কোথাও কেউ নেই; বাংলা নাটকের ইতিহাসে যার আলোচনা আমার মতে সবচাইতে বেশি। এখন অব্দি যার অভিনয়, গল্প কিংবা দুঃখ বেদনার বিষয়গুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আন্দোলিত হয়। আর যাকে ঘিরে এই মহান সৃষ্টি, তিনি বাকের ভাই (আসাদুজ্জামান নুর)। যার অভিনয়শৈলী, সংলাপ কিংবা স্টাইল এখনও বিমোহিত করে সকল শ্রেণীর ভক্তকূল-কে। একটা উপন্যাসের চরিত্র কিভাবে আমাদের হৃদয়কে আন্দোলন ঘটাতে পারে তা আমরা দেখতে পেয়েছি হুমায়ুন আহমেদের কলমের বুনন কিংবা ক্যামেরার কারিশমায়।
অপরদিকে কিংবদন্তী লেখক স্টিফেন কিং এর অনবদ্য সৃষ্টি দ্য গ্রীণ মাইল উপন্যাসের চরিত্র জন কফি এমন এক চরিত্র যাকে প্রথম দেখেই বুকের পাঁজরে জমতে পারে অদ্ভুদ মায়া। ক্লান্ত দুচোখ যখন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন জেলখানার বাকি কয়েদি ও রক্ষীরা অবাক হয়ে ভাবনার পৃষ্ঠায় কাটা কম্পাস চালাতে থাকে, এই লোকের দ্বারা কিভাবে মানুষ খুন সংঘটিত হয়েছে।
ভালো মানুষের চেহারা দেখেই নাকি বলে দেয়া যায় তারা ভালো মানুষ। বাকের ভাই কিংবা জন কফির ক্ষেত্রেও সে জিনিসটাই ঘটেছে। অথচ সাহায্য করার অপরাধেই তাদের মাথা পেতে মেনে নিতে হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
শেষ সময়ে এসে জন কফি যখন কারারক্ষী পল এজকম্পকে (টম হ্যাংকস) বলে, "বস, আমি প্রতিনিয়ত যে ব্যথা শুনছি এবং অনুভব করছি তাতে আমি খুব ক্লান্ত। আমি বৃষ্টিদিনে ফাঁকা রাস্তায় দাঁঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো; তা বলার মতো কোনো ভালো বন্ধু নেই। মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। আমার ইচ্ছে হয়, আমি যদি তুড়ি মেরে সব বিষাদ দূর করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি পারিনা, বস।” তখন দর্শকমহলে অশ্রু মোছার রুমাল খোঁজার জন্য তাড়া থাকেনা। ভেতর থেকে সবাই অনুভব করে, ঝরুক আঝি অশ্রুঝর্ণা; যতো খুশি ঝরতে দাও।
কিংবা বাকের ভাই যখন তীব্র বিষাদের চোখে বোবা হয়ে তারই একান্ত আপন মানুষের বদলে যাওয়া দেখে সেটা আমাদের মস্তিষ্ককে আরেকবার দুঃখঢেউয়ের গর্জন শোনায়। বাকের ভাইয়ের চাঁপা স্বভাব কেউ ধরতে না পারলেও ধরতে পারে তারই গোপন প্রেমিকা মুনা। সেই মুনা, যে মুনাকে এক পলক দেখার জন্য রাত বারোটায় কোনো না কোনো অজুহাতে তার সামনে হাজির হন বাকের ভাই। যেই মুনাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কারাগারে দেখতে পেয়ে আনন্দে দিগবিদিক হয় বুক। অথচ, তাদের আর এক হওয়ার আশা থাকেনা। ঝরো হাওয়ার মতন ছিটকে পরে প্রান্তর। শেষ দেখায় বাকের ভাইয়ের আকুতি বুকের খাঁচা নাড়িয়ে দেয়।
“আরেকটু থাকো। মুনা। ২ মিনিট।
২ মিনিটে কি হবে বাকের ভাই?
২ মিনিট কিন্তু কম না। ফাঁসির আসামীর জন্য ২ মিনিট অনেক সময়।”
এভাবেই অনন্ত এক বিষাদের সাক্ষী নিয়ে হারিয়ে যায় সজীব দুই আদল। জন কফি আর বাকের ভাই’রা হাসতে হাসতে হারিয়ে যায় অসীম তল্লাটে। মুনা, পল কিংবা এক পশলা ঝড়ো হাওয়া হেঁটে বেড়ায় অনন্ত স্মৃতি বুকে নিয়ে একাকীত্বের প্রান্তরে। আর আমরা সরল অংকের মতন হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে ভাবি, কোথাও কি একটু সুখের ঠিকানা মেলে?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০২২ দুপুর ১২:১৭