প্রথমে গানের পেছনের ঘটনা
এই বৃহস্পতিবার বিকেলে
কাজির দেউরির দিকে হেঁটে যাচ্ছি লালখান বাজার থেকে । মাথার ওপর তেতে থাকা সূর্যটার রোদ থেকে বাঁচবার জন্য দালান আর অশ্বত্থের ছায়ার নিচ দিয়ে আমি হাঁটছি । তবুও কাজির দেউরির কাছাকাছি আসতেই রাস্তার পিচের গরমে আর কোন উপায় আমাকে সেদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচাতে পারল না । কী আর করা , গরম আর ঘামকে সঙ্গী করে হাঁটছি । আউটডোর স্টেডিয়ামের কাছ ঘেঁষে যে ফুটপাত গেছে সেই ফুটপাত ধরে হাঁটছি । হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম এই গরমেও কিছু কপোত-কপোতিকে তপ্ত রাস্তায় প্রেম বিলাস করতে দেখা যাচ্ছে । এদের দেখে রাস্তার মানুষ হয় মুখ ভেংচাচ্ছে না হয় তো কটমটে দৃষ্টি দিয়ে ঘৃণাভরা ভাব নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে । আচমকা মনে হলো েদের দেখে কেবল রাস্তার মানুষগুলো নয় , সূর্যও কিছুটা ক্ষেপে আছে । ভাবা যায় প্রেম নামক একটা আবেগের বশে এরা সূর্যের প্রতাপকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ! এটা কী সূর্যের সইবে ? মনে হয় না । আহা প্রেম কী ক্ষমতা তোমার কত কিছুকেই না তুমি ডিঙিয়ে দিতে পারো নিজের আবহ দিয়ে !
গরম , কপোত-কপোতিদের প্রেম, আর নাগরিক মানুষদের ব্যস্ততাকে এড়িয়ে আমি যখন রাস্তা পাড় হতে যাব ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল শেহরিন । সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরে আছে সে । শ্যামল বরণের শরীরে ভাঁজ নিয়ে পেঁচিয়ে থাকা সুতির শাড়িটা মনে হচ্ছে এক অনন্য আবেদন পেয়েছে সেটা কী আমার দৃষ্টির জন্য নাকি শেহরিনের আবেদনময়তার জন্য নাকি সূর্যের আগুনরঙা রোদের জন্য তা জানি না। মাঝারি গড়নের ছিপছিপে শরীরে সব সময় এক কাব্যিক ছন্দ নিয়ে ঘোরে সে । এমনিতেও সে আবৃত্তিশিল্পী তার ওপর আবার সাংস্কৃতিক জগতে তার নাম আছে । তাই সবসময় তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা পরিপাটি ভাব থাকে , আর যা আমাকে আর দশটা মেয়েদের থেকে তাকে আলাদা করতে সাহায্য করে ।
গরমে শেহরিনের অবস্থা আমার মতই তবুও পোশাকে সে ছাপ দেখা যাচ্ছে না এমনকি চাঁছাছোলা কপোলদ্বয় তার ঘামে চকচকে হয়ে গেছে । কিন্তু মনে হয় না তাতে তার ঔজ্বল্যতা কোন ক্রমে কমে গিয়েছে উল্টো মনে হচ্ছে কবি হাফিজ যদি তাকে এই অবস্থায় দেখতো তবে এই কপোলদ্বয়ের জন্য পারলে পুরো পৃথিবীকে নিলামে তুলে দিত । আহ্ শেহরিন , যাকে আমি দৃপ্রনিশা বলে ডাকি হরদম । যার সাথে সময় কাটানোটা আমার কাছে স্বর্গসামিল সে এখন আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় প্রেয়সীর বেশে !
বুকের কাছে হাতদুটো ভাঁজ করে স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বল হাসি দিয়ে সে বলল , “ কেমন আছো ব্লগার ? ”
আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে সে বলল , “ ও আচ্ছা আচ্ছা তুমি তো উত্তর দেবে এটাই যে তুমি জানোই না তুমি কেমন আছো ! তাই তো ?”
আমিও হেসে উত্তর দিলাম , “ ঠিক ধরেছো , তুমি এখানে আর কোত্থেকে আসা হচ্ছে ? ”
“ এইতো জিইসি থেকে আসছি , জামাল খানে যাবো তুমিও কী সেদিকে যাবে ? ”
গন্তব্য বদলে নিলাম । শেহরিনের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না । যে কাজে এসেছি সেটাও খুব একটা বড় কিছু না । তাই সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলাম , “ হ্যাঁ সেদিকেই যাচ্ছি ! ”
“ বেশ তো চল তবে এক সাথে যাওয়া যাক ! ”
আমরা শহরের দুই যুবা-যুবতি শহুরে তেতে ওঠা রাস্তা ধরে হাঁটছি , আমাদের মুখে খই ফুঁটছে মধ্যবিত্তের ছাপোষা সাংসারিক কথায় , হাল আমলের পরিস্থিতি , চাকরির অনুসন্ধান,মধ্যবিত্তের একমাত্র অবলম্বন শিক্ষা আর মধ্যবিত্ত দুঃখ ভুলে থাকবার জন্য নিজের শখ লেখালেখি, দর্শন আর গান নিয়ে !
হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন জামাল খান চত্বরে এসে পৌঁছালাম ঠিক তখন আমাদের কথা থামল। শেহরিন প্রশ্ন ছুড়ে দিল , “ তুমি কী কিছু খাবে ?” প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে, মাথা নিচু করে তার বাম অনামিকায় থাকা আংটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল , “ তবে বুঝতেই পারছো , মাসের শেষ , সামনেই একটা ইদ গেল .............. ”
বুঝি আমি এসব । আমারও পকেটের অবস্থা তেমন ভালো না , গাড়ি ভাড়া বাঁচাতেই এত হাঁটছি , শেহরিনও তাই । সেজন্য আমি হেসে বললাম , “ এখন হাওয়া খেতে ইচ্ছে করছে । চল কোথাও বসে দুজনে হাওয়া খাই !
আমার কথাতে শেহরিন আবার হাসল । মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটিকে হাসাতে পারলেই বোধহয় আমার এই অকর্মণ্য জীবনে কিছু একটা অর্জন হয়েছে ।
এরপর আমরা জামাল খানের ফুটপাতে থাকা বসার বেদিতে বসে আলাপ চালালাম । আমার ব্লগিং নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ হলো আর সেই আলাপের দড়ি ধরেই শেহরিন বলল , “ আচ্ছা ইদের আগে ব্লগে দেখলাম তোমাকে নিয়ে এক ব্লগার বিয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল । কী যেন নাম ওনার ? মনে পড়ছে না !”
আমিই নামটা ধরিয়ে দিলাম , “ সাড়ে চুয়াত্তর !”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ , সাড়ে চুয়াত্তর ! সেখানে সবাই তোমাকে নিয়ে যা শুরু করেছিল না । বিশেষ করে সাড়ে চুয়াত্তর আর দুজন নারী ব্লগার তাদের নামগুলোও ভুলে গেছি !”
আমি আবার ধরিয়ে দিলাম , “ মিরোরডডল আর দেয়ালিকা বিপাশা ! ”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ তাই , আচ্ছা ব্যাপার কী বলতো ! ”
খুলে বললাম তাকে সব । কোত্থেকে সাচু আমার পেছনে লাগলো কেন লাগলো সব আমি তাকে এক এক করে বললাম । এবং এইও বাড়িয়ে বললাম সাচু যদি কোন পাত্রীকে বিয়ে দিতে না পারে তো তিনি নিজের ছেলের জন্য তাকে নির্বাচন করে রাখে । এবং এই নিয়ে তিনি ছেলের জন্য ৩৬ জন নির্বাচন করে রেখেছে । কেন রেখেছে ? কারণ সিনিয়র মেয়ে বউ হলে অনেক সওয়াব !
আমার থেকে বিস্তারিত শুনে সে বেদম হাসি হাসল । তার হাসি দেখে ফুটপাতে হাঁটতে থাকা মানুষ একবার হলেও ফিরে চাইল । কিছু কিছু যুবক তো আমার দিকে হিংসের চোখেও চাইল । আমার অবশ্য বেশ ভালোই লাগছিল , ঐ যে বললাম তাকে হাসাতে পারাটা আমার অনেক বড় পাওয়া ।
হাসির দমক একটু থামতে সে বলল, “ সত্যিই কী উনি ঘটকালি করেন ? ”
“ হ্যাঁ , কেন তোমার কোন দরকার ! ”
একটু থেমে বলল , “ কেন দরকার পড়তে পারে না ? আচ্ছা বল তো আমার জন্য তিনি পাত্র ঠিক করতে পারবে কিনা ! ”
“ কী লাভ ? খুঁজে না পেলে তো তোমাকে পুত্র বধু বানিয়ে নেবে । সেটা কী ভালো হবে ? ”
শেহরিন আবার তার অনামিকার আঙটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে চোখে দুষ্টুমি নিয়ে বলল , “ তাই যদি হয় তুমি কী আবার রেগে যাবে নাকি ? ব্লগে যেমনটা করেছিলে ? ”
আমি থ হয়ে গেলাম । এমন একটা শুনতে হবে আগে ভাবিনি । কী বলা যায় ? বলার মত তো কিছু পাচ্ছি না । কিন্তু বলতে তো আমাকে হবেই না হলে সাচুর কথা সত্য হয়ে যাবে আমি মেয়েদের সাথে কথা বলতে জানি না । চুপ হয়ে ভাবলাম কিছুক্ষণ । এরপর শেহরিনের দুষ্টুমি ভরা চোখে চোখ রেখে বললাম , “ শোন শেহরিন, সাচু যদি পুরো পৃথিবীর সব মেয়েদের নিজের পুত্রবধু বানায় তবে আমার কিচ্ছু যায় আসবে না । তবে সাচুর নজর যদি তোমার ওপর পড়ে তো আমি সাচুর সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দেব । আর সেই যুদ্ধ ইতিহাস শ্রেষ্ঠ না হোক , অন্তত কিংবদন্তি হয়ে থাকবে মহাকাল জুড়ে ! ”
আমার কথাতে কতটা কি ছিল আমার জানা নেই । তব এ এই কথা কতটি শুনে শেহরিনের চোখের দুষ্টুমি ভাবটা চলে গেল । সেখানে ভেসে উঠল নিশ্চুপ বিস্ময় ! আমার চোখে চোখ রেখে সে যেন তার বিস্ময়কে সামাল দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু পারছে না ।
আমি হাসিমুখে তাকে বললাম , “ মাথায় কিছু গিজ গিজ করছে তোমার কাছে কাগজ কলম হবে ? ”
শেহরিন কেমন যেন যন্ত্রচালিতের মত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল তার শান্তি নিকেতনি ব্যাগ থেকে বের করা কাগজ কলম । আমি সেসব নিয়ে লিখতে বসে পড়লাম !
খুব দ্রুতই লিখলাম আর যা লিখলাম তা হলো এই :
শোন বলি শোন তুমি
শোন প্রিয়তমা
সাচু নামের এক ঘটক আছে
দিলে নেই তার ক্ষমা ।
পাটকাঠি কী ঢঙি মেয়ে
জোয়ান কিংবা বুড়ি
বিয়ে দিতে চায় সবাইকে
দিয়ে জবর তুড়ি ।
সাচু হলো এমন ভিলেন
ডাকু গোফরান ফেল
আমি যদি ন্যাড়া তবে
সাচু বেলতলার বেল ।
সাচু হলো কনে শিকারি
চোখ রাখে টেলিস্কোপে
খুঁজে দেখ পাবে তাকে
বাড়ির ঝোঁপে ঝাঁপে ।
খোদার দোহাই পা দিও না
সাচুর পাতা ফাঁদে
খোলা চুলে আর যেও না
বাড়ির খোলা ছাদে ।
বিকেল হলে আর পরো না
সবুজ রঙা শাড়ি
সাচুর যদি নজর কাড়ো
আমার মাথায় বাড়ি !
খবর পেলাম সাচু নাকি
বলেছে তোমার বাবাকে
সে নাকি আজ ছেলে খুঁজছে
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ।
বলে দিও তোমার বাবাকে
করতে একটু কসুর
ভাগ্যে যদি শিঁকে ছিঁড়ে
বানাব তাকে শ্বশুর ।
খুঁজে যদি সে না পায়
তোমার জন্য কেউ
সাচু তবে বানিয়ে নেবে
তোমায় ছেলের বউ ।।
ঘোড়ায় চড়ে আসব আমি
এক পায়ে থেকো খাড়া
সাচু তোমায় যতই দিক না
বিয়ে করবার তাড়া !!
লিখা শেষ হতে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি শেহরিন আমার দিকে চেয়ে আছে । বিস্ময় বোধহয় তার এখনও কাটেনি । তাকে ধাতস্থ করতে বললাম , “ তোমার কাজের সময় হয়ে গেছে অনেক সময় নষ্ট করলাম তোমার । আজ তবে যাই ? পরে কোন একদিন দেখা হবে । ”
শেহরিন কেবল মাথা নাড়ল । কোন কথাই বলল না । আমি উঠে পড়লাম । শেহরিনও উঠে পড়ল । তাকে তার কলমটা ফিরিয়ে দিয়ে কাগজটা ভাঁজ করে বুক পকেটে নিয়ে বিদায় জানালাম তবে জায়গা থেকে নড়লাম না । কিন্তু শেহরিন বিদায় জানিয়ে হাঁটা লাগাল । কিন্তু একটু গিয়েই আবার পেছনে ফিরে তাকাল । আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি , ভেবেছিল আমি হয়তো তার দিক থেকে পেছনে ফিরে হাঁটতে থাকব কিন্তু আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইতস্তত করে আবার হাঁটা লাগাল । আবার কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে তাকাল । আবার সেই ইতস্তত ভাব , আবার হাঁটতে থাকা আবার ফিরে চাওয়া আবার হাঁটতে থাকা । আমার চোখের দৃষ্টি অত ভালো না , আল্লাহ’তাআলা আমার চোখে অত জ্যোতি না দিলেও অনুভব করবার ক্ষমতা দিয়েছেন , অনুভবের পরিধি তো সেই পর্যন্ত যেখানে দৃষ্টি পৌঁছায় না । আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম তার চকচকে কপোল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে ! সেটা একই সাথে এক আস্থা , কষ্ট , আশ্বাস এবং না পাওয়ার বেদনা !
আর দাঁড়ালাম না আমি । আমিও আমার গন্তব্যের দিকে ছুটলাম ! আর যেতে যেতে অনুভব করলাম ও আবিষ্কার করলাম এক নতুন আমিকে !
তো এই ছিল গানের পেছনের ঘটনা । সাড়ে চুয়াত্তরকে নিয়ে আমার লিখা এই গানটা আপনাদের শোনালাম দেখুন কেমন লাগে শুনতে । এটা অবশ্য সাচুর প্রতি আমার প্রতিশোধমূলক গান যদিও তবুও অন্তত কটাক্ষের বাসনা নিয়ে নয় , হাস্যরসের বশে এই গান শুনুন !
আর হ্যাঁ সাচু ভাই গানের প্রেক্ষাপটকে দয়া করে গল্প ভাবলে ভাবুন , তব না ভাবলেও চলবে হাহাহাহা...........................
গান:সাচুকে নিয়ে গান
কথা:নিবর্হণ নির্ঘোষ
সুর ও কণ্ঠ: নিবর্হণ নির্ঘোষ
গিটার: নিবর্হণ নির্ঘোষ
গানের কথা উপরেই আছে !
বিশেষ ধন্যবাদ: আমার গুর্বী ও জননী শ্রদ্ধেয়া লুবনা আমিন ও ব্লগার বন্ধু অধীতিকে !
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৪:০৬