somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিরায়ত রসঃ ডমুরুধরের কুমির শিকার

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূলঃ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
বাংলা সাহ্যিতের কিছু অসাধারণ দমফাটানো হাসির গল্প রয়েছে। সেই সকল হাসির গল্পের সংকলন ঘটবে আমার এই ব্লগে। এখানে আমার কোন সৃষ্টিশীলতা নাই। আমি মূলত চাই বাংলাসাহিত্যের চিরায়ত রস সম্পর্কে দেশের প্রত্যেক মানুষ জানুক। এই গল্প পড়ে যদি এক জনেরও ভাল লাগে তবে তার কৃতিত্ত্ব সম্পূর্ণ লেখকের। আমার ভাললাগা থাকবে কেবল সেখানে যে-আমি অন্তত একজন মানুষকে হলেও পড়ার সুযোগ করেদিয়েছে।

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,- শুনিয়াছি যে, সুন্দরবনে নদী নালায় অনেক কুমির আছে ! তোমাদের আবাদে ঐ জলাজমিতে কুমির কিরূপ?
ডমরুধর বলিলেন, - কুমির ! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমিরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুর গাছের মত নদীতে তাহারা ভাসিয়া বেড়ায়। অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এসব কুমিরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। একবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমিরের আবির্ভাব হইয়াছিল। ইহার দেহ বৃহৎ, তাল গাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটির মত, অন্যান্য কুমির জীবজন্তুকে ছিড়িয়া ভক্ষণ করে, কিন্তু এ কুমিরটা অস্ত গরু, আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোলালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু-বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল। তাহার পর লাঙ্গুলের আঘাতে নৌকা ডুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত ও পথ দিয়া নৌকায় যাতায়থ অনেক পরিমাণে বন্ধ হইয়া গেল।

এই ভয়ানক কুমিরের হাত হইতে কিরূপে নিষ্কৃতি পাই এইরূপ ভাবিতেছি। এমন সময় আমাদের আবাদের নিকট একখানি নৌকা ডুবাইয়া তাহার আরোহীদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সে গিলিয়া ফেলিল। এই নৌকায় এক ভদ্রলোক কলিকাতা হইতে সপরিবারে পূর্ব-দেশে যাইতেছিলেন। নদীর তীরে দাঁড়াইয়া আমার দেখিলাম যে, তাঁহার গ্রহিণীর সর্বাঙ্গ বহুমূল্য অলংকারে ভূষিত ছিল। তোমরা জান যে কুমিরের পেটে মাংস হজম হয়, গহনা পরিপাক পায় না। কুমির যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল, তখন আমার মনে এই চিন্তা উদয় হইল,- চিরকাল আমি কপালে পুরুষ। যদি এই কুমিরটাকে আমি মারিতে পারি, তাহা হইলে পেট চিরিয়া ঔই গহনাগুলেঅ বাহির করিব। অন্তত পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।

এই রূপ চিন্তা করিয়া আমি কলিকাতায় গমন করিলাম। বড় একটি জাহাজের নঙ।গর কিনিয়া উকো ঘষিয়া তাহাতে ধার করিলাম। তাহার পর, যে কাছিতে মানোয়ারী জাহাজ বাঁধা থাকে সেইরূপ এক কাছি ক্রয় করিলাম। এই রূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম। আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে, কুমির একটা মানুষ খাইয়াছে। চারিদিন পূর্বে এক সাঁওতালনী বুড়ি বেগুন মাথায় করিয়া হাটে বেচিতে যাইতেছিল। সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে, আর কুমির তাহাকে ধরিয়া বেগুনের ঝুড়ি সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে। তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগণ খেপিয়া উঠিয়াছে। বলিতেছে যে, আবাদ ছাড়িয়া তাহার দেশে চলিয়া যাইবে।
আবাদে আসিয়া নঙ্গরটিকে আমি বঁড়শি করিলাম। তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম। নঙ্গরের তীক্ষ্ন অগ্রভাগে এক মহিষের বাছুর গাঁথিয়া নদীর জলের নিকট বাঁধিয়া রাখিলাম।নদীল ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ-গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল। তাহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে সেই প্রকান্ড কুমির আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার লেজের ঝাপটে পর্বত-প্রমাণ এক ঢেউ উঠিল। সেই ঢেউয়ে বাছুরটি ডুবিয়া গেল। তখন আমারা আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না, পরক্ষণেই কাচিতে টান পড়িল। তখন আমরা বুঝিলাম যে নঙ্গরবিদ্ধ বাছরকে কুমির গিলিয়াছে। বঁড়শির ন্যায় নঙ্গর কুমিরের মুখে বিধিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি পঞ্চাশ জন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টনিতে লাগিল। ভাগ্যে গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলমা। তা না হইলে কুমিরের বলে এই পঞ্চাশ জন লোককে নদীতে গিয়া পড়িতে হইত।
আমরা সেই রাক্ষ কুমিরকে বঁড়শিতে গাঁথিয়াছি, ওই কথা শুনিয়া চরিদিকর আবাদ হইতে অনেক লোক দৌড়িয়া আসিল। প্রায় পাঁচ শত লোক সেই রশি ধরিয়া টানিতে লাগিল। দারুণ আসুরিক বলে কুমির সেই পাঁচ শত লোকের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল। কখনও আমাদের ভয় হইল যে, সে জাহাজের দাড়া বা ছিড়িয়া যায়। কখনও ভয় হইল গাছ উৎপাটিত হইয়া নদীতে গিয়া বা পড়ে। নিশ্চয় একটা না একটা বিভ্রাট ঘটিত, যদি না সাঁওতালগণ কুমিরের মস্তকে ক্রমাগত তীর বর্ষন করিত। যদি না নিকটস্থ দুটি আবাদের লোক বন্দুক আনিয়া কুমিরের মাথায় গুলি করিত। তীর ও গুলী খাইয়া কুমির মাঝে মাঝ জলমগ্ন হইতে লাগিল। কিন্তু নিশ্বাস লইবার জন্য পুনরায় তাহাকে ভাসিয়া উঠিতে হইল। সেই সময়ে লোকে তীর ও ঘুলি বর্ষণ করিতে লাগিল। কুমিরের রক্তে নদীর জল বহুদুর পর্যন্ত লোহিত বর্ণের রঞ্জিত হইয়া গেল। সমস্ত রাত্র্রি কুমিরের সহিত আমাতের এই রূপ যুদ্ধ চলিল। প্রাতকালে কুমির হীনবল হইয়া পড়িল। বেলা নয়টার সময় তাহার মৃতদেহ জলে ডুবিয়া গেল। তখন অতি কষ্টে তাহাকে আমরা টানিয়া উপরে তুলিলাম।

বড় ছোরা, বড় বড় কাস্তে আনিয়া তাহার পেট চিরিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে রাক্ষস কুমিরের পেট অতি কঠিন ছিল। আমাদের সমুদয় অস্ত্র ভাঙিয়া গেল। অবশেষে করাতি আনিয়া করাত দিয়া তাহার উদর কাটাইলাম। কিন্তু পেট চিরিয়া পেটের ভিতর যাহা দেখিলাম তা দেখিয়াই আমার চক্ষু স্থির।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,- কি দেখিলে?
শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,- কি দেখিলে?
অন্যান্য শ্রোতাগণ জিজ্ঞাসা করিলেন- কি দেখিলে?

ডমরুধর বলিলেন,- বলিব কি ভাই, আর দুঃখের কথা, কুমিরের পেটের ভিতর দেখি না যে, সেই সাঁওতাল বুড়ি চারদিন পূর্বে কুমির যাহাকে ভক্ষণ করিয়াছিল, সে পূর্বদেশীয় সেই ভদ্রমহিলার সমুদয় গহণাগুলি আপনার সর্বাঙ্গে পরিয়াছে,- তাহারপর নিজের বেগুনের ঝুড়ি সে উপুর করিয়াছে, সেই বেগুনগুলি সম্মখে ভাগ করিয়া রাখিয়াছে। ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছে।

শঙ্কর ঘোষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,- কুমিরের পেটের ভিতর ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল?
ডমরুধর বলিলেন,- হ্যা ভাই ! কুমিরের পেটের ভিতর সেই ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,- কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল? কুমিরের পেটের ভিতর সে খরিদ্দার পাইল কোথা?

বিরক্ত হইয়া ডমরুধর বলিলেন, তোমরা এক কথা ! কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল, সে খোজ করিবার আমার সময় ছিল না। সমুদয় গহনাগুলো সে নিজের গায়ে পরিয়াছিল, তাহা দেখিয়াই আমার হাড় জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম,-ও গহনা আমার ! অনেক টাকা খরচ করিয়া আমি কুমির ধরিয়াছি ও গহনা খুলিয়া দে।

কেউমেউ করিয়া বুড়ি আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। তাহার পর তাহার পুত্রগণ ও তাহার জাতি ভাইগণ কাড়-বাশ ও লাঠি-সোটা লইয়া আমাকে মারিতে দৌড়িল। আমার প্রজাগণ কেহই আমার পক্ষ হইল না। সতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল। সাঁওতালগন সে মাগীকে ঘরে লইয়া গেল। দিন কয়েক শুকর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাহার আমোদ-প্রমোদ করিল। পূর্বদেশীয় সে ভদ্রমহিলার একখানি গহনাও আমি পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে, কপালে পুরুষের ভাগ্যও সকল সময়ে প্রসন্ন হয় না।

লম্বোদর বলিলেন,- এত আজগুবি গল্প তুমি কোথায় পাও বল দেখি?
ডমরুধর বলিলেন,- এতক্ষ হা করিয়া এক মনে এক ধ্যানে গল্পটি শুনিতেছিলে। যেই হইয়া গেল, তাই এখন বলিতেছ যে, আজগুবি গল্প। কলির ধর্ম বটে।
শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা কলিলেন,- এ কুমিরের গল্প সত্য, তাহার পকোন প্রমাণ? নিশ্চয় আছে। কোমরের ব্যাথার জন্য এই দেখ সেই কুমিরের দাত আমি পরিয়াছি।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন, সে কুমির যদি তাল গাছ অপেক্ষা বৃহৎ ছিল, তবে তাহার দাত এত ছোট কেন? ঠিক অন্য কুমিরের দাতের মত কেন?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,- অনেক মানুষ খাইয়া সে কুমিরের দাত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৩২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদি ভাই, ইনসাফ এবং একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প

লিখেছেন গ্রু, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৮



ইদানিং একটা কথা খুব মনে পড়ে। হাদি ভাই।

মানুষটা নেই, কিন্তু তার কথাগুলো? ওগুলো যেন আগের চেয়েও বেশি করে কানে বাজে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি? ক্ষমতা? গদি? নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×