাহ আমাদের কুরবানি কবুল করুন এবং আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে শামিল করুন। আমীন।

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:৩১
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দাসপ্রথার নিগড় ভেঙে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে দ্বিগুণ উৎপাদন

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৪:২০

দাসপ্রথার নিগড় ভেঙে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে দ্বিগুণ উৎপাদন

এআই এর সহায়তায় তৈরি ইমেজ।

প্রায় ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার অপশাসনের সময়টা ছিল এক অলিখিত আধিপত্যবাদের ছায়া। সাধারণ নাগরিকদের এক কাপ চা পান... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১৯ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৪:২১

সদ্য প্রকাশিত (year 2026) কিউএস র্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 584 তম স্থান অর্জন করে দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে। । দ্বীতিয় স্থানে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খামেনিকে হত্যা করা হলে ইরানে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৭


খামেনেইকে হত্যা করা ইজরায়েলের অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য : স্পষ্ট করলেন নেতানিয়াহুর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির মৃত্যু দেশটির জন্য কেবলমাত্র একটি নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডঃ ইউনুস তারেক রহমান বৈঠকঃ কতটুকু নিশ্চয়তা দিলো সুষ্ঠু, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক উত্তরণের?

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ১৯ শে জুন, ২০২৫ রাত ৯:২৫



তারেক রহমানের সাথে ডঃ ইউনুসের সাম্প্রতিক বৈঠকের ফলাফল নিয়ে বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর অনেকেই অনেক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, অনেকেই দারুণ আনন্দিত। অনেকেই, বিশেষ করে যারা বিএনপি করেন, মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাইপাঁশ

লিখেছেন আরোগ্য, ২০ শে জুন, ২০২৫ রাত ২:০৭

মধ্যিরাতে আমি আর আমার গাঁথা। না কবিতা প্রসব করার মত শক্তি নেই। মস্তিষ্কে চাপ দিতে ইচ্ছে করছে না। শব্দগুলো যেন মরুভূমির ধু ধু প্রান্তরে হারিয়ে গেছে। সেগুলো খুঁজে আনার সাধ্যি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×